ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আলী যাকের

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ০৮:০১, ১২ অক্টোবর ২০১৮

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

(পর্ব-১৯) ১৯৬৫ সালে পেঙ্গুইন প্রকাশিত মার্টিন এসেলিন সম্পাদিত একটি নাটক সংকলন আছে যার শিরোনাম হলো এ্যাবসার্ড ড্রামা। এই সংকলনে চারজন নাট্যকারের চারটি কালজয়ী নাটক স্থান পেয়েছে। ইউজিন আয়োনেস্কোর ‘এ্যামিডি এন্ড হাও টু গেট রিড অফ ইট’, আর্থার এ্যাডামভ এর ‘প্রফেসর তারান’, ফারনান্দো এ্যারাবেল এর ‘দ্য টু এক্সেকিউশনারস’ এবং এডওয়ার্ড এ্যালবির ’দ্য যু স্টোরি’। এই বইটির মাধ্যমেই এ্যাবসার্ড নাট্যকারদের সঙ্গে আমার পরিচয়। তারপর পর্যায়ক্রমে বেকেট, সার্ত্র, কাম্যু, আনুই, কক্তো এবং আরও পরে কবি গ্যুন্টার গ্রাসের নাটকের সঙ্গে। আমরা যখন নিয়মিত নাটকাভিনয় শুরু করি তখন এ্যাবসার্ড নাটক আমাদের ভীষণ অবাক করত এবং এই বিস্ময়ের কারণে এ্যাবসার্ড নাটকের প্রতি আমাদের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। আমাদের আড্ডায় আমরা তখন প্রায়ই এ্যাবসার্ড নাটক নিয়ে চায়ের পেয়ালায় ঝড় তুলতাম। অনেকে আবার এ্যাবসার্ড নাটককে ’অসংলগ্ন নাটক’ বলে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে, যখন বিশ্বমঞ্চে রিয়েলিস্ট নাটকের রাজত্ব বিদ্যমান তখন ইউরোপে বস্তায় করে টাকা নিয়ে গিয়েও একটি আস্ত রুটি কেনা দুষ্কর। যখন যুদ্ধ বিধ্বস্ত মানুষেরা কোন কিছু একটা ঘটবার অপেক্ষায় আছে। অলৌকিক একটা কিছু। যার ফলে তাদের প্রতীক্ষার শেষ হতে পারে। তখন সেই অস্থির, আশাহীন মানুষগুলোর মধ্য থেকেই বেরিয়ে এল কিছু নাট্যকার, যাঁরা ওই অস্থির সময়ের অলীক বাস্তবসম্মত নাটকের ঝুঁটি ধরে নাড়া দিলেন এবং তাঁদের ওই দঃসাহসী নাটক দিয়ে মানুষের কাছে একটি প্রশ্ন তুলে ধরলেন, এই রকম যে ‘দেখ চোখ খুলে, বাস্তবতা কাকে বলে?’ বাস্তবসম্মত নাটকের যা উপাদান তার কিছুই এই নাটকগুলোতে নেই। এই নাটকে কোন সুগঠিত গল্প নেই, কোন নির্দিষ্ট শুরু, মধ্যভাগ বা শেষ নেই। এই নাটক হঠাৎ করেই শুরু হয়। এই নাটকের কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই যাতে দর্শক ধরে নিতে পারে কখন তাদের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে হবে। অসংলগ্ন বলে বর্ণিত নাটকের স্রষ্টাদের প্রশ্ন হলো, বাস্তবধর্মী নাটক অভিধায় আমরা যে নাটকগুলোকে বোঝাতে চাইছি সেগুলো আসলেই কতটুকু বাস্তব? আবার অসংলগ্ন বলে যে নাটক সংজ্ঞায়িত হচ্ছে