ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

উন্নয়নে নারীর পারিবারিক শ্রমের আর্থিক স্বীকৃতি জরুরী

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ১৬ অক্টোবর ২০১৮

উন্নয়নে নারীর পারিবারিক শ্রমের আর্থিক স্বীকৃতি জরুরী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পরিবার, সমাজ তথা অর্থনীতিতে নারীদের অনেক অবদান থাকলেও স্বীকৃত না হওয়ার কারণে পেছনেই থাকছেন নারীরা। কৃষি, মৎস্য, বনায়ন, গবাদিপশু পালনসহ বিভিন্ন ধরনের শ্রমে অবৈতনিকভাবে জড়িত। এই কাজগুলোকে পারিবারিক শ্রম হিসেবে গণ্য করা হয় যা অবৈতনিক এবং আর্থিক মূল্যবিহীন। শ্রম শক্তি জরিপের হিসেবে দেশের ১ কোটি ২০ লাখ নারী শ্রমিকের মধ্যে ৭৭ শতাংশই গ্রামীণ নারী। অদৃশ্য শ্রমের আর্থিক মূল্য না থাকায় নারীকে পরিবার ও সমাজেও অবমূল্যায়িত হতে হচ্ছে। উপেক্ষিত ও অবহেলিত থাকছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও। এই অবস্থা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দেশের সার্বিক আর্থসামাজিক উন্নয়নে নারীর পারিবারিক শ্রমের আর্থিক স্বীকৃতি জরুরী বলে জানিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। বিশিষ্টজনদের মতে, বিদ্যমান সমাজ কাঠামো, প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কৃষিতে নারীর অবদানকে অবহেলা করার সাধারণ প্রবণতাই এর জন্য দায়ী। সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবে আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস উপলক্ষে উইমেন জার্নালিস্ট নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ (ডব্লিউজেএনবি) এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত অর্থনীতিতে গ্রামীণ নারীর অবদান শীর্ষক আলোচনায় বক্তারা স্বীকৃতির দাবি করেন। প্রতিবছর ১৫ অক্টোবর আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস পালিত হয়ে থাকে। জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মোঃ শাহ আলমগীর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডব্লিউজেএনবি সহ-সভাপতি ও নিউজ টোয়েন্টিফোরের প্রধান বার্তা সম্পাদক শাহ্নাজ মুন্নী। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ডব্লিউজেএনবি সাধারণ সম্পাদক আঙ্গুর নাহার মন্টি। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী অর্থনীতি গড়তে হলে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ থাকতে হবে। নারীকে বাদ দিয়ে সমাজ এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। অর্থনীতিতে এবং গণতান্ত্রিক সমাজে নারীর ক্ষমতায়নের ঘাটতি পূরণ করতে হবে। বতর্মান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা লিঙ্গ বৈষম্যমূলক সমাজ গড়ব। মন্ত্রী বলেন, আমাদের স্কুল লেবেলে শিক্ষার ক্ষেত্রে সমতা ঠিক আছে তবে উচ্চ লেবেলে গিয়ে মেয়েরা অনেক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পরে। বিশ^বিদ্যালয়ে গিয়ে আরও কমে যায়। এই পিছিয়ে পড়া থেকে আমরা ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠতেছি। গ্রামীণ গণমাধ্যমের ক্ষেত্র হয়েছে। কমিউনিটি রেডিও তথা উপজেলা থেকে অনলাইন প্রিন্ট মিডিয়ায়ও এখন নারীরা কাজ করতে পারছে। কৃষি-অকৃষি, ক্ষুদ্র কুটির শিল্পসহ সব ক্ষেত্রেই নারীর ভূমিকা আছে। সমতা আানতে গেলে তথ্য প্রযুক্তিতেও নারীদের ধারণা থাকতে হবে বলে জানান তথ্যমন্ত্রী। কেননা ডিজিটাল জ্ঞান না থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে যাবেন বলে জানান তিনি। মন্ত্রী বলেন, যদিও গ্রামে বহুমুখী বিকাশ হচ্ছে তবুও নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথ সম্মানিত নয় এবং শ্রমের ক্ষেত্রে মজুরিও কম পায়। দেশ সমৃদ্ধ হচ্ছে দারিদ্র কমছে কিন্তু বৈষম্য কমছে না। সম্পদে, বাজারে, ক্ষমতায়নে এবং মানব সম্পদে এই চারটি জায়গায় কাজ করতে হবে তবেই বৈষম্য আরও কমে যাবে। সরকার সেটি করে যাচ্ছে। গত ১০ বছরে শেখ হাসিনার সরকার নারীদের টেনে অনেক ওপরে নিয়ে এসেছেন উল্লেখ করে বলেন, যেখানে যে ঘাটতি আছে সরকার আরও সচেষ্ট হবে বলে আমি আশা করছি। অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের ডিজিটাল আইন নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তথ্যমন্ত্রী সম্পাদক পরিষদের তথ্যের ঘাটতি আছে। আমরা তাদের বলেছিলাম, তাদের যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাগুলো আছে মন্ত্রিপরিষদের সভায় উত্থাপন করব। কিন্তু