ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মনোমুগ্ধকর প্রযোজনা ম্যাকবেথ

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ১৮ অক্টোবর ২০১৮

মনোমুগ্ধকর প্রযোজনা ম্যাকবেথ

‘এটা হওয়া কিছু নয়। এটা হয়ে থাকাটাই কিছু।’ ম্যাকবেথের এই সংলাপ যেন চিরন্তন বাণী। ক্ষমতাকে আঁকড়ে রাখতে গিয়ে ম্যাকবেথ ক্রমেই এক ভয়াবহ পরিণতির পাঁকে পড়ে যায়। ম্যাকবেথ তার অবস্থানও পরিণতিকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে রূপান্তরিত হয় এক ব্যতিক্রমী আত্মবিশ্লেষণাত্মক মানুষে, একের পর এক হত্যার আয়োজনে জড়িয়ে যায়। রক্ত আর রক্তে পরিপ্লুত যেন ম্যাকবেথের পৃথিবী। তার মনস্তাপ ও অস্তিত্ববোধের সংঘাতজনিত অস্থির মানসিকতার বিচিত্র প্রকাশ ঘটে নাটকের বিখ্যাত ভোজসভা ও অন্যান্য দৃশ্যে। লেডি ম্যাকবেথ রাজস্বামীর মনের পরিচর্যায় উদ্যোগী হয়ে ওঠে। কিন্তু ক্ষমতার লিপ্সা ইতোমধ্যে তার রক্তেও সৃষ্টি করে ভারি সীসা। লেডি নিজেই নিজের মনের অপরাধ ও বিকৃতির মধ্যে তলিয়ে যায়। ঘুমের মধ্যে হাঁটাচলা, আপাত অসংলগ্ন কথা ও আচরণের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে প্রকাশিত হতে থাকে তার মনের অনুতাপ ও বিপন্ন আবেগ। আত্মহত্যার মাধ্যমে লেডি ম্যাকবেথ নিজের গ্লানিকর ও গৌরবহীন জীবনের পরিণতি বরণ করে। কিন্তু ম্যাকবেথ স্ত্রীর মৃত্যুর এই খবর যখন জানতে পারে তখন তার ঘোর বিপদ। তার প্রাসাদ তখন আক্রান্ত। বীরের গৌরব ও মহিমাকে ম্লান করে পরাজয় স্বীকার করে না ম্যাকবেথ। নিহত রাজা ডানকানের পুত্র ম্যালকম ও স্বজন হারানো সেনাপতি ম্যাকডাফের সম্মিলিত নেতৃত্বে আক্রমণকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্তিত্বের শেষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় ম্যাকবেথ। কিন্তু সেই সংগ্রামে সে হয়ে পড়ে মিত্রহীন, সম্পূর্ণ একা। কী হয় ম্যাকবেথের? এই নাটকে ফুটে ওঠে মানবীয় কর্ম ও নৈতিক মূল্যবোধের সংঘর্ষ। এই সাংঘর্ষিক দশাই যেন মানুষের নিয়তি। ভাগ্যের এই পরিহাস থেকে যেন কেউই নিস্তার পায় না। ম্যাকবেথও না! ড. ইস্রাফিল শাহীনের নির্দেশনায় মঞ্চায়ন মানেই একটি নিরীক্ষা। প্রচলিত নাট্যরীতিকে ভেঙ্গে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে পাশ্চাত্যের সঙ্গে প্রাচ্য, পুরনোর সঙ্গে আধুনিকতার যে মিথস্ক্রিয়া ঘটান সত্যিই প্রশংসনীয় এবং দক্ষতার পরিচায়ক। সমকালীন পরিস্থিতি নাটকে ফুটিয়ে তোলেন গভীরভাবে। গত ৯-১৪ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটম-লে মঞ্চস্থ হয়েছে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের নাটক ‘ম্যাকবেথ’। নাটকটি অনুবাদ করেছেন সৈয়দ শামসুল হক এবং নির্দেশনা দিয়েছেন ড. ই¯্রাফিল শাহিন। নাট্য সাহিত্যের অনুকরণের পরিবর্তে ভিন্ন ভঙ্গিমায় সৃজনশীল শিল্প সম্ভাবনাকে নান্দনিকভাবে উপস্থাপনার সফল চেষ্টা করা হয়েছে। তবে অভিনয়ের জায়গায় আরও পরিশ্রমের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। চরিত্রের মধ্যে ডুবে থাকার ব্যাপারে কিছুটা ছেদ ঘটেছে। নাটকটি নিয়ে নির্দেশক বলেন, ‘থিয়েটার এ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগে আমরা যখন নাট্য নির্মাণের কাজ করি, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই কাজের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা। তাদের শিক্ষার প্রশ্নটিকে অমীমাংসিত রেখে, উপেক্ষা করে, গৌণ করে বিশ^বিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে নাট্যচর্চা অর্থপূর্ণ হতে পারে না। তবে, উচ্চশিক্ষার স্তরে নাট্যশিক্ষা বলতে আমরা কী বুঝতে চাই? বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা-ব্যবস্থায়-প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়েÑ এমন কোন পাঠক্রম নেই যা অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে অভিনয় তথা থিয়েটার নিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ন্যূনতম প্রস্তুত ছাত্র-ছাত্রী আশা করা যায়। অন্যদিকে, সকল বিষয়ের জন্য অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে এই বিভাগে ভর্তি হওয়া আমাদের ছাত্রছাত্রীদের শুরুই করতে হয় এক ‘কঠিন ও সমস্যাসঙ্কুল’ নতুন শিক্ষাজীবন। এই ধরনের পরিস্থিতিতে, ব্যাখ্যামূলক, সমালোচনামনস্ক ও উদ্ভাবনার অভিনবত্বে পরিপূর্ণ সৃজনশীল নাট্যচর্চা দুরূহ হয়ে পড়ে। কেননা শরীর, স্বর, বাচন, মন, অনুভব, চিন্তা ও কল্পনার ক্ষেত্রগুলোতে নিবিড় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে প্রাথমিকভাবে দক্ষ হয়ে উঠাটাই তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তথাপি বিভাগীয় পাঠক্রম, শিক্ষাদানের বৈচিত্র্যময় পদ্ধতি, নাট্যভাষার ভেতর দিয়ে জীবন ও পৃথিবীকে নতুনভাবে আবিষ্কারে বিভাগের লক্ষ্য- এই সবকিছু মিলিয়েই বিভাগীয় যে শিক্ষণপ্রণালী ও আবহ গড়ে উঠেছে, তা সবসময় বর্তমানের সমস্যাসঙ্কুলতাকে অতিক্রম করে সুন্দর ভবিষ্যতের দিকেই পরিভ্রমণ করতে ঐকান্তিকভাবে আগ্রহী। সর্বোপরি, এই আততায়ী সময়েÑ আমাদের জীবন, আমাদের দেশ, আমাদের পৃথিবীর অন্তর্গত বিপন্নতা যেন হত্যা ও রক্তে পরিপ্লুত ম্যাকবেথের মতন রাজনৈতিক-মনস্তাত্ত্বিক নাটকটিতে শেক্সপিয়রীয় স্থান-কালরহিত এক অমোঘ ভাষায় ফুটে উঠেছে। আমরা যা করে ফেলি আর আমাদের নৈতিক মূল্যবোধ অর্থাৎ কর্ম ও মর্ম- এ দুয়ের সংঘর্ষই যেন ম্যাকবেথ। এই সংঘর্ষই যেন মানুষের নিয়তি। এই নিয়তি থেকে কি আমাদের নিস্তার নেই? এইসব প্রশ্ন মোকাবেলা করতেই থিয়েটার এ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ সমাজকে নিমন্ত্রণ জানায় ‘এসো, আমরা বীজ বপন করি, তাহলে মাটি আমাদের একটি ফুল উপহার দেবে। এই উপহার আমাদের জানান দেয়- আমরা বেঁচে থাকি কেবলমাত্র সৌন্দর্য আবিষ্কারের কারণে। এই আবিষ্কার রাজনৈতিকভাবে প্রয়োজনীয়। কারণ রস আস্বাদন করতে পারার মধ্যেই রয়েছে যাবতীয় সমতার সম্ভার-।’ কিংবদন্তি নাট্যজন অধ্যাপক সৈয়দ জামিল আহমেদের আলোক পরিকল্পনা ছিল অসাধারণ। সার্বিক সহযোগিতায় ছিলেন বিভাগীয় চেয়ারম্যান ড. আহমেদুল কবির। সর্বোপরি প্রযোজনাটি ছিল সফল নিরীক্ষা।
×