সেগুলো বাস্তব থেকে কত দূরে? স্যামুয়েল বেকেটের ‘গডোর প্রতীক্ষায়’ যখন মঞ্চে এল তখন অধিকাংশ নাট্য দর্শক নাসিকা কুঞ্চিত করে বলেছিলেন এটা কি হলো? এটা কি নাটক হলো? এতে গল্প কই? তারা প্রত্যাখ্যান করলেন গডোকে। অথচ ওই নাটকই যখন কারাগারের অন্তরালে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের দেখানো হলো, তখন নাটক শেষে মুহুর্মুহু করতালিতে তারা অভিনন্দন জানালেন ’গডোর প্রতীক্ষায়’কে। কেন? কারন তারা নাটকটিতে এমন কিছু আবিষ্কার করলেন যা জীবন ঘনিষ্ঠ। এই যে দিনের পর দিন দুটি মানুষ অপেক্ষায় রয়েছেন একটি পত্র-পুষ্পহীন বৃক্ষের নিচে এই আশায় যে গডো একদিন আসবেন, নিশ্চয়ই আসবেন। সেই গডো তো আর এলেন না! এই অপেক্ষায় থাকতে, থাকতে তারা নিত্য নতুন এবং হাস্যকর সব খেলার উদ্ভাবন করেন। খেলা এগুতে থাকে, উত্তেজনা বাড়তে থাকে। তাঁদের মনে হয়, এমনকি দর্শক হিসেবে আমাদেরও, যে এই বুঝি কিছু একটা ঘটবে। কিছু একটা! অলৌকিক কিছু! যাতে এই একঘেঁয়ে প্রতীক্ষা শেষ হয়? কিন্তু কিছুই ঘটে না। সমস্ত আশা-আকাক্সক্ষা, উত্তেজনা একটি দীর্ঘশ্বাসে পর্যবসিত হয়। আমরা যদি এই ধরনের সৃষ্টিকে বাস্তবতার মাপকাঠিতে বিশ্লেষণ করি, যে কোন সমাজে, তা সে উন্নত বিশ্বে হোক কি উন্নয়নশীল বিশ্বে, তাহলে কি অহরহ চোখে পড়বে না মানুষের নিরন্তর অসহায়ত্বের স্থির চিত্রগুলো? কথা সাহিত্যিক নাট্যকার আলবেয়ার কাম্যু বিষয়টিকে এইভাবে দেখেছেন যে মানুষের ‘জীবন যুদ্ধ’, মানুষের ‘জীবনের’ সঙ্গে প্রায় সম্পর্কহীনভাবেই চলতে থাকে। কাম্যুর ভাষায়, উভয়ের মধ্যে কোন হারমনি নেই। হারমনিবিহীন জীবনই হচ্ছে জীবনের এ্যাবসার্ডিটি। কাম্যু তার ‘মিথ অব সিসিফাস’ গ্রন্থে কি সুন্দরভাবে এই অসংলগ্নতাকে তুলে ধরেছেন! সেই যে সিসিফাস একটি অত্যন্ত ভারি পাথর মাথায় করে পাহাড় বেয়ে উঠতে থাকে এবং পাহাড়ের শীর্ষে পৌঁছানোর আগেই মাথা থেকে খসে পড়ে পাথর। গড়িয়ে নেমে যায় পাহাড়ের নিচে। সিসিফাস আবার নিচে নেমে আসে। আবার যাত্রা শুরু করে আবার ওই একই ঘটনা ঘটে। এই চড়াই-উতরাই চলতেই থাকে। এর অন্ত নেই। এই যন্ত্রণাই হলো এ্যাবসার্ড নাটকের উপজীব্য। আমরা যারা ছাপোষা মানুষ, জীবনের খেলা সাঙ্গ করে কি কখনও এমন মনে হতে পারে না যে সারা জীবন ওই সিসিফাসের মতো কেবল পর্বত শৃঙ্গে পাথর বয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টাতেই পার করে দিলাম? আর কোন দিকেই তো তাকানো হলো না! এই উপলব্ধির যন্ত্রণা থেকে এমন সব নাটকের সৃষ্টি যা কল্পনার সুখ-স্বপ্নে বিভোর মানুষকে