ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

জাফরুল্লাহ ও মইনুল

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৮ অক্টোবর ২০১৮

জাফরুল্লাহ ও মইনুল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধান সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়েই থামছেন না বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী ও জাতীয় ঐক্যের নেতা ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী। নিজেকে ‘গুরুতর অসুস্থ’ দাবি করে ভুল স্বীকারের পর এবার বিএনপিপন্থী এক সংগঠনের সভায় তিনি তার বিরুদ্ধে নেয়া আইনী পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সেনাপ্রধানকে নিয়ে ভুল তথ্য দিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহের কী করেছেন, তাও জানতে চেয়েছেন। এদিকে ডাঃ জাফরুল্লাহর বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ক্ষমতাসীন ১৪ দল। জাফরুল্লার অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরাও। বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘মুভমেন্ট ফর জাস্টিস’ নামের একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে আলোচনার আয়োজন করা হয়েছিল। যে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন ছাত্রদলের সাবেক নেতা সানাউল হক নীরু। আলোচনা সভায় সদ্য সামনে আসা যুক্তফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেনের আসার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তিনি আসেননি। সংগঠনের প্রধান সমন্বয়ক সানাউল হক নীরুর সভাপতিত্বে সভায় ছিলেন ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আরেক নেতা মইনুল হোসেন, আ ব ম মোস্তফা আমিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল প্রমুখ। আলোচনায় অংশ নিয়ে নিজেই সেনাপ্রধানের প্রসঙ্গ আনেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী। আমার শব্দ চয়ণে ভুল হয়েছিল উল্লেখ করে বলেন, এর জন্য তো আমি ক্ষমাও চেয়েছি। কেউ যদি সমালোচনা করে সে কি রাষ্ট্রদ্রোহী? আমি একটা কথা বলেছিলাম কথাতে শব্দের ভুল ছিল। তাই বলে কি আমি রাষ্ট্রদ্রোহিতা করেছি? রাষ্ট্রযন্ত্রের মেরামত প্রয়োজন। আজকে দেখেন আমি একটা কথা বলেছি, কথাটাতে একটা ভুল ছিল। শব্দের ভুল ছিল, শব্দ বিভ্রাট হয়েছে, শব্দ চয়ণে ভুল হয়েছে। তাহলে আমি কি রাষ্ট্রদ্রোহিতা করেছি?’ সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে মিথ্য তথ্য প্রচারকে তিনি সমালোচনা দাবি করে বলেন, আমি যদি কারও সমালোচনা করি..., আমি ভুলটা স্বীকারও করেছি। আমি পরবর্তীতে স্বীকারও করেছি। তার মানে কী? রাষ্ট্র আজকে মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে গেছে। বিএনপিপন্থী এই বুদ্ধিজীবী বলেন, গণতন্ত্র মানে হলো কথা বলার সুযোগ থাকা, সমালোচনা করা, এমনকি ভুল সমালোচনা করলেও তাকে করতে দিতে হবে। ভুল হলে সংশোধন করবে। যেমন আমি করেছি। এটাকে ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক ভাল কাজ করেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, হাসিনা দেশের যথেষ্ট উন্নয়ন করেছে। পদ্মা সেতু করছে। তবে এই সেতু করতে আট হাজার কোটি টাকা লাগার কথা ছিল দাবি করে ঐক্যফ্রন্ট নেতা প্রশ্ন তোলেন কেন সেখানে ৩৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। এই বাড়তি টাকা শেখ হাসিনা নয়, তার চারপাশের চাটুকারদের হাতে বলেও দাবি করেন জাফরুল্লাহ। আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনা হারলে তার যথাযথ বিচার হবে বলেও হুমকি দেন তিনি। বলেন, তাকে জেলে যেতে হবে না। তার যথাযথ বিচার হবে। তিনি জামিন পাবেন। খালেদা জিয়ার উপরে যে অন্যায় অত্যাচার হচ্ছে তার উপরে হবে না। একই বিষয় যদি পুনরাবৃত্তি হয়, তাহলে দেশে শান্তি আসবে কোথা থেকে? জাফরুল্লাহ বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার সমালোচনা করে মইনুল হোসেন বলেন, আমার বন্ধু জাফরুল্লাহ সাহেব একটা ভুল করেছে, ক্ষমাও চেয়েছে। ...এর পরে যা হলো, আমি নিশ্চয়ই বিশ্বাস করি না এটা আর্মি চিফের চিন্তাভাবনা। এটা একটা স্বাধীন দেশ। ঠিক আছে একটা ভুলভ্রান্তি তো হতেই পারে। সেই জন্য দেশদ্রোহী মামলা দিতে হবে, এটা কী কথা? যুক্তফ্রন্ট নেতা মইনুল হোসেন আরও বলেন, কষ্ট লাগে, আজকে মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রদ্রোহী হয়ে গেল? কি কথা একটু সমালোচনা করছে। এটা যেহেতু আমাদেরই সামরিক বাহিনী, একটু আধটু ভুলভ্রান্তি হতে পারে। রাজনীতিবিদদের সম্মানের কথা বলে পাকিস্তান আমলের কথা তুলে ধরে আক্ষেপও করেছেন মইনুল হোসেন। বলেন, পাকিস্তান আমলেও এর চেয়ে ভাল ছিল। মামলা নিয়ে রাজনীতি করা, সেটা পাকিস্তানে ছিল না। পাকিস্তানের আমলে রাজনীতিবিদদের সম্মান করা হতো। কিন্তু এখন অল আর ক্রিমিনালস। যে ক্ষমতায় যায়, অপজিশনকে ক্রিমিনাল কেস দেয়। এ রকম কখনও দেখিও নাই। সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার কথা তুলে বলেন, পাকিস্তান আমলেও তো চিফ জাস্টিসকে স্যাক করে নাই স্বৈরশাসকরা। এদিকে ডাঃ জাফরুল্লাহর বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ক্ষমতাসীন ১৪ দল। সংবাদ সম্মেলনে জোটের মুখপাত্র ও আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, টকশোতে ডাঃ জাফরুল্লাহ সেনাবাহিনীর নামে অসত্য তথ্য দিয়েছেন। তিনি বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। আমরা ১৪ দলের পক্ষ থেকে এর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি করছি। বুধবার ধানম-িতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে জোটের এক বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিম। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে নাসিম বলেন, বিএনপি-জামায়াত নতুন সাথী নিয়ে অযৌক্তিক দাবি তুলে অশুভ চক্রান্ত শুরু করেছে। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে তারা একটি অভিলাষ নিয়ে মাঠে নেমেছে। ১/১১ এর সময় দেশবাসী ড. কামাল হোসেনের ভূমিকা দেখেছে। তিনি তখনকার অনির্বাচিত সরকার সম্পর্কে বলেছিলেন, এই সরকার যত দিন ইচ্ছা চালিয়ে যেতে পারবে। আর ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ’৭৫-এর ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনী মোশতাককে নিয়ে ডেমোক্র্যাটিক লীগ করেছিলেন। এই মইনুল ১/১১ পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন উপদেষ্টা ছিলেন। এখন সেই মইনুল হোসেন, বিএনপি, জামায়াত সব এক হয়ে গেছেন। এরা পরীক্ষিত গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে নাসিম