ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হে দেবী তুমি জাগো

প্রকাশিত: ০৬:১০, ১৬ অক্টোবর ২০১৮

হে দেবী তুমি জাগো

শরতভূষণ শেফালির মনোতালা সৌরভ শুচি শুদ্ধতার মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেবী বন্দনার উপযোগী করে তুলছে ধরিত্রী দেবালয়ের চারপাশ। ফুলপত্রাদিতে অঞ্জলি সাজ এবং ঢাক ডঙ্কা ও কাঁসর ধ্বনিতে মঙ্গলবারতা কিংবা অশুভ নাশের আগাম আবহ বিরাজ করছে। অসুর বিনাশীরূপে রাঙা হচ্ছেন দেবী প্রতিমা। চক্ষুদান ও অস্ত্র হাতে সুসজ্জিত রূপ ধারণের মাধ্যমে মর্ত্যে আবির্ভূত হবেন দুর্গতিনাশিনী দেবী মূর্তি। তিনি সকল অন্যায়, অনাচার, অবিচার, অধর্ম নাশ করে পৃথিবীর বুকে সংস্থাপন করবেন সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি। এই মোদের প্রার্থনা দেবী দুর্গা বরাবরে। প্রতিবারের ন্যায় এবারও ঘোটকে চড়ে দেবী আসছেন মর্ত্যলোকে পূজিত হতে। তিনি মনুষ্যতৈরি প্রতিমার দিব্য আড়ালে থেকে গ্রহণ করবেন ভক্তকুলের ভক্তি অর্চনা। তাতে তুষ্ট হয়ে হয়ত দান করবেন আশিস কৃপা। কিন্তু মনু সভ্যতা আজ যে অসুরিকতার স্পর্শে মুমূর্ষুপ্রায়, সেই ভগ্নদশা পরিত্রাণে দুর্গতিনাশিনী কতটুকু ভূমিকা পালন করবেন? না, বছরের পর বছর এভাবে পূজিত হবেন আর মাটির তৈরি মূর্তি অন্তরালে থেকে বিদায় নেবেন এ মানব ধরা থেকে! আজ মানব সমাজে সৃষ্ট অসত্য, অসুন্দর, অসুর শক্তির মনুষ্য অত্যাচারে সর্বদা শুভ, সত্য, সুন্দরের পক্ষাবলম্বনকারী মানুষেরা যেভাবে অসন্তুষ্টির হাঁক তুলছেন, তাতে আদ্যাশক্তি মহামায়ার অলৌকিক জাগরণ অপরিহার্য। হে জগজ্জননী তুমি থেক না আর প্রতিমার আড়ালে লুকিয়ে। নিপীড়িত ভক্তের ভক্তি অর্চনায় সাড়া দিয়ে নেমে এসো এই অত্যাচারী অঙ্গনে। তোমার অসুর বিনাশী খড়গে ধ্বংস করে দাও রাষ্ট্র, সমাজ, পৃথিবীর যত জঞ্জাল, আপদ। স্বর্গে শান্তি সংস্থাপনের দেবী উপাখ্যান আমাদের মাঝে বসবাস করা অসুর প্রবৃত্তিপনার মানুষগুলোকে কি শিক্ষা দিতে পেরেছে। জোরজবরদস্তি-লুটপাট, হত্যা-খুন, রক্তপাত, উগ্রবাদ, দুর্নীতি তথা স্বার্থ হাসিলের এই অশুভ লগ্নে দেবীর আশিস সান্নিধ্য পেতে তাই তাঁর সম্মুখে দাঁড়িয়ে মোরা সমবেত কণ্ঠে করি স্তব- ‘হে দেবী, তুমি জাগো, তুমি জাগো, তুমি জাগো। তোমার আগমনে এই পৃথিবীকে ধন্য কর। কলুষতা মুক্ত কর। মাতৃরূপে, বুদ্ধিরূপে, শক্তিরূপে আশীর্বাদ কর পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে। বিনাশ কর আমাদের অসুর প্রবৃত্তিকে।’ পৃথিবীতে যখন অসুরিক শক্তির উত্থান ঘটে তখন মহামায়া আদ্যাশক্তির আবির্ভাবে সকল অমঙ্গল পরাভূত হয়, ফিরে আসে শান্তি। যুগে যুগে মহিষমর্দিনী দেবী দুর্গা বিভিন্ন রূপে আবির্ভূত হয়েছেন, ধ্বংস করেছেন অশান্ত অসুরদের অত্যাচারী ক্ষমতা। ভক্তের প্রয়োজনে জগজ্জননী দেবী কখনও দুর্গা, কখনও মহামায়া, কখনও পার্বতী, কখনও চ-ি, কখনও কালিকা, কখনও বৈষ্ণবী রূপে অবতীর্ণ হন এ ধরা মাঝে। নানা নামে নানা রূপে দেবী দুর্গা রক্ষা করেছেন তাঁর অনুগত ভক্তদের। পৌরাণিক পত্রে তার বিরল বর্ণনা