ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বই ॥ শেকড়ের অনুসন্ধান

প্রকাশিত: ০৮:০২, ১২ অক্টোবর ২০১৮

বই ॥ শেকড়ের অনুসন্ধান

ত্রিশের ফাঁড়া কেটে যারা শেষ পর্যন্ত টিকে আছেন, আশরাফ পিন্টু তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বন্যার জলের মতো তারুণ্যের তোড়ে হৃদয়ের আবেগের বেগ সামাল দিতে না পেরে অনেকেই লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত হৃদয়ে চর পড়ে। আশাহত হৃদয়ে দিগভ্রান্তের মতো ঘোরেন, কোন কিনারা করতে পারেন না। অবশ্য অধিকাংশ এ দলের হলেও প্রত্যেকে নন। তাদের স্বপ্ন যাত্রায় যত ফাঁড়াই আসুক বরং তারুণ্যের তোড়েই হৃদয়ে বসন্ত আসে। লেখক মাত্রই হৃদয়ে বসন্ত ঋতু। বসন্তই প্রেরণার উৎস। বয়সের মানদ- এখানে খাটে না। সে হয় সাহসী, পরিশ্রমী। উদ্যমী, উচ্ছল কিন্তু উশৃঙ্খল নয়। আশরাফ পিন্টুও ঠিক তাই। তার ‘পাবনা জেলার গ্রাম-মহল্লার নামকরণের ইতিহাস’ সেই সাহস ও পরিশ্রমের ফসল। এ যেন বাংলার প্রান্তরের সোনালি ধানের ঢেউ। এক পলকেই হৃদয় কাড়ে। এর মধ্যে এতটুকু কৃত্রিমতা নেই, নেই বাহুল্যতা। আছে শুধু দুধ থেকে ছেঁকে তোলা ছানার স্বাদ। বইটি পাবনা জেলার গ্রাম-মহল্লার নামকরণের ইতিহাস হলেও তিনি শুধুমাত্র নামকরণের মধ্যে আবদ্ধ থাকেননি। দক্ষ ইতিহাসবিদের মতো এ জনপদের নিরেট ঐতিহাসিক বিবরণ ছেঁকে তুলে এনেছেন। ছেঁকেছেন ভালমতোই, মহাভারতীয় যুগ থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত। এক সময় এ অঞ্চল (দেশ)-টির কোন অস্তিত্বই ছিল না, ছিল জলের তলায় চাপা পড়ে। তাঁর ভাষায়- ‘খ্রিস্টপূর্বকালে- (মহাভারতীয় যুগে) প্রায় সমগ্র বাংলাদেশ সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত ছিল। এ সময় পাবনা জেলার কোন অস্তিত্ব ছিল না বললেই চলে।’ তিনি জলের গভীরে অনুসন্ধান চালিয়েছেন ঝানু ডুবুরির মতো; তুলে এনেছেন অমূল্য রতœ। পাবনা জেলার প্রথম ইতিহাস রচয়িতা রাধারমণ সাহার যোগ্য উত্তরসূরী ড. আশরাফ পিন্টু প্রাণের টানেই এসব করেছেন। আসলে সবাই পারে না, কেউ কেউ পারে। যারা পারে তারাই খাঁটি দেশপ্রেমিক। তিনি শুধু ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা দিয়েই ক্ষান্ত হননি। ব্যাখ্যা দিয়েছেন জেলার গঠন, অবস্থান, ভূ-প্রকৃতি জলবায়ু, জনসংখ্যা, পুরাকীর্তি, কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, নদ-নদী, জনজীবন, রাজনৈতিক ঐতিহ্যসহ নানা বিষয়। তাঁর বর্ণনার ভাষা ঘোলা-জলের ঘূির্ণর মতো নয়, বরং স্বচ্ছ জলের ঝর্ণাধারা। যে ধারায় বেগ আছে কিন্তু আহত করে না, পীড়া দেয় না। ফলে পাঠককে আত্মমগ্ন করে তোলে, তাই রচনাটি হয়ে ওঠে সুখপাঠ্য। যা একজন জাত লেখকের বৈশিষ্ট্য। পাবনা জেলায় যে দুই হাজারের মতো গ্রাম রয়েছে, তার উপজেলা ভিত্তিক স্থান ও নামের বৈশিষ্ট্য আওড়াতে গিয়ে মনে হয়েছে এত একেবারে জলের মতো সহজ। তলিয়ে ভাবতে গেলেই হা-পিত্তেস করতে হয়। কঠিন অথচ কি সহজ! এখানেই আশরাফ পিন্টুর সার্থকতা। তিনি উপজেলা ওয়ারি গ্রামের তালিকা দিয়েছেন যেখানে পাবনা জেলায় রয়েছে নয়টি উপজেলা, নয়টি পৌরসভা, চুয়াত্তরটি ইউনিয়ন। উপজেলা ভিত্তিক মহল্লার নাম এবং ইউনিয়ন ভিত্তিক গ্রামের নামও প্রণয়ন করেছেন যা এক নজরে সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। এ ছাড়া আরও সহজ করে দিয়েছেন ইউনিয়নসমূহের নাম (বর্ণানুক্রমিক) ছকের মাধ্যমে। শেকড়ের সন্ধান করতে গিয়ে তিনি মূল থেকে মূলোরম পর্যন্ত প্রবেশ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন- একই নামে বিভিন্ন পৌরসভা, ইউনিয়ন ও গ্রাম। যা আমাদের বিভ্রান্তি