বলেন, তিনি সাংবিধানিক পদে আছেন। সাংবিধানিক পদে থেকে কেউ এ ধরনের কথা বলতে পারেন না। তার পদ ছেড়ে দেয়া উচিত। জাতীয় পার্টির (জেপি) সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলামের সভাপতিত্বে ১৪ দলের এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দীলিপ বড়ুয়া, জাসদের একাংশের সভাপতি শরিফ নূরুল আম্বিয়া, কমিউনিস্ট কেন্দ্রের আহ্বায়ক ওয়াজেদুল ইসলাম খান, ওয়ার্কার্স পার্টি পলিটব্যুরোর সদস্য কামরুল আহসান প্রমুখ। এদিকে সেনাবহিনী ও সেনা প্রধানকে নিয়ে হঠাৎ জাফরুল্লাহর এ তৎপরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। নিজেকে গুরুতর অসুস্থ দাবি করলেও প্রতিদিনই সভা সেমিনার করে বেড়াচ্ছেন বিএনপিপন্থী এ বুদ্ধিজীবী। আবার মিথ্যা তথ্য দিয়ে সমালোচনার মূলে পরলেও একের পর এ বক্তব্য দিয়েই যাচ্ছেন। এ অবস্থান তার বক্তব্যকে পরিকল্পিত বলেই মনে করা হচ্ছে। কিন্তু কী সেই উদ্দেশ্য? বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হলে আরও কয়েক মাস আগে ফিরে যেতে হবে। সেনাপ্রধান হিসেবে তৎকালীন লে. জেনারেল আজিজ আহমেদের নাম বিভিন্ন মহল থেকে যখন শোনা যাচ্ছিল তখন সময় থেকেই তার বিরুদ্ধে শুরু হয় অপপ্রচার। প্রাথমিক অবস্থায় তার পরিবার নিয়ে অপপ্রচার চালিয়ে কোন সুবিধা করতে ব্যর্থ হয়ে ব্যক্তি আজিজ আহমেদের কর্মজীবন নিয়ে বিভিন্ন অপপ্রচার শুরু করে একটি গোষ্ঠী। শিবিরের বাঁশের কেল্লাসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যে সকল পেজ থেকে এ ধরনের প্রোপাগান্ডা প্রচার করা হচ্ছিল তা থেকে স্পষ্ট ছিল, এটি জামায়াতের একটি পরিকল্পনা। অভিযোগ উঠেছে, জামায়াত ও তাদের অন্যতম সহযোগী বিএনপি উদ্দেশ্য-প্রণোদিতভাবে এ ধরনের অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। যাতে সেনা বাহিনীর মতো সুশৃঙ্খল একটি বাহিনী বিব্রত বোধ করে। অন্যদিকে ইতোধ্যেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সময় টেলিভিশনে ডাঃ জাফরুল্লার সঙ্গে একই টকশোতে অংশ নেয়া আলোচকরা। দুই আলোচক জানিয়েছেন, সেনাবাহিনীর মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করে গর্হিত অপরাধ করেছেন ডাঃ জাফরুল্লাহ। আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন বলেন, আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য না জেনে এ ধরনের মন্তব্য করা একটা গর্হিত অপরাধ বলে আমি মনে করি। এতে কেবল সেনাবাহিনীরই নয়, আমাদের জাতীয় ভাবমূর্তি নষ্ট হয় বলে আমি মনে করি। এই বক্তব্যে মনে হতে পারে, আমরা কী সেনাবাহিনী রেখেছি, যে এভাবে গ্রেনেড চুরি হয়ে যায়? স্পর্শকাতর এমন বিষয়ে মিথ্যা তথ্য গণমাধ্যমে উপস্থাপন কোনভাবেই কাম্য নয়। এর দায়িত্বও জাফরুল্লাহ চৌধুরীকেই নিতে হবে। দৈনিক আমাদের নতুন সময়ের সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, উনি কিন্তু মন্তব্য না, উনি একটা তথ্য দিয়েছেন। ভুল তথ্যের উপরে করা যে কোন বিশ্লেষণ ভুল হতে বাধ্য। এটা শুধু অনভিপ্রেত না, এটা একটা অফেন্স। এটা একটা ক্রিমিনাল অফেন্সের পর্যায়ে পড়বেÑ না জেনে কোন তথ্য দেয়া। তিনি আরও বলেন, ডাঃ জাফরুল্লাহ যে তথ্যটি উপস্থাপন করেছিলেন তার একটা পজিশন ব্যাখ্যা করার জন্যÑ এটা ছিল ভুল। যেটা ভুল- সেটা ভুল। ডিনি বলেছেন, এটার দায়িত্ব তাকে নিতে হবে।
×