ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

১৪মাস ধরে মাছ ধরা বন্ধ নাফ নদীতে

প্রকাশিত: ০৩:১৪, ১৫ অক্টোবর ২০১৮

১৪মাস ধরে মাছ ধরা বন্ধ নাফ নদীতে

স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার ॥ মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ও ইয়াবার চালান রোধকল্পে নাফনদীতে মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা পরবর্তী এক বছর দুই মাস সময় অতিবাহিত হলেও জেলেদের ভাগ্য খুলেনি এখনও। পাওয়া যায়নি নাফনদীতে মাছ ধরার অনুমতি। এতে উখিয়া টেকনাফের জেলে পরিবারে দুর্ভোগ বেড়েছে। জানা যায়, গত বছর ২৭আগস্ট থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দেয়ায় (জানুয়ারি পর্যন্ত) রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নামার পরবর্তী এক বছর ২মাস পার হয়ে গেছে। ওই সময় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ও ইয়াবার চালান রোধে নাফনদীতে মাছধরা বন্ধ করে দেয়া হয়। মাদক-ইয়াবা বাংলাদেশে প্রবেশ রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন কোনো না কোনো স্থানে একাধিক চালান জব্দও হচ্ছে। রোহিঙ্গাসহ ইয়াবা গডফাদারদের ইশারায় বর্তমানেও মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান আসছে নাফনদী হয়ে টেকনাফে। গত এক বছরের বেশী সময় ধরে জেলে পরিবারে দুর্দিন চললেও নাফনদীতে মাছ ধরার অনুমতি মিলছেনা। তখন থেকে টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অর্ধ শতাধিক নৌকা ঘাটে নোঙর করে আছে। কিছু কিছু নৌকা অকেজো হয়ে পড়ে ব্যবহার অনুপযোগি হয়ে পড়েছে। জেলেরা বলেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে এমনিতেই নাফ নদীতে নানা সময়েই মাছ ধরার উপর বিজিবির বিধি নিষেধ থাকে। বর্তমানে সাগরে মাছ ধরা নিষেধাজ্ঞার কারণে এখানকার জেলেরা আরও বেশি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গত ২১ আগষ্ট বিজিবি সদস্যরা জেলেদের নাফ নদী ও সাগরে নামতে নিষেধ করে। ১৫ দিন পর সাগরে মাছ ধরার অনুমতি মিললেও নাফ নদীতে এখনও নামতে পারছে না টেকনাফের ১০ হাজারের বেশি জেলে। এর ফলে জেলা পরিবারে অভাব-অনটন দেখা দিয়েছে। মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহকারী জেলেদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা থাকলেও কিছু সংখ্যক জেলে সে ভাতার মুখ দেখেন। আরও অধিকাংশ জেলে বছরের পর বছর ধরে ভাতা বঞ্চিত হন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, সাগরে ইলিশ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জেলেদের জন্য ২১০ মেট্রিকটন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। দরিদ্র ওই জেলেদের মাঝে বরাদ্দকৃত চাল বণ্টন করা হবে। টেকনাফের জেলেরা জানায়, মিয়ানমার থেকে ঢালাওভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আগে ভালই চলছিল প্রতিটি জেলে পরিবারের সংসার। নাফনদীতে জাল ফেলে তারা প্রতিদিন আহরণকৃত মাছ বিক্রি করে ২-৩ হাজার টাকা হারে কামাই করতে পারত। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর তাদের সে সুযোগ আর নেই। অথচ নাফনদীতে (মিয়ানমার অংশে) রাখাইনে বসবাসরত রোহিঙ্গারা আগের মত জাল ফেলে মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সীমানা চিহ্নিত ওই নদীতে শুধু নামতে পারছেনা বাংলাদেশী জেলেদের নৌকাগুলো। একদিকে রোহিঙ্গা আগমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জেলেসহ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর, অপরদিকে মাছ শিকার করতে না পেরে অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে নিমজ্জিত হচ্ছে জেলে পরিবারগুলো। যদিও একাধিক এনজিও স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে ইতোমধ্যে কিছু সহায়তা দিয়েছে। জেলেরা বলেন, আমরা এনজিওর দেয়া ভিক্ষা (সাহায্য) নিতে রাজি নয়। আমরা স্বাধীন দেশের মানুষ। স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহ করে বাঁচতে চ্য়া। দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উপর জোরদাবী জানিয়ে জেলেরা বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে আমাদের সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। এলাকার ও স্থানীয় বাসিন্দাদের অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিলম্ব হলে অতিসত্তর তাদের ভাসানচরে স্থানান্তর করা প্রয়োজন। উল্লেখ্য টেকনাফে ৭ হাজার ৮৮৩ জন, উখিয়ায় ৩ হাজার ৩৯২ জন নিবন্ধিত জেলে রয়েছে। স্থানীয়রা বলেন, মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের এখানে আশ্রয় দিয়েছে সরকার। উখিয়া টেকনাফ এলাকায় এক বছর দুই মাস ধরে অবস্থান করলেও রোহিঙ্গাদের মধ্যে মিয়ানমারে ফিরে যাবার লক্ষণ দেখা যাচ্ছেনা। নিজের দেশের তুলনায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অধিক সুবিধা পাচ্ছে, তাই অনেকে এ দেশ ছেড়ে যেতে চাইছে না। এছাড়াও নয়াপাড়া এবং কুতুপালং দু’টি শরণার্থী শিবিরে ২৭বছর ধরে অবস্থান করছে সাড়ে ৩২হাজার রোহিঙ্গা। ১৯৯২সালে আশ্রয় নেয়া শিশু বর্তমানে ৩-৪ সন্তানের জনক। ওইসময়ের কন্যা শিশুরা তাদের মেয়েদের বিয়েও দিয়েছে। জন্মসূত্রে বাংলাদেশী বলে দাবী করে চলেছে তারা। কিছু সংখ্যক এনজিও এবং পুরনো রোহিঙ্গা নেতাদের উস্কানি পেয়ে ওরা কখনও মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাইছেনা। আশ্রিত রোহিঙ্গারা দখল করে নিয়েছে স্থানীয় শ্রমবাজার। রোহিঙ্গা শিবিরের পাশে দোকান বসিয়ে দিব্যি ব্যবসা করে যাচ্ছে অন্তত সহস্রাধিক রোহিঙ্গা। অনুমতি না থাকলেও রোহিঙ্গারা ক্যাম্প অভ্যন্তরেও বহু দোকান বসিয়েছে। আশ্রিত রোহিঙ্গারা একদিকে ফ্রি রেশন পাচ্ছে, অন্যদিকে অবৈধভাবে ব্যবসা করে দু’হাতে কামাই করছে নগদ টাকা। রোহিঙ্গাদের শরণার্থী আইন অনূসারে শৃঙ্খলার মধ্যে আনা না হলে ওসব রোহিঙ্গারা ভবিষ্যতে বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে বলে জানান স্থানীয়রা। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার লোকজন বলেন, প্রতিবছর শীতকালে নানা রকমের শীতকালীন সবজি স¯তা দরে পাওয়া যেত। গত বছর শীতকালীন সময়ে রোহিঙ্গাদের কারণে প্রতিকেজি ৫০-৬০টাকার নিচে কোন সবজি পাওয়া যায়নি। আসন্ন শীতকালীন মৌসুমেও লাখ লাখ রোহিঙ্গার কারণে সবজি পাওয়া দুস্কর ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতে পারে। যেহেতু রোহিঙ্গাদের রোজগার করা টাকায় পণ্য কিনতে হচ্ছেনা। তারা ত্রাণ সামগ্রী বিক্রি করে পাচ্ছে নগদ টাকা। বিভিন্ন এনজিও সংস্থায় মাসিক বেতনে চাকুরিও করছে। দিনমজুরি কাজ করে আয় করছে দৈনিক ৪-৫’শ টাকা হারে। আরাকান বিদ্রোহী গ্রুপের ক্যাডাররা (জঙ্গী) বিভিন্ন দাতা সংস্থার লোকজনকে শিবিরে এনে গোপনে নগদ টাকাও বিলি করছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে। সেহেতু কোন ধরণের টু-শব্দ ছাড়াই তারা মাছ-সবজি চড়াদামে কিনে খাচ্ছে। স্থানীয়রা কষ্ট করে কামাইকরা ওই টাকায় বেশী দামে তা ঘরে কিনে নিতে পারছেননা। তাই হয়ত প্রত্যাবাসন নতুবা জনবিচ্ছিন্ন কোন দ্বীপে রোহিঙ্গাদের দ্রুত স্থানান্তর করার দাবী জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
×