ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ধ্বংসের পথে দুলাই জমিদার বাড়ি

প্রকাশিত: ০৪:৪৫, ১৩ অক্টোবর ২০১৮

 ধ্বংসের পথে দুলাই জমিদার বাড়ি

মুসলিম জমিদারদের মধ্যে প্রতাপশালী জমিদার ছিলেন পাবনার সুজানগর উপজেলার দুলাই গ্রামের আজিম চৌধুরী। তার স্মৃতিবিজড়িত প্রায় আড়াই শ’ বছরের প্রাচীন বাড়িটি আজ ধ্বংসের মুখে। জমিদার আজিম চৌধুরীর পূর্ব পুরুষ মধ্য এশিয়ার ছামারখন্দ থেকে পাবনায় আসেন। তার বাবা ছিলেন রহিম উদ্দিন চৌধুরী। উল্লেখ্য, বহির্বিশে^ ধর্ম প্রচার, ব্যবসা বাণিজ্য, শিক্ষা-দীক্ষা ও জমি দখল এই চার শ্রেণীর মানুষ এ উপমহাদেশে আসে। এর মধ্যে জমি দখল ও শাসন করার জন্য আজিম চৌধুরীর পূর্ব পুরুষ এখানে আসেন। জমিদার আজিম চৌধুরী ১৫০০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সময় পর্যন্ত এ এলাকা শাসন করেন। আজিম চৌধুরী খুবই শৌখিন, ধার্মিক ও দয়াশীল ছিলেন। তিনি দুলাই নিভৃত পল্লীতে চারতলা বিশিষ্ট একাধিক দৃষ্টিনন্দন বিলাসবহুল ভবন নির্মাণ করেন। এ ভবনগুলো বহু কক্ষ ও বহুদুয়ারী বিশিষ্ট। ১২০ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত বাড়িটিতে ছিল ১১টি নিরাপত্তা গেট। প্রথম গেটে নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক ২টি হাতি থাকত। সামগ্রিক নিরাপত্তায় দুটি কামানও বসানো ছিল। অন্য জমিদারদের আক্রমণের নিরাপত্তা সুরক্ষায় বাড়ির চতুর্দিকে বিশাল দীঘি কাটা হয়। বাড়িতে দেশী-বিদেশী প্রচুর গাছের বাগান করা হয়। বাড়ির একপাশে প্রতিষ্ঠা করা হয় মসজিদ। এ মসজিদটি এখনও মুসল্লিরা নামাজ আদায় করেন। মসজিদটির নির্মাণকৌশল দেখলে এখনও অবাক হতে হয়। এলাকার প্রবীণরা জানান, বাড়িটির মূলভবন, মসজিদ, পুকুর, হাতিশাল, ঘোড়াশাল, কাঁচারিবাড়িসহ প্রাসাদের আয়তন ছিল প্রায় ৭শ’ বিঘা। আশপাশের জমিদারদের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রতাপশালী ও ধার্মিক। তার সম্পর্কে অনেক কিংবদন্তি রয়েছে। আজিম চৌধুরীর প্রাসাদে প্রতিশুক্রবার ৭টি গরু জবাই করে প্রজাদের খাওয়ানো হতো। আজিম চৌধুরীর পাশর্^বর্তী জমিদার ছিলেন গোবিন্দ রায় চৌধুরী। তিনি মুসলমানদের গরু কোরবানি করতে দিতেন না। মুসলিম প্রজারা তার কাছে নালিশ করলে তিনি হাতির পিঠেচড়ে গোবিন্দ রায় চৌধুরীর বাড়িতে যান। তাকে হাতির পিঠ থেকে গোবিন্দ রায় চৌধুরী নামতে বললে তিনি জানান অন্যের জমিতে তিনি পা রাখবেন না। তখন গোবিন্দ রায় চৌধুরী খাজাঞ্জিকে আজিম চৌধুরীর নামে বিপুল পরিমাণ জমি লিখে দেয়ার নির্দেশ দেন। এরপর থেকে এ জমিতেই মুসলমানরা কোরবানি দেয়া শুরু করেন। আজিম চৌধুরী নিজেও অনেক সম্পত্তি দান করেন। তার জমির উপরই আজ সরকারী বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আজিম চৌধুরী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে খাজনা না দেয়ার কারণে তাকে বিদ্রোহী আখ্যা দিয়ে দমনের জন্য সশস্ত্রবাহিনী পাঠায়। এ সময় আজিম চৌধুরীর সঙ্গে তাদের যুদ্ধ হলে তিনি পরাজিত হন। পরাজিত হয়ে প্রাসাদের সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে পালিয়ে বজরায় চড়ে কলকাতার নিকটবর্তী ফ্রেন্স চন্দননগরে আশ্রয় নেন। সেখানে ১৫/২০ বছর অতিবাহিত করে পাবনা শহরে বাকি জীবন কাটান। তার কবর এখনও শহরের ফায়ার ব্রিগেডের পাশের বাড়িতে সুরক্ষিত আছে। আজিম চৌধুরীর পঞ্চম উত্তরসূরি বিমান বাহিনীর সাবেক গ্রুপ ক্যাপ্টেন হাইবাত জান চৌধুরী জানান, আজিম চৌধুরীর এতবড় প্রাসাদ ধ্বংস হওয়ার পেছনে তার বংশধররাও কম দায়ী নয়। জমিদার প্রথা উচ্ছেদ হওয়ার পর তার বংশধররা গুপ্তধনের লোভে ভবনের বিভিন্ন অংশ ভেঙ্গে ফেলে। চারতলা ভবনটির একতলা মাটির নিচে বসে গেছে। উপরের অংশও বিভিন্ন লতা, পরগাছা পেঁচিয়ে জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। একসময় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আজিম চৌধুরীর দৃষ্টিনন্দন বাড়িটি দেখার জন্য ভিড় জমাত। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরাও পিকনিকে আসত। কিন্তু অযত্ন অবহেলায় আজ বাড়িটি ধ্বংস হতে চলেছে। তিনি আরও জানিয়েছেন সরকার যদি বাড়িটি প্রত্নতত্ত্বের স্বীকৃতি দিয়ে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলত তাহলে ঐতিহাসিক এ নিদর্শনটি ইতিহাসের স্বাক্ষর বহন করে আরও যুগ যুগ ধরে টিকে থাকত। -কৃষ্ণ ভৌমিক, পাবনা থেকে
×