ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নূহ-উল-আলম লেনিন

দুর্গা এবং বাংলায় মাতৃতান্ত্রিকতা

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ১৭ অক্টোবর ২০১৮

দুর্গা এবং বাংলায় মাতৃতান্ত্রিকতা

সার্বজনীন দুর্গোৎসব সনাতন ধর্মানুরাগী বাঙালীর শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় উৎসব। দুর্গার প্রসঙ্গটি পুরাণে, শাস্ত্রে, ইতিহাসে, মিথোলজিতে এবং হরপ্পা সভ্যতার আবিষ্কৃত টেরাকোটা মূর্তির সুবাদে দুর্গার ধারণাটি প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। কিন্তু ব্যাপকভাবে পূজা এবং তা সার্বজনীন হয়ে ওঠার ইতিহাস কিন্তু খুব বেশি দিনের নয়। গত বছরের শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকায় এ প্রসঙ্গে আমি বিস্তারিত লিখেছিলাম। এবারে একটা ভিন্ন প্রসঙ্গের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। সাধারণভাবে ইতিহাসবিদ ও সমাজতত্ত্ববিদগণ সমাজ সভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাস প্রসঙ্গে প্রায় সকলেই একমত যে, সভ্যতার সূচনায় আমাদের সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। লুইস হেনরি মর্গান, ফ্রেডারিক এঙ্গেলস ও কালমার্কস ছাড়াও অন্যান্য মনীষী সমাজবিজ্ঞানী এবং গবেষকগণ দেখিয়েছেন সভ্যতার ঊষালগ্নে মানব-মানবী অর্থাৎ নারী-পুরুষের মধ্যে মর্যাদার কোন পার্থক্য ছিল না। তবে আদিম বন্য মানুষ যখন শিকারের যুগ পেরিয়ে পশু পালনের যুগে প্রবেশ করে, তখন শারীরিক শক্তি এবং সন্তান ধারণ, লালন ও পালন করতে না হওয়ায় পুরুষের আপেক্ষিক প্রাধান্য ও স্বাধীনতা একটু বেশি ছিল। তবে সমাজে যেহেতু তখনও খাদ্যের বা সম্পদের উদ্বৃত্ত সঞ্চয় ছিল না, সে কারণে একদিকে যেমন ধন বৈষম্য বা শ্রেণিভেদ দেখা দেয়নি, অন্যদিকে নারী-পুরুষের সমান অধিকারেরও তেমন একটা ব্যত্যয় ঘটেনি। আদিম কৃষি সভ্যতা এই দৃশ্যপট বদলে দেয়। মানুষ যখন যাযাবর জীবনের অবসান ঘটিয়ে নির্দিষ্ট এলাকায় স্থায়ী বসতি স্থাপন এবং পরিবারের সৃজন করে, প্রকৃত সভ্যতার শুরু তখন থেকে। সামাজিক শ্রমবিভাজনের জন্যই পুরুষরা প্রধানত চারণক্ষেত্রে পশুপালন ও শিকারে ব্যস্ত থাকত। নারী ব্যস্ত থাকত ঘর গৃহস্থালি এবং সন্তান লালন-পালনে। এই সুযোগে নারী পারিবারিক জীবনে বেশ কিছুটা অবসর যাপনের এবং অবসর সময়টি কাজে লাগানোর সুযোগ পায়। মর্গান ও এঙ্গেলসের মতে, নারী তার ‘অবসর’ সময়টি কাজে লাগিয়ে কৃষি সভ্যতার সূচনা করেন। সমাজে একসময় কৃষি কাজই সামাজিক উৎপাদনের প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়ায়। নারী যেহেতু কৃষির বিকাশে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন, সে