ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বার্মিজ ভাষায় শিক্ষা দিতে আগ্রহী স্থানীয় প্রশাসন;###;দুই ভাষাতেই শিক্ষা দিতে রাজি বিভিন্ন সংস্থা

শিক্ষার মাধ্যম নিয়ে জটিলতা- বাংলা না বার্মিজ ॥ রোহিঙ্গা শিশু ২

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১৮ অক্টোবর ২০১৮

শিক্ষার মাধ্যম নিয়ে জটিলতা- বাংলা না বার্মিজ ॥ রোহিঙ্গা শিশু ২

রহিম শেখ, কক্সবাজার থেকে ফিরে ॥ নঈমুদ্দিন। বয়স ১২ বছর। গত বছরের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন এলাকা থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসে মা রইসুন খাতুনের সঙ্গে। বসতি গেড়েছে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং বালুখালী ১২ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। নঈমুদ্দিন ফিরে যেতে চায় না তার জন্মভূমি মিয়ানমারে। স্বপ্ন, পড়াশোনা করে সেনাবাহিনীতে চাকরি নেবে। কিন্তু কিভাবে, কোন ভাষায় পড়বে নঈমুদ্দিন! বাংলা নাকি বার্মিজ। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা পরিবারের শিশুদের জন্য স্কুলিং বা প্রাথমিক শিক্ষাদানের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার ও ইউনিসেফ। কিন্তু শিক্ষার মাধ্যম নিয়ে দেখা দিয়েছে জটিলতা। সূত্র জানায়, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শিশুদের বার্মিজ ভাষায় শিক্ষাদানের পক্ষে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠি দিয়ে মতামত জানিয়েছেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক। এছাড়া আরও কয়েকটি এনজিও রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষাদান করছে। তবে বাংলা মাধ্যমে শিক্ষা দেয়ায় কয়েকটি এনজিওকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইউনিসেফের তথ্য মতে, বাংলাদেশে সম্প্রতি পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শিশুর সংখ্যা ২ লাখ ৯০ হাজারের কিছু বেশি। এ বিপুলসংখ্যক শিশুর শিক্ষাদানের জন্য পাঠ্যক্রম তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য ইউনিসেফ ১ হাজার ৩০০ স্কুল প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়েছে। ১ লাখ ৪০ হাজার শিশুকে তালিকাভুক্ত করেছে সংস্থাটি। এর আগে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় ৪ থেকে ১৪ বছর বয়সের ১৫ হাজার শিশুকে বাংলা ও বার্মিজ ভাষায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করে ইউনিসেফ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এমনিতে রোহিঙ্গাদের নিজেদের নাগরিক হিসেবে মানতেই রাজি নয় মিয়ানমার। এখন যদি রোহিঙ্গা শিশুদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি শিক্ষা দেয়া হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। এ কারণে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শিশুদের বাংলা মাধ্যমে লেখাপড়া শেখানো হবে না। শুধু বাংলা মাধ্যমেই নয়, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়েও তাদের শিক্ষা দেয়ার বিষয়ে নিরুৎসাহিত করা হবে। ইউনিসেফসহ যারা রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষাদান করতে ইচ্ছুক তাদের অবশ্যই বার্মিজ ভাষায় শিক্ষা দিতে হবে। এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোঃ গিয়াস উদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, ইউনিসেফ বাংলা ও বার্মিজ ভাষায় রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা দেয়ার প্রস্তাব করেছিল। যেহেতু রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক নয় তাই শুধু বার্মিজ ভাষায় শিক্ষাদানের কথা বলেছি। এছাড়া সেখানে আরও কিছু এনজিও রোহিঙ্গা শিশুদের বাংলা মাধ্যমে শিক্ষাদান করছিল। আমরা কিছু এনজিওকে নিষিদ্ধ করেছি। এদিকে বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য নিজের রোহিঙ্গা পরিচয় আড়াল করতে বাংলায় কথা বলা এবং বাংলাদেশী মেয়েদের মতো পোশাক পরছে অনেক রোহিঙ্গা শিশু। তেমনি একজন জোসনা আক্তার। বয়স ১৩। জোসনার মতে, আমাদের জন্য শিক্ষা অত্যন্ত জরুরী একটি বিষয়। এ বিষয়ে তার ভাষ্য, যদি আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি তাহলে জীবনের মতো একটি জীবন ধারণ করতে পারব। তবে দুঃখের বিষয়, মাত্র কিছু রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু মেয়েই উচ্চ বিদ্যালয়ের সমমানের বাংলাদেশী শিক্ষা সম্পন্ন করতে পেরেছে। জোসনা আরও জানায়, শিক্ষার এই অধিকার আদায় করে নেয়ার জন্য শিবিরের তল্লাশি চৌকি ফাঁকি, এমনকি ভর্তির জন্য সরকারী বিদ্যালয়ের বাংলাদেশী