ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আজ ছেঁউড়িয়ার লালন আখড়ায় সাধুর হাট বসছে

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যমনে আসে যায়...

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১৬ অক্টোবর ২০১৮

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যমনে আসে যায়...

এমএ রকিব ॥ আজ পহেলা কার্তিক মরমি গানের স্রষ্টা, আধ্যাত্মিক সাধক বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ’র ১২৮তম তিরোধান দিবস আজ। এ উপলক্ষে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার লালনের আখড়া বাড়িতে বসছে সাধুর হাট। ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যমনে আসে যায়, ধরতে পারলে মনবেড়ি দিতাম পাখির পায়...’ এমন অসংখ্য মরমি গানের স্রষ্টা লালন। লালন একাডেমি ও জেলা প্রশাসন এই দিনটিকে মৃত্যুবার্ষিকী, তিরোধান দিবস বা প্রয়াণ দিবস হিসেবে পালন করলেও লালন ভক্ত-অনুরাগী, সাধু-গুরু-গোসাইরা দিনটিকে ‘উফাত দিবস’ হিসেবে পালন করেন। গভীর শ্রদ্ধাভরে দিনটি স্মরণ উপলক্ষে প্রথমদিন মঙ্গলবার বিকেলের মধ্যেই সাধু-গুরু (খেলাফতধারী) তাদের সেবাদাসী এবং লালন ভক্ত অনুসারীদের সঙ্গে নিয়ে সাঁইজির পুণ্যভূমি ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে নিজ নিজ পাটে (আসনে) বসবেন। একমাত্র খেলাফতধারী সাধু-গুরু ছাড়া ভক্ত-অনুসারীরা কেউ ‘আসনে’ বসার যোগ্যতা রাখেন না। ভক্ত-অনুসারীরা বসবে সাধু-গুরুর আশপাশে। আসনে বসা সাধু-গুরুদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ভক্তি-শ্রদ্ধার বিষয়। এই আসনে বা পাটে বসার সুনির্দিষ্ট কোন নিয়ম নেই। যার যেমন সামর্থ্য অনুযায়ী কেউ সাদা বা রঙ্গিন কাপড়ের টুকরোর ওপর, কিংবা শিতল পাতার মাদুর, এমনকি গামছা বিছিয়েও বসতে পারেন। সাধুসঙ্গের নিয়ম অনুযায়ী লগ্ন আসে সন্ধ্যার পর। পাটে বসে সন্ধ্যা লগ্নে ‘রাখাল সেবা’ গ্রহণের পর থেকে ২৪ ঘণ্টার অষ্টপ্রহর সাধুসঙ্গের আগ পর্যন্ত সাধু-গুরু তাদের ভক্ত-শিষ্যদের নিয়ে ধ্যানে বসে তপজপ করেন। ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ লালনের অমর এ বাণীকে স্মরণ করে দিনটি পালন উপলক্ষে এবারও লালন একাডেমি কুষ্টিয়া আয়োজন করেছে ১৬ থেকে ১৮ অক্টোবর তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠান। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সার্বিক সহযোগিতা ও কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের আয়োজনে প্রতিদিন বিকেল ৫টা থেকে অনুষ্ঠানে থাকছে লালন মেলা, লালনের জীবনাদর্শন ও স্মৃতিচারণ করে আলোচনা সভা ও লালন সঙ্গীতানুষ্ঠান। তবে লালন একাডেমির অনুষ্ঠান তিনদিন হলেও সাধুদের মূল অনুষ্ঠান দেড়দিনেই শেষ হয়ে যায়। তখন সাঁইজির পুণ্যভূমি ছেড়ে নিজ নিজ আশ্রমের দিকে চলে যেতে শুরু করেন সাধুরা। এদিকে লালনের মৃত্যুবার্ষিকীকে ঘিরে ছেঁউড়িয়া এখন উৎসবমুখর। সাধু-গুরু, বাউল-বাউলানি, ভক্ত-অনুসারী ও দর্শক-শ্রোতার পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে লালনের আখড়াবাড়ি। বসেছে সাধুদের মিলনমেলা। ছোট ছোট কাপড়ের টুকরোর ওপর, শিতল পাতার মাদুর, এমনকি মাটিতে গামছা বিছিয়ে বসেছে খ- খ- গানের আসর। ছোট ছোট দলে দলে বিভক্ত হয়ে একতারায় লালনের গানের সুর তুলছেন শিল্পী-ভক্তরা। প্রথমদিন পহেলা কার্তিক সন্ধ্যায় কুষ্টিয়া লালন একাডেমির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি থাকছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ এমপি। আলোচনায় অংশ নেবেন পুলিশ সুপার এসএম তানভীর আরাফাত, কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী রবিউল ইসলাম, খাকসা উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ সদর উদ্দিন খান, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী, কুমারখালী উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ আব্দুল মান্নান খান, জিপি এ্যাডভোকেট আখতারুজ্জামান মাসুম, পিপি এ্যাডভোকেট অনুপ কুমার নন্দী, কুমারখালী পৌরসভার মেয়র শামসুজ্জামান অরুন প্রমুখ। অনুষ্ঠানে আলোচক থাকছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. শাহিনুর