ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

১৪ মাসেও অনেকেরই নাম ওঠেনি সহায়তার তালিকায় ;###;কক্সবাজারে আশ্রিত ৪০ হাজার শিশু পরিবার-বিচ্ছিন্ন, এতিম ॥ বাবা কিংবা মা নেই ৬ হাজারের বেশি শিশুর

আশ্রয়কেন্দ্রে বাল্যবিয়ে পাচারসহ নানান অপরাধে জড়ানোর শঙ্কা ॥ রোহিঙ্গা শিশু শেষ

প্রকাশিত: ০৬:২০, ১৯ অক্টোবর ২০১৮

আশ্রয়কেন্দ্রে বাল্যবিয়ে পাচারসহ নানান অপরাধে জড়ানোর শঙ্কা ॥ রোহিঙ্গা শিশু শেষ

রহিম শেখ, কক্সবাজার থেকে ফিরে ॥ মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার দিনের কথা মনে করতেই ডুকরে কেঁদে ওঠে গিয়াসউদ্দিন। মাত্র ১২ বছর বয়সেই মা-বাবা, ভাই-বোন সবাইকে হারিয়েছে সে। বলছিল, তার দেশ মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের বসতভিটা জ্বালিয়ে দিয়েছে। সবাইকে হত্যার দৃশ্য দূরের এক জঙ্গলে পালিয়ে থেকে দেখেছে সে। গিয়াসের মতো মা-বাবা কেউ বেঁচে নেই এমন শিশুর সংখ্যা উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে কয়েক হাজার। গিয়াসের বর্তমান বসতি উখিয়ার কুতুপালং বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চাচা হারিছ মিয়ার সঙ্গে। যিনি নিজেই স্ত্রী ও চার শিশু সন্তান নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। জানালেন, গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে রোহিঙ্গা শিবিরে থাকলেও সহায়তা পাওয়ার জন্য কোন তালিকায় তার নাম ওঠেনি। হারিছের ভাষ্যমতে, সামনের দিনগুলো অন্ধকার দেখছেন তিনি। ফিরে যেতে চান না নিজ দেশ মিয়ানমারে। বলছেন, নিয়মিত খাবারই জোটে না তার ওপর সন্তানের পড়াশোনা। অভাব-অনটনে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে শিশু-কিশোররা। পুলিশের দেয়া তথ্যমতে, ১৪ মাসে আশ্রয় শিবিরগুলোয় নানা অপরাধে জড়িত ৪৯২ রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে ২৫৯। যাদের মধ্যে ১৭ শিশু-কিশোর। এছাড়া পাচার, বাল্যবিবাহ ও অন্যান্য নির্যাতনের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় বেড়ে ওঠা শিশু-কিশোররা। জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শিশুদের প্রতি দু’জনের একজন মা অথবা বাবাকে হারিয়েছে। অর্থাৎ যত শিশু এখন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে, তার ৫০ শতাংশেরই বাবা কিংবা মা নেই। আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বর্তমানে কক্সবাজারে ক্যাম্পগুলোতে প্রায় ছয় হাজারের বেশি পিতৃ-মাতৃহীন রোহিঙ্গা শিশু বসবাস করছে। ৭০ শতাংশ শিশু পুরোপুরি অভিভাবকহীন এবং তারা তাদের অভিভাবকদের হারিয়েছে মিয়ানমারের রাখাইনে তাদের ওপর চালানো নৃশংস হত্যাকা-ে। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ শিশুই তাদের অভিভাবকসহ পরিবারের সদস্যদের হত্যাকা-ের প্রত্যক্ষদর্শী। বাকিদের মধ্যে ৬৩ শতাংশ শিশু তাদের অভিভাবকদের হারিয়েছে রাখাইনের গ্রামগুলোয় আক্রমণের সময়। ৯ শতাংশ তাদের অভিভাবকদের হারিয়েছে বাংলাদেশে আসার পথে। বালুখালী ১২ শিবিরে মাঝির সহায়তাকারী বা ডেপুটি মাঝি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা হামিদ জানালেন, তার মা-বাবা নেই, এমন ৪৪৯ শিশুর তালিকা করে দীর্ঘ দিনেও সবার সহায়তা নিশ্চিত করতে পারেননি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, মিয়ানমারের রাখাইন থেকে আসা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন, এতিম শিশুর সংখ্যা ৩৯ হাজার ৮৪১। এদের মধ্যে ৮ হাজার ৩৯১ শিশুর মা-বাবা কেউ নেই। সমাজ সেবা অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বর্তমানে অতি ঝুঁকিতে থাকা শিশুর সংখ্যা ৫ হাজার ৯১৮। জানা গেছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অমানবিক নির্যাতনের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়ার এক বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও ভবিষ্যত অনিশ্চিত লাখ লাখ রোহিঙ্গা শিশুদের। সেখানে তাদের শিক্ষার সুযোগ খুবই সীমিত। ইউনিসেফ বাংলাদেশের প্রতিনিধি এডুয়ার্ডো বেইবেডার বলেন, আমরা যদি এখনই কোন উদ্যোগ না নেই তবে প্রজন্ম সঙ্কটের মতো গুরুতর বিপদে পড়তে চলেছে রোহিঙ্গা শিশুরা। বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দেয়ার মতো যথেষ্ট দক্ষতা নেই এই শিশুদের। মিয়ানমার ফিরে গিয়েও তারা সমাজের জন্য কোন অবদান রাখতে পারবে না। বেসরকারী একটি উন্নয়ন সংস্থার কর্মী ফরহাদ তালুকদার জানান, রোহিঙ্গা পরিবারে সন্তান বেশি। ২৫-২৬ বছরের নারীর পাঁচ/ছয়টি করে সন্তান। এই লাখ লাখ শিশু যে বাংলাদেশে এসে গেছে, এদের ভবিষ্যত কি, কিভাবে এরা বেড়ে উঠবে, তাদের শিক্ষা কিভাবে দেয়া হবেÑ কবে তারা তাদের নিজ দেশে ফিরে যাবে এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়া কঠিন বলে জানান ফরহাদ। উখিয়ার কুতুপালং এলাকার রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ নারীর কোলেই একজন করে শিশু। প্রতিটি ঘরেই ৫/৬ জন থেকে ১১ জন পর্যন্ত শিশু। গত বছর মিয়ানমারের মংডুর ভুদাইসন থেকে পালিয়ে আসা হালিমা বেগমের ৮ সন্তান। এর মধ্যে সবচেয়ে ছোট হারেসের বয়স ১০ মাস। ওমরের বয়স ২ বছর ও রফিকের বয়স ৩ বছর। বাকিদের বয়স ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে। হালিমা বলেন, তিনটা এখনও কোলের বাচ্চা। বাকিরা বাইরে কোথায় গেছে জানেন না হালিমা। কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আয়াতুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, এই শিশুরা যখন একটু বড় হবে, পর্যাপ্ত খাবার পাবে না, অনাহারে-অর্ধাহারে থাকবে। তখন তারা খুন-রাহাজানিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এটা নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করবে। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ প্রণব চৌধুরীর মতে, রোহিঙ্গা শিশুদের মধ্যে যাদের বয়স ২/৩ বছর কিংবা তারও বেশি তাদের মধ্যে নির্যাতন, কষ্ট করে বাংলাদেশে প্রবেশ, এসব দুঃসহ স্মৃতি তাদের পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব হবে না। তারা মনোবৈকল্য রোগে ভুগবে। তাদের বেড়ে উঠা স্বাভাবিক হবে না।
×