কর্মকর্তাদের ঘুষও দিতে হয়েছে। কথা হয় উখিয়ার কুতুপালং বালুখালী ক্যাম্পে মাবিয়া খাতুনের সঙ্গে। তার বয়স ১৪ বছর। মাবিয়ার মতে, বর্তমানে মিয়ানমারে থাকা রোহিঙ্গাবিরোধী পরিস্থিতির মাঝে তার পরিবারের ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। ফলে মৌলিক শিক্ষার এই বিষয়টি আসলে কতটা ফলপ্রসূ তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। কাজেই রোহিঙ্গাদের শিক্ষার বিষয়টি অবহেলিতই থেকে যাচ্ছে। মাবিয়া বলছিল, বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য নিজের রোহিঙ্গা পরিচয় আড়াল করতে সে শুধু বাংলায় কথা বলে এবং বাংলাদেশী মেয়েদের মতো পোশাক পরে। তবে তাকে সবচেয়ে প্রতিকূল লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হয় নিজের ঘরে। উল্লেখ্য, বেশির ভাগ রোহিঙ্গা মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় ১৬ বছরের মধ্যে, মাঝে মধ্যে তা ১৪ বছরেও হয়। তাই মাবিয়ার লড়াই করতে হয়েছে তার বাবার সঙ্গে। তার বাবা মনে করেন মাবিয়ার বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। লেখাপড়া অব্যাহত রাখার জন্য মাবিয়া তার বাব-মায়ের কাছে করজোড়ে অনুনয় করেছে, কেঁদেছে দিনের পর দিন। তবে তার শিক্ষা গ্রহণের পথে বড় ভূমিকা রেখেছেন তার মা। মাবিয়ার মা মিনারা বেগম বলেন, আমরা রোহিঙ্গা। আমাদের পায়ের নিচে কোন মাটি নেই। আমাদের কোন ভবিষ্যত নেই। আমাদের অবস্থা খাঁচায় থাকা মুরগির মতো। আমরা এমনকি যে গাছ লাগিয়েছি তার ফলও দাবি করতে পারি না। জানা গেছে, বর্তমানে ইউনিসেফ কক্সবাজারের অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে শিশুদের জন্য ১৮২টি স্কুল পরিচালনা করছে এবং এতে ১৫ হাজারের মতো শিশু শিক্ষা লাভ করছে। আগামী বছরের মধ্যে পরিধি বৃদ্ধি করে ১৫ হাজার থেকে ২ লাখ রোহিঙ্গা শিশুকে এই কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা আছে ইউনিসেফের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরে অবস্থানরত ছয় থেকে ১৪ বছর বয়সী এক লাখ ৪০ হাজার শিশুকে ১২শ’ অস্থায়ী বিদ্যালয়ে ইংরেজি, গণিত, বার্মিজ, বিজ্ঞান ও চারুকলা শেখানো হচ্ছে। কিন্তু অস্থায়ী এই বিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হয় হয় মাত্র পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। তাই উদ্বাস্তুদের অধিকাংশরেই উচ্চ শিক্ষা সম্পন্ন করার লক্ষ্যে গোপনে কক্সবাজার ও অন্যান্য শহরের বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয়। অন্যদিকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত উদ্বাস্তু শিশুদের হারানো প্রজন্ম নামকরণ করেছে ইউনিসেফের কর্তৃপক্ষ। ইউনিসেফের মুখপাত্র শাকিল ফয়জুল্লাহ বলেন, উদ্বাস্তুরা মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার পর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করবে এই ধরনের একটি অনুমান থেকে ইউনিসেফ বেশি বয়স্ক শিক্ষার্থীদের মৌলিক ক্লাস শুরু করানোর পরিকল্পনা নিয়েছে বলেও তিনি জানান। সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ৩ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গার বয়স ১৮ বছরের নিচে, যা মোট জনগোষ্ঠীর ৫৫ শতাংশ। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ৭৩ শতাংশের কোন অক্ষর জ্ঞান নেই। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা শিশুসহ নিরক্ষর রোহিঙ্গাদের শিক্ষা কার্যক্রমের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা জানান, রোহিঙ্গা শিশুদের পাশাপাশি স্থানীয় শিশুদের জন্যও প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেবে বিশ্বব্যাংক। ফলে তাদের মতে, কক্সবাজার জেলায় স্কুলে ভর্তি হয় ৭০ শতাংশ শিশু। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার হার ৩৫ শতাংশ। মাধ্যমিক পর্যায়ে স্কুলে ভর্তির হার মাত্র ৩৩ শতাংশ। এ অঞ্চলের ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সের ১০ শতাংশ শিশুই শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। ফলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত প্রকল্পের আতওায় স্থানীয় শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ দেয়া হবে। ইউনিসেফের বাংলাদেশ প্রতিনিধি এডওয়ার্ড বেগবেডার বলেন, যদি আমরা এখন তাদের শিক্ষায় বিনিয়োগ না করি, তবে রোহিঙ্গা শিশুদের ভবিষ্যত হুমকির মুখে পড়বে। তাদের বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য শিশুদের দক্ষতা প্রয়োজন। না হলে তারা যখন মিয়ানমার ফিরে যাবে তখন তারা সমাজে অবদান রাখতে অক্ষম হবে।
×