ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সম্প্রীতির বন্ধন

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ১৮ অক্টোবর ২০১৮

সম্প্রীতির বন্ধন

উনিশ শ’ একাত্তরে বাঙালী শুধু উপলব্ধি নয়, রক্ত দিয়ে বুঝে নিয়েছিল ধর্ম, বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে তারা এক জাতি, এক প্রাণ। ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলমান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রীস্টান, আমরা সবাই বাঙালী’ বলে গেয়ে উঠেছিল সেদিন। দেশমাতৃকার অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষায় মহান মুক্তিযুদ্ধে সব ধর্মের মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। কাঁধে কাঁধ হাতে হাত রেখে পরস্পর পরস্পরের সহায়তায় এগিয়ে এসেছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালী সেই একাত্তরের পূর্বাপর সময়ে। নজরুলের গান তখন ধ্বনিত হতো, ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।’ হানাদার বাহিনী যখন ধর্মের নামে, বর্ণের নামে, ভাষার নামে, গোত্রের নামে, সম্প্রদায়ের নামে বাঙালী হত্যায় কসাইয়ের মতো অবতীর্ণ হয়েছিল, তখন বাঙালী রুখে দাঁড়িয়েছিল। ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পূর্ণ হোক... বাংলার ঘরে ঘরে যত ভাই-বোন, এক হোক’ বলে রবীন্দ্রনাথ সেই ১৯০৫ সালে গেয়ে উঠেছিলেন সম্প্রীতির বাঁধনকে দৃঢ়তর করার জন্য। পথে নেমেছিলেন রাখি বন্ধনে একতার ঐকতানে। সেই বন্ধন আলগা করার জন্য বহুবার বহু ঝড় এসেছে। বাংলার মাটি ভিজেছে রক্তে। সোনার বাংলা হয়ে উঠেছিল রক্তাক্ত বাংলা। কিন্তু বাঙালীর এক মন এক প্রাণ হয়ে বিজয়ের পতাকা হাতে ছুটে চলা কোন বাধা মানেনি। ধর্ম রক্ষার নামে যারা অধর্মের বিস্তার ঘটিয়েছিল; তাদের পরাজয় ঘটেছে এই বাংলায়। সম্প্রীতির বন্ধন অটুট ছিল বলেই দানবেরা রক্ষা পায়নি। পর্যুদস্ত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে যার যার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করা, ধর্ম বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার যে নীতি নিয়েছিল রাষ্ট্রীয় মূলমন্ত্র হিসেবে। সেই ধর্মনিরপেক্ষতার আবরণ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। যে যার ধর্ম উৎসবের সঙ্গে স্বাধীনভাবে পালন করবে। সেটা নিশ্চিত করা নিয়েই বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে। ধ্বনিত হয়েছে সেই সত্যবাণী; ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। তাই প্রতিটি উৎসবে সকলে এক হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উৎসব পালন করে এ দেশে শত বাধাবিঘœ সত্ত্বেও। শতাব্দী লালিত সম্প্রীতির বন্ধনও কখনও কখনও ক্লেদাক্লিষ্ট হয়েছে এদেশেই পরাজিত শক্তির উত্থানে পঁচাত্তর পরবর্তী সময়কালে। বাংলার ঐতিহ্যেই নিহিত আনন্দমাত্রা অবিমিশ্র নৃতাত্ত্বিক উত্তরাধিক এ জনগোষ্ঠীর। বাঙালীর ইতিহাস অন্তর্ভুক্তি ও বহুত্বের উপকরণে ঋদ্ধ। এ কারণেই ধর্মীয় উৎসব ও অবলীলায় প্রথাসিদ্ধ বৃত্তের বাইরে চলে আসে। সাধারণের অকৃপণ অংশগ্রহণে উৎসব সার্বজনীনতায় রূপ পায়। আধ্যাত্মিকতা ক্রমশ হয়ে পড়ে প্রচ্ছন্ন। উৎসব হয়ে ওঠে প্রবল থেকে প্রবলতর। বাংলা নববর্ষ বর্ষবরণ, চৈত্রসংক্রান্তি, পৌষসংক্রান্তি, নবান্ন, বসন্ত উৎসব নামক লোকজ ঐতিহ্য যুগ পরিক্রমায় বৃহত্তর, মহত্তর উৎসবের বিমূর্ত প্রতীক হয়ে জেগে আছে। যে কোন উপলক্ষই প্রাচীন এ জনপদে উৎসবের আকার ধারণ করে। ঈদ, দুর্গাপূজা, প্রবারণা বা বুদ্ধপূর্ণিমা, বড়দিনের উৎসব ধর্মীয় হলেও তার সার্বজনীন রূপ পরিগ্রহ করে ঐতিহ্যের চিরায়ত ধারায়। উৎসব তখন হয়ে যায় মহামিলনের কেন্দ্র। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিস্ফোরিত জনস্রোতে বাঙালী তার আত্মপরিচয়ের ঠিকানা খুঁজে পায়। বাঙালীর জাতিসত্তা হয়ে ওঠে অনন্য। আর বাঙালী জাতি যেসব অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য বিশ্বসভায় খ্যাত চিন্তায়, চেতনায়, জীবনশৈলীতে কৌলীনের দাবিদার, নিঃসন্দেহে তার পরিমাপক ও জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্গত প্রগতিবাদী, সহনশীল ও উদার মানবিক ঐতিহ্য। যার অনুপস্থিতি বাঙালীর জাতিগত সত্তা সঙ্কটকে প্রকট করে তুলতে পারে। সম্প্রীতির সুধাসিক্ত আঙ্গিনা বাঙালীর পরম আরাধ্য অবশ্যই। জীবনে জীবন যোগ, প্রাণে প্রাণ মেলানো বাঙালীর উৎসবের অনুষঙ্গ বৈকি। ধর্মীয় সম্প্রীতি স্থাপনে বাংলাদেশ বিশ্বজুড়ে এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। শত উস্কানি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, হানাহানির বিপরীতে শান্তি, স্বস্তি, সহৃদয়তা, আন্তরিকতা আর স্নেহ-ভালবাসায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে বাঙালীর জীবন। ধর্মীয় সম্প্রীতির ভেতর বিষবাষ্প যারা ঢেলে দেয় তারা বাঙালীর শত্রু, ধর্মেরও। এসবের বিপরীতে মৈত্রীর বন্ধনকে দৃঢ় করা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। শারদীয় দুর্গাপূজার এ লগ্নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পূজাম-প পরিদর্শনকালে বলেছেনও, এ দেশে যে যার অধিকার নিয়েই বসবাস করবে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলাই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। যাকে লালন করা সঙ্গত। মসজিদে গণশিক্ষা আর মন্দিরে ধর্ম শিক্ষা তার সরকারই চালু করেছে। সম্প্রীতির আবাহনে ধর্মীয় উৎসব পালন হোক নির্বিঘেœ, নিরাপদে। কোন হিংস্র শার্দুল যেন আঘাত হানতে না পারে, সেখানে সচেতন থাকাও জরুরী। সম্প্রীতির বন্ধনে বাংলাদেশের মানুষ দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ থাকবে চিরকালÑ সেই কামনা সবার।
×