রক্ষিত আছে। যুগে যুগে তিনি আধ্যাত্মিক শক্তির বিকাশ ঘটিয়েছেন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, সৃষ্টিলগ্নে কৃষ্ণ সর্বপ্রথম দুর্গাপূজা করেন। মধু ও কৈটভ নিধনে দেবীর দ্বিতীয়বার আরাধনা করেন ব্রহ্মা। ত্রিপুরাসুরকে যুদ্ধে পরাজিত করতে তৃতীয়বারের মতো দুর্গাপূজা করেন যুদ্ধবিপন্ন মহাদেব। পরে দুর্বাসা মুনির শাপে অভিশপ্ত হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র যে পূজা করেছিলেন সেটা চতুর্থ দুর্গোৎসব। এছাড়া ভাগবত অনুসারে ব্রহ্মা ও ইন্দ্রের মতো ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু পৃথিবীর শাসনক্ষমতা পেয়ে ক্ষীরোদ তীরে মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মাণ করে দেবী দুর্গার প্রার্থনা করেন। রামায়ণে বর্ণিত আছে, লঙ্কাপতি রাবণ ধ্বংসে শ্রীরামচন্দ্র দেবী দুর্গার শরণাপন্ন হয়েছিলেন। রামচন্দ্রের মঙ্গলার্থে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা জানালেন, দুর্গাপূজাই কল্যাণের একমাত্র উপায়। সেই পূজায় রামের পক্ষে ব্রহ্মা স্বয়ং যজমানি করলেন। তখন ছিল শরতের দক্ষিণায়ন। দেবতাদের নিদ্রিত সময়। ব্রহ্মার আরাধনায় জাগ্রত হলেন দেবী দুর্গা। তিনি উগ্রচ-িরূপে জাগ্রত হলে ব্রহ্মা বললেন, ‘অত্যাচারী রাবণ বিনাশে রামচন্দ্রকে অনুগ্রহ করার জন্য তোমাকে অসময়ে জাগিয়ে তুলেছি। যতদিন না রাবণ বধ হয়, ততদিন তোমার পূজা করব। যেমন করে আমরা আজ তোমার বোধন করে পূজা করলাম, তেমন করেই মর্ত্যবাসী যুগ যুগ ধরে তোমার পূজা করে যাবে। যতকাল সৃষ্টি থাকবে, এভাবেই তুমিও পূজা পাবে।’ এ কথা শুনে চ-িকারূপী দেবী দুর্গা বললেন, ‘সপ্তমী তিথিতে আমি রামের ধনুর্বাণে প্রবেশ করিব। অষ্টমী তিথিতে হবে রাম-রাবণের মহাযুদ্ধ। অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে রাবণের দশমু- বিচ্ছিন্ন হবে। সেই দশমু- আবার জোড়া লাগবে। কিন্তু নবমীতে রাবণ হবে নিহত। দশমীতে রামচন্দ্র করবেন বিজয়োৎসব।’ শ্রীরামচন্দ্রের সেই বিজয়োৎসব আজ আমাদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা বিজয়া দশমীতে বিজয়ের আনন্দে রঙিন হই। যেহেতু রামচন্দ্র অসময় অর্থাৎ অকালে ঘুমন্ত দেবীকে জাগিয়ে পূজার্চনা করেছিলেন, সেহেতু তাঁর অকাল বোধন বঙ্গদেশে প্রচার পেয়ে আজ শারদীয় দুর্গোৎসবে রূপ নিয়েছে। আদ্যাশক্তি দুর্গার কাহিনী বলে শেষ করা যাবে না। তাঁর দুর্গতিনাশিনী শক্তির অপার মহিমায় দেবকুল অসুর অত্যাচার থেকে বারবার মুক্ত হয়েছে। দুর্গা ও দুর্গাপূজা সম্পর্কিত কাহিনীগুলোর মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় দেবীমাহাত্ম্যম-এ বর্ণিত কাহিনীটি। এর কাহিনী অনুসারে, দেবী দুর্গা তাঁর দিব্য শক্তি দ্বারা ধ্বংস করেছিলেন দুর্দ- পরাক্রমশালী মহিষাসুরকে। সেখানে বর্ণিত আছে, পুরাকালে মহিষাসুর দেবগণকে দীর্ঘযুদ্ধে পরাজিত করে স্বর্গের রাজত্ব কেড়ে নিলে অসুর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল পৃথিবী। স্বর্গ থেকে বিতাড়িত অসহায় দেবতারা