কারণে প্রধান উৎপাদিকা শক্তি হিসেবে নারীর সামাজিক কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পায়। ক্রমে আদিম ‘কৌম সমাজ’ এক ধরনের মাতৃতান্ত্রিক সমাজে রূপান্তরিত হয়। পরে অবশ্য শারীরিক সামর্থ্য ও কৃষিতে অধিকতর শ্রমের প্রয়োজনে নারীর প্রাধান্য খর্ব হয় এবং পুরুষতন্ত্র মাতৃতন্ত্রের স্থলাভিষিক্ত হয়। সভ্যতার সূচনায় মাতৃতান্ত্রিকতার প্রপঞ্চটি প্রায় বিশ্বজনীন। নারীর সন্তান ধারণ এবং তার প্রজনন ক্ষমতা আদিম সমাজে একটা বিস্ময়কর ব্যাপার হিসেবে মনে করা হতো। আর এ কারণে প্রাচীন সমাজে নারীর বন্দনা নারীকে সৃষ্টিরূপে দেবী হিসেবে কল্পনা করে। মাতৃদেবীর পূজা প্রায় প্রতিটি আদিম সমাজের বৈশিষ্ট্য হিসেবে স্বীকৃত। পৌরাণিক আখ্যানগুলোতে দেবী মাহাত্ম্যের বর্ণনা এবং ভক্তিরস মাতৃতন্ত্রের স্মারক হিসেবে আজও লক্ষণীয়। ভারতবর্ষে প্রাক-আর্য যুগেও মাতৃপূজার ব্যাপক প্রচলন ছিল। কিন্তু পুরুষতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান শক্তিশালী হয়ে ওঠা এবং ধর্মের উৎপত্তি বা প্রচলন প্রধান প্রধান দেবীকে সামনের সারি থেকে দ্বিতীয়-তৃতীয় সারিতে নামিয়ে আনে। সুমেরিয়া, মিসর, গ্রীস, প্রাচীন ভারত- সর্বত্রই একই চিত্র দেখা গেছে। দেবী দুর্গা আদ্যাশক্তি হিসেবে ভারতীয় সমাজে বিশেষ করে বাংলায় পরম ভক্তি ও বিশ্বাসে পূজিত হয়ে আসছেন। দেবী দুর্গা সৃষ্টি ও শক্তির প্রতীক। শক্তির দ্যোতক শাক্তধর্ম বাংলায় একসময় প্রবল হয়ে উঠেছিল। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তার ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘শাক্ত পুরাণসমূহের সৃষ্টিতত্ত্ব অনুযায়ী স্বয়ং আদ্যাশক্তিই সৃষ্টি, স্থিতি, লয়ের প্রতীক স্বরূপ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে সৃষ্টি করেন। এই আদ্যাশক্তি বা শক্তিতত্ত্বের মূল সুপ্রাচীন যুগের মানুষের জীবনচর্যার মধ্যে নিহিত। আদিম চেতনায় নারী শুধুমাত্র উৎপাদনের প্রতীকই নয়, সত্যিকারের জীবনদায়িনীর ভূমিকাও তারই। সামাজিক বিবর্তনের প্রাথমিক স্তরগুলোতে তাই এই মাতৃত্বের ভূমিকাই ছিল প্রধান, জীবনদায়িনী মাতৃদেবীই ছিলেন ধর্ম জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। এই নারী শক্তির সঙ্গে পৃথিবীর, মানবীয় ফলপ্রসূতার সঙ্গে প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতার, সমীকরণ সাংখ্য ও তন্ত্রোক্ত প্রকৃতির ধারণার উদ্ভবের হেতু, যা থেকে পরবর্তীকালে শক্তি তত্ত্বের বিকাশ ঘটে। পৃথিবীর সর্বত্রই আদিম কৃষিজীবী কৌম সমাজে ধরণীর ফলোৎপাদিত শক্তির সঙ্গে নারী জাতির সন্তান-উৎপাদিকা শক্তিকে অভিন্ন করে দেখার রীতি ছিল।’ শক্তিতত্ত্বে নারীই সর্বত্র শক্তির দ্যোতক এবং পূজিতা। বাংলায় প্রাচীন প্রাক-আর্য কৃষিজীবী সমাজে যে সামাজিক শক্তি হিসেবে নারীর প্রাধান্য ছিল শাক্তধর্ম তারই পরিচায়ক। প-িতগণ মনে করেন আর্য শৈব মতকে অবলম্বন করেই শাক্ত মত গড়ে ওঠে। শৈব ও শাক্ত ধর্মের পার্থক্য হচ্ছে শৈব ধর্মে শক্তির দ্যোতক পুরুষ (শিব) এবং শাক্তে প্রকৃতি বা নারী। বাংলার আদিম কৃষিভিত্তিক সমাজ এবং আর্র্য-অনার্য সংশ্লেষণের ধারায় মাতৃতান্ত্রিকতার সঙ্গে পিতৃতান্ত্রিকতার এক ধরনের সম্মিলন ঘটে। শাক্ত ও শৈব তত্ত্বগুলো মূলত অভিন্ন। গুপ্ত যুগে শিবতত্ত্ব ও শক্তিতত্ত্বের মধ্যে স্থায়ী যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। পুরাণ বা সাহিত্য ছাড়াও এই সংযোগের পরিচয় পাওয়া যায় ভাস্কর্য থেকে। উমা-মহেশ্বর ও কল্যাণ-সুন্দর মূর্তিসমূহ এর সাক্ষ্য বহন করে। শৈব মতের মূল কথা চরম সত্ত্বা ব্রহ্ম বা শিব একই সঙ্গে বিশ্বময় ও বিশ্বাতীত। যিনি বিশ্বময় তিনি শক্তি, যিনি বিশ্বাতীত তিনি শিব। শিব ও শক্তি কোন পৃথক সত্তা নয়, শক্তি সর্বদাই শিবের সঙ্গে অভিন্ন, অগ্নি ও তার দাহিকা শক্তির মতো (শিবদৃষ্টি ৩/৭) শক্তি শিবের ঐশ্বৈর্য, হৃদয় এবং সার (ঈশ্বর প্রত্যভিজ্ঞা ১/৫/১৪)।’ এখানে শৈবধর্মের সঙ্গে শাক্তধর্মের সংশ্লেষণ সুস্পষ্ট। ভারতীয় সমাজে প্রাচীন মাতৃতন্ত্রের সঙ্গে পুরুষতান্ত্রিক আর্যধর্মের এই দেয়া-নেয়া ও সংশ্লেষণ হাজার হাজার বছর ধরে চলেছে। সে কারণে বর্ণাশ্রমবাদী বৈদিক ধর্ম তাদের ধর্মমতকে সার্বজনীন এবং সর্বভারতীয় অর্থাৎ আর্য-অনার্যের কাছে অভিন্ন পূজনীয় করার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে গাত্রবর্ণে অনার্য কালো বা শ্যাম বর্ণে এবং শক্তিরীপিণী দুর্গাকে কালো বর্ণের কালী রূপে উপস্থাপন করেছে। আমরা দুর্গা ও মাতৃতান্ত্রিকতা প্রসঙ্গে ফিরে আসি। দুর্গা কে? ব্যুৎপত্তিগতভাবে দুর্গা শব্দটিকে সংস্কৃত শ্লোকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছে, তা হলো- দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্তিতঃ। উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত ॥ রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ। ভয়শত্রুঘ্নবচনশ্চাকারঃ পরিকীর্তিত ॥ অর্থাৎ ‘দ’ বর্ণটি দৈত্য বিনাশ করে, ‘উ’-কার করে বিঘ্ন নাশ, ‘রেফ’ রোগ নাশ, ‘গ’ বর্ণটি করে পাপ নাশ এবং ‘অ’-কার শত্রু নাশ করে। এর নির্গলিতার্থ হলো, দৈত্য, বিঘœ, রোগ, পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। শ্রীশ্রী চ-ী (নিঃশেষদেবগণশক্তিসমূহমূর্ত্যাঃ), তিনিই দুর্গা। দুর্গা সম্পর্কে সাধারণ ধারণা হলোÑ যিনি দুর্গতি বা সঙ্কট থেকে রক্ষা করেন বা যে দেবী দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেছিলেন, তিনিই দুর্গা। তিনি মহাশক্তিধর ও দুর্গতিনাশিনী। তিনি গিরিজা, তিনিই দুর্গা। তিনি চ-ী, তিনি মহামায়া, তিনি কাত্যায়নী, বৈষ্ণবী, মহিষাসুরসংহারিণী, নারায়ণী, যোগমায়া, অম্বিকা ইত্যাদি। তার রূপেরই অন্য প্রকাশ শ্রীময়ী লক্ষ্মী এবং বিদ্যাধরী সরস্বতী রূপে। তিনি কখনও অষ্টাদশভুজা, ষোড়শভুজা, দশভুজা, অষ্টভুজা ও চতুর্ভুজা। তবে দশভুজা হিসেবেই তিনি বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম এবং প্রবাসী বাঙালী হিন্দুদের মধ্যে পূজিত হন। বাংলা অঞ্চলে প্রাক-আর্য ও আর্য আমলে যে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, দুর্গা যেমন তার প্রতীক; তেমনি অসংখ্য লৌকিক দেব-দেবী, যার অধিকাংশই নারী বা ‘মাতৃরূপ’ প্রমাণ করে আমাদের সমাজের ভিত্তি ভূমি এবং মানসলোক এক সময় ‘মাতৃতন্ত্র’ দিয়ে কতটা প্রভাবিত হয়েছে। মনসা, শীতলা, চ-ী, কালী ছাড়াও বেহুলা লখিন্দর, লক্ষ্মীর পাঁচালিসহ অসংখ্য লৌকিক দেবীর পূজা বাংলায় প্রচলিত। আধুনিক ভারতীয় সভ্যতায় নারীকে অধস্তন এবং ভোগের সামগ্রী হিসেবে দেখানো হয়েছে। নির্মম সতীদাহ প্রথা, বাল্যবিবাহ প্রথা এবং বিধবাবিবাহ নিষিদ্ধকরণ, বহুবিবাহ, বিশেষ করে জাতরক্ষার নামে কুলিন ব্রাহ্মণদের শতাধিক বিয়ে করার মতো মানবতাবিরোধী কর্মকা- একসময় সমাজস্বীকৃত প্রথা হিসেবে বিদ্যমান ছিল। বর্তমানে হিন্দু সমাজে এর অনেক কিছুই রহিত হয়েছে। সমাজ এগিয়েছে। সমাজ সংস্কার হয়েছে, ধর্ম সংস্কার হয়েছে। সমাজ এখন আর মাতৃতান্ত্রিকও নয়। সমাজে, রাষ্ট্রে, পরিবারে পুরুষদের তথা পুরুষতন্ত্রের দোর্দ- প্রতাপ। কিন্তু তা সত্ত্বেও অতীতের ছায়া ও ঐতিহ্যটুকু এখনও অমøান আছে, অন্তত দুর্গাপূজায়। দুর্গাপূজাকে বাঙালী হিন্দুর শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় উৎসব করার পেছনে একদিকে যেমন অতীতের মাতৃতান্ত্রিকতার প্রভাব রয়েছে, তেমনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বঙ্কিমচন্দ্র তাকে শক্তিদায়িনী হিসেবে, মাতৃভূমির প্রতিরূপ কল্পনা করায় আধুনিক বাঙালী হিন্দুর মানসলোকেও তার স্থায়ী প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব এবং স্বামী বিবেকানন্দও শক্তিরূপেণ বন্দনার পুনর্জাগরণ ঘটান। সব মিলিয়ে পুরুষতন্ত্রও এই এক জায়গায় এসে মাতৃরূপের কাছে মাথা নত করে চলতে বাধ্য হয়। ‘যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা নমোস্তশৈ নমোস্তশৈ নম নমো।’ লেখক : রাজনীতিবিদ, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা
×