ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এসেছে হেমন্তলক্ষ্মী

হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধূমল রঙে আঁকা...

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১৮ অক্টোবর ২০১৮

হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধূমল রঙে আঁকা...

মোরসালিন মিজান ॥ একটু নীরবেই শুরু হলো হেমন্ত। শারদীয় দুর্গোৎসবে যখন দারুণ মেতেছে বাঙালী, ঠিক তখনই বিদায় নিয়েছে শরত। কেউ টের পেয়েছেন। কেউ পাননি। এরই মাঝে মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়ে গেছে নতুন ঋতু হেমন্ত। আজ বৃহস্পতিবার তৃতীয় দিন। এরই মাঝে পরিবর্তনের আভাস। বদলে যাচ্ছে প্রকৃতি। মানুষের মনে দেখা দিচ্ছে নতুন ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া। কবির ভাষায়Ñ সবুজ পাতার খামের ভেতর/হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে/কোন্ পাথারের ওপার থেকে/আনল ডেকে হেমন্তকে...। হেমন্তকে, হ্যাঁ, ডেকে আনতে মন চায়। ‘এসো’ ‘এসো’ বলে অপেক্ষা করে থাকেন অনেকে। প্রতীক্ষার অবসান হলো। বছর ঘুরে আবারও এলো প্রিয় ঋতু। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে দুই মাস পর পর রূপ বদলায় প্রকৃতি। সে ধারাবাহিকতায় কার্তিকের প্রথম দিন বাংলায় এসেছে হেমন্তলক্ষ্মী। শীতের বাহন বলা হয় হেমন্তকে। এরই মাঝে কিছুটা ঠা-া অনুভূত হচ্ছে। শেষরাতে পাতলা কাঁথার আদরে গাঢ় হচ্ছে ঘুম। ‘তিতলির’ প্রভাবেই হোক কিংবা স্বাভাবিক নিয়মে, একটু আধটু বৃষ্টি হচ্ছে। ঝিরিঝিরি হাওয়া শীতের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। এভাবে শীতের আগেই একটা শীত শীত অনুভূতি। আবহাওয়াবিদদের মতে, এখন থেকে যত দিন যাবে ততই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য কমতে থাকবে। পার্থক্য যত কমবে তত শীত বাড়তে থাকবে। নবেম্বর পুরোটা এভাবে যাবে। ডিসেম্বর থেকে জোরে বইবে শীতের হাওয়া। এখন অল্পস্বল্প শিশির ঝরছে। বাইরের জেলাগুলোতে এর প্রভাব স্পষ্ট। ঢাকায়ও দেখা যাচ্ছে শিশির। রাত একটু বাড়লে বিশেষ অনুভব করা যায়। আর ভোর বেলাটা কুয়াশায় মোড়ানো থাকে। সবুজ পাতার গায়ে জমে থাকা শিশির বিন্দু হেমন্তের আগমনী ঘোষণা করে। কবিগুরুর ভাষায়Ñ হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকাÑ/ হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধুমল রঙে আঁকা।/ সন্ধ্যাপ্রদীপ তোমার হাতে মলিন হেরি কুয়াশাতে,/ কণ্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ বাষ্পে মাখা...। জীবনানন্দ দাশের বলাটি এ রকম : পা-ুলিপি কাছে রেখে ধূসর দ্বীপের কাছে আমি/নিস্তব্ধ ছিলাম ব’সে;/শিশির পড়িতেছিল ধীরে-ধীরে খ’সে;/নিমের শাখার থেকে একাকীতম কে পাখি নামি/উড়ে গেলো কুয়াশায়,-কুয়াশার থেকে দূর-কুয়াশায় আরো...। অবশ্য হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকের এক রূপ। পরেরটির অন্য। একসমময় হেমন্তের প্রথম মাসটি ছিল অনটনের। ফসল হতো না। বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্যাভাব দেখা দিত। সারা বছরের জন্য জমিয়ে রাখা চাল ফুরিয়ে যেত এসময়ে এসে। ধানের গোলা শূন্য হয়ে যেত। কার্তিকের দুর্নাম করে তাই বলা হতো ‘মরা কার্তিক’। রবীন্দ্রনাথের কবিতায়ও সময়টি সম্পর্কে বলা হয়েছে। কবিগুরু লিখেছেনÑ শূন্য এখন ফুলের বাগান, দোয়েল কোকিল গাহে না গান,/কাশ ঝরে যায় নদীর তীরে। অগ্রহায়ণে আবার উল্টো চিত্র। এই মাস সমৃদ্ধির। এ সময় মাঠের সোনালি ফসল কাটা শুরু হয়। দেখতে দেখতে গোলা ভরে ওঠে কৃষকের। হেমন্তের বাতাসে ভেসে বেড়ায় পাকা ধানের মিষ্টি ঘ্রাণ। বাড়ির আঙিনা নতুন ধানে ভরে ওঠে। কৃষক বধূ ধান শুকোতে। প্রতি ঘর থেকে আসে ঢেঁকিতে ধান বানার শব্দ। অবশ্য যত দিন যাচ্ছে ততই বদলাচ্ছে হিসাব-নিকাশ। এখন আগের সে অভাব নেই। শস্যের বহুমুখীকরণের ফলে মোটামুটি সারা বছরই ব্যস্ত কৃষক। বিভিন্ন ফসল ফলান তারা। আয় রোজগারও বেশ। পাশাপাশি এখন কার্তিক মাসেই রিষ্পপুষ্ট হয়ে ওঠে আগাম আমন ধানের শীষ। পাকা ধান কাটা শুরু হয়ে যায়। ঠিক এই মুহূর্তে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলছে আগাম আমন ধান কাটার উৎসব। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে মহাধুমধামে চলছে ফসল কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ। বগুড়া, রংপুর, নীলফামারীসহ বিভিন্ন জেলার কৃষকরা যারপরনাই ব্যস্ত। কৃষকরা বাড়তি লোক নিয়ে ফসলের মাঠে যাচ্ছেন। দিনভর চলছে ধান কাটা। তারপর ফসল কাঁধে বাড়ি ফিরছেন। এত যে দেখা, তবু চোখ সরানো যায় না! অদ্ভুত ছন্দ তুলে সরু আইল মেঠো পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি ফেরেন কৃষক। সেখানে আগে থেকে অপেক্ষমাণ কৃষাণী। ধান মাড়াই, শুকিয়ে ঘরে তোলার দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় খুশি মনেই অংশ নিতে দেখা যায় তাদের। দ্বিতীয় মাসটি অগ্রহায়ণ। এ মাসের পুরোটাজুড়ে সারা বাংলায় চলবে নবান্ন উৎসব। বাঙালীর প্রধান ও প্রাচীনতম উৎসবগুলোর অন্যতম নবান্ন। এ সময় আমন ধান কাটা শুরু হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফসল উৎপাদনের সময় এটি। প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টন আমন উৎপাদন হয় এ সময়। নতুন ধানে চলে নবান্ন উৎসব। আমন ধানের চালে প্রথম রান্না হয়। এ উপলক্ষে চলে আনন্দঘন উদ্যাপন। কোন কোন অঞ্চলে ফসল কাটার আগে বিজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে ঘরের চালে বেঁধে রাখা হয়। বাকি অংশ চাল করে সে চালে চলে পায়েস রান্না। এভাবে নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে উদ্যাপিত হয় নবান্ন উৎসব। শুধু গ্রামে নয়, এখন শহরেও থাকে নানা আয়োজন। গ্রামের মতো না হলেও প্রতিবছর ১ অগ্রহায়ণ রাজধানী ঢাকায় প্রতীকী নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়। এভাবে শেকড়ের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার অনুপ্রেরণা হয়ে আসে হেমন্ত। এবার এসেছে। স্থায়ী হবে অগ্রহায়ণের শেষ দিন পর্যন্ত।
×