প্রথমে প্রজাপতি ব্রহ্মা এবং পরে শিব ও নারায়ণের দ্বারস্থ হন। অত্যাচারী মহিষাসুরের উৎপীড়ক কথা শুনে তাঁরা উভয়েই ক্ষুব্ধ হন। সেই ক্রোধে তাদের মুখম-ল ভীষণাকার ধারণ করে। তদ্রƒপ স্বর্গচ্যুত ইন্দ্র দেবতাদের দেহ থেকেও অতিশয় তেজ নিঃসৃত হয়ে মহাতেজে রূপান্তরিত হয়। হিমাদ্রি স্থিত ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে সেই বিরাট তেজপুঞ্জ একত্রিত হয়ে এক নারীমূর্তি অর্থাৎ দুর্গারূপ ধারণ করেন। পরে দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধের মাধ্যমে দেবতাদের স্বর্গ ফিরিয়ে দিয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে দিলেন শান্তির পরশ। তাই তাকে বলা হয় দেবী দুর্গতিনাশিনী। দেবী দুর্গা শক্তির প্রতীক হিসেবে পরিচিত। চ-িতে দেবীর স্তবে বলা হয়েছে ‘স্বর্গাপবর্গদে দেবী নারায়ণি নমোস্তুতে’। অর্থাৎ, স্বর্গলাভ ও মুক্তির জন্য হে দেবী নারায়ণি, আমি তোমাকে প্রণাম জানাই। আধ্যাত্মিক ভাবনায় নির্মিত দেবী কাঠামোতে দেবীর সঙ্গে যাঁরা আছেন তারা একেকটি অর্থ বা গুণ বহন করে চলেছেন। দশভুজা দেবী দুর্গার প্রতিটি হাত শক্তি ও অশুভ নাশের অন্যতম প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত। দুর্গার দশহাত দশ দিক রক্ষার নিদর্শন। দেবী ত্রিগুণাত্মিকা শক্তির অবয়ব অর্থাৎ সত্ত্ব, রজঃ তমঃ গুণের প্রতীক। দেবী ত্রিণয়নী-একটি নয়ন চন্দ্রস্বরূপ, একটি সূর্যস্বরূপ এবং তৃতীয়টি অগ্নিস্বরূপ। তাঁর ত্রিণয়নের ইঙ্গিতেই নিয়ন্ত্রিত হয় ত্রিকাল। দেবী সিংহবাহনা-তামসিক পশুশক্তির অধিপতি পশুরাজ সিংহ। মহিষাসুর-দেহস্থ প্রবল রিপুর প্রতীক। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য এর ঘনীভূত মূর্তি মহিষাসুর। শিব-সর্বোপুরি অধিষ্ঠিত শিব মঙ্গল ও স্থিরত্বের প্রতীক। দেবীর ডানপার্শ্বে উপরে লক্ষ্মী-ধনশক্তি বা বৈশ্যশক্তির, গণেশ-ধনশক্তির বা শুদ্র শক্তির, সরস্বতী-জ্ঞানশক্তি বা ব্রহ্মণ্য শক্তির, কার্তিক ক্ষত্রিয় শক্তির প্রতীক। এই শক্তিসমূহ মূলত বিশ্বাস ও অনুভূতির জায়গা দখল করে আছে। যার কোন আকার নেই। মানুষের বোঝার সুবিধার্থে দেয়া হয়েছে এই প্রতিমারূপী আকার। দেবী মহামায়ার এ সকল শক্তিই ব্রহ্মশক্তি। ভক্তের মঙ্গলার্থে ব্রহ্মের নানা রূপ কল্পনা মাত্র। দশ হাতে দশ রকম অস্ত্রসজ্জিত দেবীর ডান হাতে ত্রিশূল, খড়গ ও চক্র; বাম হাতে শঙ্খ, ঢাল, কুঠার, ঘণ্টা। দুর্গাদেহ-দুর্গের মহাশক্তি। উপাসক উপাসনাকালে দেবীর দৈবশক্তিকে জাগ্রত করেন। সে সময় দেবশক্তি ও রিপু তথা আসুরিক শক্তির মধ্যে বাঁধে সংঘর্ষ। সেই অন্তর জগতের সংঘর্ষের একটি প্রতীকী রূপই রূপায়িত হয়েছে। শ্রীশ্রী দুর্গাপূজার মূল মন্ত্র হচ্ছে- ‘যা দেবী সর্বভুতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা।/ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।/ যা দেবী সর্বভুতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা/ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ। [email protected]
×