অমুক সভায় উত্থাপন করব এটা কিন্তু বলিনি। তিনি আরও বলেন, মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। হাসানুল হক ইনু আরও বলেন, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, এই আইন হচ্ছে শিশুদের নিরাপত্তার জন্য, সাইবার অপরাধীদের জন্য, হ্যাকারদের জন্য ও ডিজিটাল সমাজের নিরাপত্তার জন্য। গণমাধ্যমের কিংবা গণমাধ্যম কর্মীদের বিরুদ্ধে এই আইন না। এই আইনে আমরা কোন জায়গায় গণমাধ্যম কর্মীর বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখিনি। এরপরও যদি কোন আলোচনা থাকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কিংবা মন্ত্রণালয় আলোচনা করে দেখবে। অনুষ্ঠানে পিআইবি’র মহাপরিচালক মোঃ শাহ আলমগীর বলেন, কাজের মূল্য আছে অনেক ক্ষেত্রে আমরা বুঝি। আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। পঞ্চগড়ের অনেক মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যায় আবার অনেক এলাকায় এটিকে ভালভাবে নেবে না। এক জায়গায় হবে অন্য জায়গায় মেনে নেবে না এটা থেকে বের হতে হবে। প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, আমাদের গণমাধ্যমেও গ্রামীণ নারীদের কর্ম নিয়ে তেমন বিশেষ কিছু দেখি না। তবে গ্রামে গেলে দেখা যায় কিভাবে নারীরা কষ্ট করছে। বীজতলা তৈরি থেকে চারা রোপণ ধান সিদ্ধ, মাড়াই সব কাজে নারীর হাত। শুধু মূল্যায়নের ক্ষেত্রে নারীর নাম নেই। শহর বা গ্রাম সবখানেই নারীকে কাজের মধ্যে থাকতে হয়। কর্মজীবী নারীকেও সারাদিনের কাজ শেষে ঘরে ফিরে সবার আগে রান্না ঘরের খোঁজ নিতে হয়। যা পুরুষ করে না। সবার সমান কাজে অংশগ্রহণ থাকা উচিত বলেও জানান ফরিদা ইয়াসমিন। তিনি আরও বলেন, নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। থাকতে হবে কাজের স্বীকৃতিও। মূল প্রবন্ধে শাহ্নাজ মুন্নী বলেন, গ্রামীণ নারী বলতে আমাদের সামনে ভেসে উঠে আটপৌরে সস্তা শাড়ি পরা একটা অতি সাধারণ পরিশ্রমী মুখ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেও যিনি সমাজ সংসারে উপেক্ষিত। গবেষণার তথ্য উদ্বৃতি দিয়ে বলা হয় কৃষি খাতের ২০টি কাজের মধ্যে ১৭টি কাজেই নারী অংশগ্রহণ করে। বীজ সংরক্ষণ থেকে শুরু করে ফসল উৎপাদন, মাড়াইকরণ, ধান সিদ্ধ, শুকানো সবই হয় নারীর হাতে। ধান চাষী হিসেবে পুরুষের স্বীকৃতি থাকলেও চাল প্রস্তুতকারী হিসেবে নারীর ভূমিকার কোন স্বীকৃতি নেই। অথচ ২০০৮ সালের বিশ^ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে কৃষি খাতে নিয়োজিত পুুরুষের চেয়ে নারীর অবদান ৬০-৬৫ শতাংশ বেশি। মূল প্রবন্ধে বলা হয়, কৃষিখাতে দিনমজুর হিসেবে হতদরিদ্র নারীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। সেখানে মজুরি বৈষম্য রয়েছে। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেও নারী শ্রমিক পুরুষের সমান মজুরি পায় না। জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর অবদান নিরূপণ এ গবেষণা তথ্যে ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সের একজন নারী সমবয়সী পুরুষের তুলনায় প্রায় তিনগুণ সময় কাজে নিয়োজিত থাকলেও জিডিপিতে ধরা হয়নি। একজন নারী প্রতিদিন গড়ে ১২.১টি মজুরিবিহীন কাজ করে যা জিডিপিতে যোগ হয় না। পুরুষের ক্ষেত্রে এ ধরনের কাজের সংখ্যা ২.৭টি। নারীর অবমূল্যায়িত কাজের অংশ জাতীয় অর্থনীতিতে যোগ করলে জাতীয় উৎপাদনে নারীর অবদান ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪০ শতাংশ হয়ে যাবে বলেও সে গবেষণায় বলা হয়। মূল প্রবন্ধে আরও বলা হয়, অর্থনৈতিক অধিকার নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম পূর্বশর্ত। এই অধিকার নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সহায়ক হিসেবে কাজ করে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন একটি বড় অর্জন এটি স্বীকার করতে হবে। খাদ্য উৎপাদন তথা অন্যান্য কাজের ক্ষেত্রে যেখানে অধিকাংশই যেখানে গ্রামীণ নারীর ভূমিকা রয়েছে সে কাজের স্বীকৃতিও থাকতে হবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আমি মনে করি গ্রামীণ নারীকে দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। যার একটি হবে নারী শ্রমিক এবং অন্যটি গ্রামীণ নারী যারা নানা উৎপাদনশীল কাজে জড়িত। তিনি বলেন, আমাদের দেশে নারী শিক্ষার হার বেড়েছে। অনেক নারীর চাকরিতে অংশগ্রহণ বেড়েছে। কিন্তু দেশের অধিকাংশ নারীই চাকরি করবে না। তাদের পর্দার আড়ালের কাজকেও স্বীকৃতি দিতে হবে।
×