ধাক্কা মেরে নিষ্ঠুর বাস্তবের একেবারে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। তথাকথিত এ্যাবসার্ড নাটক, যা জীবনের কথা বলছে, তার মঞ্চায়নে কোন দ্বিধার ব্যাপার নেই। এর একটি কারণ হলো আমরা যদি আমাদের জীবনের দিকে বিশ্লেষণী দৃষ্টি দিয়ে তাকাই তাহলে আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনাই ভীষণ অসংলগ্ন ঠেকবে এবং এই অসংলগ্ন ঘটনাগুলো পরিবেশ বা পরিস্থিতির সৃষ্টি। এমন একটি দৃশ্যের কথা কল্পনা করুন দেশে দুর্ভিক্ষ চলছে। চারদিকে অনাহারে মানুষ মারা যাচ্ছে। ঢাকার কোন এক বস্তিতে একটি কিশোর এবং তার পৌঢ় পিতার বাস। একদিন পিতার মৃত্যু হলো। পুত্র পিতার মরদেহ কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে কবর দেয়ার জন্য। রাজপথ দিয়ে অতি ধীরে ধুঁকে ধুঁকে চলছে সে। সেও ক্ষুধায় জরাজীর্ণ। পিতার মৃত্যুশোকে মুহ্যমান। হঠাৎ আশপাশের কোন খাবারের দোকান থেকে ভেসে আসে উপাদেয় খাবারের সুগন্ধ। কিশোরটি প্রথমে আনমনা হয়ে পড়ে। তারপর, পিতার শবটিকে নামিয়ে রাখে রাস্তায়। মুহূর্তের মধ্যে পিতার মৃত্যু শোক ভুলে যায় সে। খাবারের গন্ধ আত্মহারা করে তাকে। সে ভুলে যায় পিতার শবের কথা। খুঁজতে শুরু করে উপাদেয় খাদ্যের সুগন্ধের উৎস। যদি সে কাছে পিঠে কোথাও ওই খাদ্যের উচ্ছিষ্ট কুড়িয়ে পায় এবং পিতার শবের কাছে বসে পরম আত্মতৃপ্তিতে গোগ্রাসে গিলতে থাকে সেই খাবার, তাহলে কি পরিস্থিতির বিচারে আমরা এই দৃশ্যটিকে অসংলগ্ন আখ্যা দিতে পারি? তবুও কি এ অসংলগ্ন নয়? আসলে রিয়েলিজম কথাটির উল্লেখ করে আমরা নির্বিরোধী, সহজ এবং সুখপ্রদ বিষয়গুলোকেই বোঝাই। জীবনের রূঢ় সত্যগুলো যে আপাত অসংলগ্ন ঘটনাতেই বিধৃত তা ভুলে যাই। তাই জীবনের বিবর্ধিত চিত্র দেখলে আঁৎকে উঠি। তাই বলতে হয়, এ্যাবসার্ড নাটক জীবনের গভীরে প্রবেশ করে। মানুষকে ভাবায়। শখের দর্শককে চিন্তাশীল দর্শকে পরিণত করে। অনেকে বলেন যে, এ্যাবসার্ড থিয়েটারের যুগ শেষ হয়ে গেছে। স্বীকার করি যে, ‘এ্যাবসার্ড থিয়েটার’ শিরোনামটির যুগ শেষ হয়ে গেছে বটে, কিন্তু যে জীবনবোধ ওই শিরোনামে সংজ্ঞায়িত নাটকগুলোর মধ্যে পাই, যা আয়োনেস্কো, বেকেট, এ্যারাবেল, এ্যালবি, কাম্যু আমাদের দিয়ে গেছেন, তারই উত্তরসূরি, সামান্য পরিবর্তিতভাবে, আজকের অনেক তরুণতর এবং সফল নাট্যকার। অতএব, জীবন যতদিন আমাদের নির্দেশ করবে জীবন নিয়ে ভাবতে ততদিন গভীর, জীবন ঘনিষ্ঠ নাটক বিশ্বের নাট্য মঞ্চে সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখেই যাবে। (চলবে)
×