রহমান, শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখবেন কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজীবুল ইসলাম খান। আলোচনা পর্ব শেষে রাতে বসবে মনোজ্ঞ লালন সঙ্গীতের আসর। এদিকে, লালন মেলায় একতারা-দোতারাসহ হরেক রকমের পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা। বিশাল এই আয়োজনকে নির্বিগ্ন ও নিরাপদ করতে কয়েক স্তরে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানান কুষ্টিয়া পুলিশ সুপার এসএম তানভির আরাফাত। আগামী ১৮ অক্টোবর মূল অনুষ্ঠান শেষ হলেও লালন মেলাসহ বাউলদের এই প্রাণের সম্মিলন চলবে আরও কয়েকদিন। বাউল ফকির বলাই শাহ জানান, সাধু-গুরুদের নিয়ম অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টায় সেবা ৪টি। এগুলো হচ্ছেÑ রাখাল সেবা, অধিবাসর সেবা, বাল্যসেবা এবং পুণ্যসেবা। সাধুসঙ্গের লগ্ন আসে সন্ধ্যায় পর। পাটে বসে সন্ধ্যা লগ্নে রাখাল সেবা গ্রহণের পর থেকে ২৪ ঘণ্টার অষ্টপ্রহর সাধুসঙ্গের আগ পর্যন্ত সাধু-গুরু তাদের ভক্ত-শিষ্যদের নিয়ে ধ্যানে বসে তপজপ করেন। রাতদিন ২৪ ঘণ্টার ৮টি প্রহর। এই ৮ প্রহরে তারা একই স্থানে বসে উপাসনা, সাধনা-আরাধনা করেন। যার যার গুরুর উপাসনা সেই সেই করেন। যার যার গুরু তাদের ভক্ত-শিষ্যকে যে যে উপাসনা দিয়েছেন, ধ্যানে রেখে সেই তপজপই তারা করেন। শিল্পীরা গান গাইছেন, সাধুরা বসে ধ্যান-তপজপ করছেন, পান খাচ্ছেন, আরাম করছেন, এরই মধ্য দিয়ে তাদের ধর্মীয় আচার চলতে থাকে। সন্ধ্যা লগ্নে মুড়ি, চিড়া, খাগড়াই (শুকনা খাবার) এক সঙ্গে মিশিয়ে যে খাবার দেয়া হয় তাকে বলে ‘রাখাল সেবা’। এটা দেয়া হয় প্রত্যেক সাধুর গামছায় গামছায়। এই অন্ন গ্রহণ সাধুদের কাছে অত্যন্ত পুণ্যের কাজ। কোন কারণে কেউ যদি এই অন্ন গ্রহণ থেকে বাদ পড়েন, তবে সে নিজেকে দুর্ভাগা মনে করেন। রাখাল সেবার পর সাধুদের আবার খেতে দেয়া হয় রাত ১২টা থেকে ১টার মধ্যে। রাত ১২টার পর পদ্ম পাতা অথবা কলার পাতায় সাধুদের যে জুগল অন্ন অর্থাৎ ডালে-চালে খিচুরি খেতে দেয়া হয় এটাকে বলে ‘অধিবাসর সেবা’। অধিবাসর সেবার মধ্য দিয়ে শেষ হয় সাধুদের প্রথম দিনের আচার অনুষ্ঠান। লালন সাঁইয়ের তিরোধান ॥ স্টাফ রিপোর্টার জানান, লালনের শিষ্যরা তাঁকে ডাকতেন ‘সাঁইজি’ বলে। একই সঙ্গে তারা বিশ্বাস করেন, সাঁইজি মারা যাননি, তিনি দেহত্যাগ করেছেন। শিষ্যদের ভাষ্যমতে, সাঁইজি মনে করতেন মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী। আজ যারা বেঁচে আছে-কালই তারা মারা যেতে পারে। কিন্তু কোনভাবে যদি জীবনকে অর্থাৎ সময়কে বেঁধে রাখা যেত তাহলে মৃত্যু আসত না। সাঁইজি এমনভাবেই নিজের জীবন ও সময়ের অচিন পাখিকে খাঁচার ভিতর আটকে রেখেছেন। তাই লালনের দেহত্যাগের পর থেকেই প্রতিবছর সাঁইজির তিরোধান দিবসে দেশের নানা প্রান্ত থেকে অনুরাগীরা জড়ো হয় কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়ার কালীগঙ্গা নদীর তীরের লালন আখড়ায়। লালনের ভাবশিষ্য আর সাধুদের সঙ্গে পৃথিবীর নানা দেশের বাউলের সমাগমে মুখরিত হয় লালনের আখড়াবাড়ি। ফকির লালন সাঁইজির জন্ম সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও ‘সাপ্তাহিক হিতকরী’ পত্রিকার মহাত্মা লালন ফকির প্রতিবেদন থেকে প-িতরা অনেকটা নিশ্চিত তিরোধানের তারিখ সম্পর্কে। অধিকাংশ প-িতদের মতে, কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাপড়ার ইউনিয়নের ভাড়রা গ্রামে ফকির লালন শাহের জন্ম। হিন্দু কায়স্থ পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতা মাধব কর, মাতা পদ্মবতী। বাবা মা তাকে আদর করে ডাকতেন লালু। তবে এ বিষয়ে সুনিশ্চিত কোন তথ্য নেই। লালনের গুরু ফকির সিরাজ সাঁই। তার সান্নিধ্যে আসার পর লালনের মধ্যে আধ্যাত্মিক ভাব চলে আসে। সিরাজ সাঁইয়ের দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে লালন সংসার বিবাগী হন। এ সময় একবার তিনি তার গ্রামে ফিরে গেলেও মুসলমান বাড়ির অন্ন গ্রহণ করায় তাকে তার পরিবার ও গ্রামের লোকজন মেনে নেয়নি। ফিরে এসে ছেঁউড়িয়ার কারিগর সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় তিনি আখড়া বাড়ি স্থাপন করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই আখড়া বাড়িতেই সময় কাটিয়েছেন।
×