ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

যত্নে বাঁচুক প্রবীণ

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ১৮ অক্টোবর ২০১৮

যত্নে বাঁচুক প্রবীণ

যতদিন আমরা আত্মনির্ভরশীল না হই, বাবা-মার কাছ থেকে যতো পারি যেভাবে গ্রহণ করি। তারপর আত্মনির্ভরশীল হয়ে গেলেই বন্ধন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসি। আমরা ভুলে যাই আমাদের জীবনে তাদের একনিষ্ঠ অবদানের কথা। কোন কোন সন্তানকে বাবা-মা বসতভিটে বিক্রি করে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে পাঠান। সেই সন্তান সেখানে গিয়ে তার জীবন টিপটপভাবে গুছিয়ে নেয়, ভুলে যায় দেশে ফেলে আসা বাবা-মায়ের কথা। যে বাবা-মা তার সন্তানদের একটু জ্বর হলেও সারারাত জেগে সেবা করেছেন একসময়, সে বাবা-মাই তাদের মৃত্যুশয্যায় এক ফোঁটা পানি মুখে দেবার জন্য তাদের সন্তানদের পাশে পান না। তবু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা সন্তানদের সুখ কামনা করে যান। মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় হয়ে পড়ে কখন জানেন? যখন সে বৃদ্ধ হয়ে যায়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তার কর্মস্পৃহা শেষ হয়ে যায়, শেষ হয়ে যায় তারুণ্য কিংবা যৌবনে ফেলে আসা সমস্ত উদ্দামতা। একটা সময় শরীর নুয়ে পড়ে বয়সের ভারে, তখন নিজ হাতে খাবারটা মুখে তুলে খাওয়ার মতোও সামর্থ্য থাকে না অনেকের। সে বাবা-মাকে ফেলে আমরা চলে যাই ব্যক্তিগত সুখ সন্ধানে, যে বাবা-মা কিনা একদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাদের রূপকথার গল্প শুনিয়ে, আমাদের পেছনে বাড়িময় ছুটোছুটি করে আমাদের মুখে খাবার তুলে দিত। আমরা কর্মজীবন আর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ি যে, আমরা আমাদের সবচেয়ে কাছের মানুষগুলোকেই দূরে সরিয়ে দেই। আমরা ভুলে যাই, শুধু আমাদের ভাল রাখবার জন্য তারা একসময় তাদের ব্যক্তিগত জীবনের সমস্ত সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করেছিল হাসিমুখে। বৃদ্ধ বয়সে সবাই খুব একা হয়ে পড়ে। আমরা যে যার মতো নিজেদের জীবন নিয়ে মুখিয়ে থাকি। তারা একেকটা দিন গুমড়ে মরে ঘরের কোণে। আমরা তার খবরও রাখি না। অথচ তাদেরও একসময় কত সঙ্গ ছিল, কত রঙিন জীবন ছিল। সে দিনগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে একলা ঘরের কোণে তাদের চশমার কাঁচ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে। আমাদের সময় কই সে খবর রাখার! এতটা একাকীত্বে কাটে তাদের জীবন যে, একসময় তারা প্রার্থনা করতে থাকে রোজ এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার। কতটা অসহায়ত্ত ঘিরে ধরলে মানুষ মৃত্যু কামনা করে, ভাবতে পারেন! আমরা তাদেরকে পরিবারের বোঝা ভাবি, অথচ তারাই যে আমাদের মাথার ছাদ। তাদের শূন্যতাটা ঠিকই বোঝা যায়, যখন তারা আমাদের ছেড়ে চলে যায়। কারণ ছাদ না থাকলেই কেবল বোঝা যায়, আকাশ নামক ছাদের রোদের তীব্রতা কতটা! আজকাল যে এত বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বেড়ে গেছে, কেন জানেন? কারণ আমরা শিক্ষিত হওয়ার নামে অমানুষ হয়ে যাচ্ছি দিনে দিনে। জরিপ করে দেখা গেছে, বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে শিক্ষিত ও কর্মজীবী সন্তানদের বাবা-মা’র সংখ্যাই বেশি। তারা তাদের চাকরি জীবন আর সংসার নিয়ে এতটা হিমশিম খেয়ে যায় যে, তখন পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটাকে তাদের কাছে বাড়তি ঝামেলা মনে হয়। তাই তারা দায়িত্ব এড়াতে তাদের রেখে যায় বৃদ্ধাশ্রমে কিংবা অচেনা কোন অনিশ্চিত জীবনের দিকে ঠেলে দিয়ে চলে যায়। বৃদ্ধ বয়সে তাদের প্রয়োজন হয় সঙ্গ আর বাড়িতে যতœ। কিন্তু আমরা তাদের সঙ্গ তো দেই’ই না বরং আত্মীয় পরিজনহীন ভীষণ নিঃসঙ্গ জীবন চাপিয়ে দেই তাদের ওপর। যতেœর বদলে অনেক অনেক বেশি অবহেলা পান তারা। অথচ আমাদের তারা এতোটুকু অযতœ কিংবা অবহেলার আঁচ লাগতে দেননি কখনও। বাংলাদেশ হোক কিংবা অন্য কোন দেশ হোক, প্রতিটা দেশেই বৃদ্ধ বয়সের জীবনটা খুব ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা আর অবহেলায় কাটে। তাদের প্রতি আমাদের যতœবান হওয়া উচিত, যারা একদিন তাদের জীবনের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে আমাদের যতœ নিয়েছে। আমাদের কাছে বাবা-মা ততদিনই গুরুত্ব পান, যতদিন তারা নিঃস্বার্থভাবে আমাদের জন্য করে যেতে পারেন, যতদিন তারা সামর্থ্যবান থাকেন। যে সময়টাতে তারা অসহায় হয়ে পড়েন, যে সময়টাতে তাদের সবচেয়ে বেশি যতœ প্রয়োজন, যে সময়টাতে তাদের সবচেয়ে বেশি সঙ্গ দেয়া প্রয়োজন, সে সময়টাতেই আমরা তাদের চরম অবহেলায় ছুঁড়ে ফেলে দেই আঁস্তাকুড়ে। যারা নিজেদের সুখ বিসর্জন দিয়ে আমাদের সুখ নিশ্চিত করেছেন, আমরা তাদের বিসর্জন দেই আরও আরও বেশি সুখে থাকার জন্য। দিন শেষে আমরা কি সত্যিই সুখী হই? হোম ইকোনমিক্স কলেজ, ঢাকা থেকে
×