থেকে রেহাই দিয়েছে। একটি দেশের কোন স্থানের নামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সেখানকার কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, গুরুত্বপূর্ণ কোন ঘটনা, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কিংবা ধর্মীয় কোন প্রভাব। এই বিচারে বাংলাদেশের যে কোন জায়গার নাম বড়ই বিচিত্র। একদিকে যেমন রয়েছে ব্যক্তি অন্যদিকে দেব-দেবী, রয়েছে ধর্মীয় প্রভাব। এই নামকরণের সঙ্গে প্রকৃতিও জড়িয়ে রয়েছে নিবিড়ভাবে- গাছ-পালা, পশু-পাখি, নদ-নদী, খাল-বীল এবং রয়েছে কৃষি ও কৃষক। সাম্প্রতিককালে চরাঞ্চলে কয়েকটি হাট-বাজারের নামের পেছনে রয়েছে মনে হয় ঘটনার প্রচ্ছন্ন ছায়া- যেমন, ঠেলাঠেলির হাট, চুলকানির হাট। এ গ্রন্থের মেরু অধ্যায়ের (শেষ অধ্যায়) নাম হলো-‘নামকরণের উৎস অনুসন্ধান’। সে মেরু উত্তরই হোক আর দক্ষিণই হোক। কেননা উভয়ের অবস্থান প্রান্তে। তাতে টানের মাত্রা থাকে বেশি, আমিও টান খেয়েছি; আটকা পড়েছি। প্রথমে বেরুতে পারিনি, ভূত- গ্রস্থের মতো আচ্ছন্ন ছিলাম। দুটি প্রবাদের দিকে চোখ দুটি আঠার মতো আটকে ছিল। হয়ত আমার বাস ওই স্থানের কাছাকাছি তাই। প্রবাদ দুটি হলো- ১. কোথায় ইছাখালি/কোথায় কাছা খসালি। ২. এই দ্যাশে ভাতার নাই/ভাতার আছে ঈশ্বরদী। পাবনা জেলার স্থাননাম সমৃদ্ধ কবি ওমর আলীর ‘কঠোর মানুষ’ কবিতাটি যথার্থ মর্যাদায় স্থান দিয়েছেন। স্থান নামের ইতিহাস ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বাংলা সালের দিন, মাস এবং খ্রিস্টীয় দিন, মাসের পৌরাণিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যা উপরি পাওনা বলে মনে হয়েছে। পাবনা জেলার গ্রাম-মহল্লার নামকরণের ইতিহাস ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রতিটি উপজেলার শুরুতেই মানচিত্র জুড়ে দিয়েছেন। পাশা-পাশি প্রত্যেকটি উপজেলার আয়তন, জনসংখ্যা, জনসংখ্যার ঘনত্ব, নির্বাচনী এলাকা, পৌরসভা/ইউনিয়ন, মৌজা, হাসপাতাল, ক্লিনিক, পোস্ট অফিস, নদ-নদী, হাট-বাজার, ব্যাংক, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ইত্যাদি এসবের সঠিক সংখ্যা উল্লেখ করেছেন। আরও আছে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের শতকরা হিসাব এবং নারী-পুরুষের অনুপাত। যা সাধারণ পাঠকসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে সঠিক তথ্য উপাত্ত সংগ্রহে সহায়তা করবে। পাবনার নামকরণে যেসব জনশ্রুতি ব্যাখ্যা করেছেন তার মধ্যে রয়েছে- পবন ডাকাতের নামানুসারে পাবনা নামের উৎপত্তি। প্রতœতত্ত্ববিদ কানিং হামের মতে, ‘পৌ-্র’ হতে পাবনার উৎপত্তি। রাধারমণ সাহার ‘পাবনা জেলার ইতিহাস’ গ্রন্থের উদ্বৃতি দিয়ে বলেছেন ‘পাবনী’ থেকে পাবনার নামকরণ হয়েছে। এছাড়াও চৌধুরী মহাম্মাদ বদরুদ্দোজা ‘জিলা পাবনার ইতিহাস’ গ্রন্থে ‘পমবাহ’ থেকে পাবনার নামকরণ দেখিয়েছেন। পরিশিষ্টে যে সকল ঐতিহাসিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন স্থানের নামকরণ হয়েছে তাদের ছবি সংযুক্ত করায় বইটি আরও চমকপ্রদ হয়েছে। পূর্বেই বলেছি, ‘এ যেন বাংলার প্রান্তরের সোনালি ধানের ঢেউ’। এ কথা বলার পর এ গ্রন্থ নিয়ে আর নিন্দে করা খাটে না। ঠিক নিন্দে নয় একটি অভিযোগ- পাবনা সদর উপজেলার দাপুনিয়া ইউনিয়নের মির্জাপুর নামক গ্রামের নামকরণের উৎস তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোথাও পায়নি। মনে হয়েছে- সোনালি ধানের একগোছা ইঁদুরে কেটেছে। এতে ফসলের শ্রীহানি হয়নি, শুধু হারিয়ে গেছে এক মুঠো ধান। তবুও এই সোনালি ধানের সৌরভে পাঠক মেতে উঠবেন বলে আমার বিশ্বাস। জহুরুল ইসলাম
×