ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বার বার দেখেও স্বাদ মেটে না

প্রকাশিত: ০৭:৫১, ১৯ অক্টোবর ২০১৮

বার বার দেখেও স্বাদ মেটে না

নাসিরুদ্দীন ইউছুফ ওরফে বাচ্চু ভাই আর ভাবি শিমুল ইউছুফ বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দুটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। বাচ্চু ভাই একজন মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সফল চিত্র পরিচালক, নাট্যকার এবং সংগঠক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের উপর তার পরিচালিত ও নির্মিত গেরিলা ও একাত্তরের যিশু ছবির জন্য তিনি অমর হয়ে থাকবেন। আর শিমুল ইউছুফকে জানেন না বা চেনেন না এদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এমন লোক খুব একটা নেই। তাঁর সুরেলা কণ্ঠের গান আর অভিনয় বিশেষ করে নয়টি বিনোদিনীর একক অভিনয় তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় কিছুটা আকস্মিকভাবে। পরিচয়ের সূত্র শ্রদ্ধেয় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। তিনি তখন বঙ্গবন্ধুকন্যা বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপর একটা প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। তাই বাচ্চু ভাইকে উড়িয়ে আনা হয়েছে সেই ঢাকা থেকে লন্ডন প্রামাণ্যচিত্রটির সফল পরিণতির জন্য। কারণে অকারণে গাফ্ফার ভাইয়ের বাড়িতে প্রায়ই যাওয়া হয়। একদিন সন্ধ্যায় হয়ত অকারণেই গিয়ে হাজির। গাফ্ফার ভাই বললেন ‘আজ তোমাকে একজন ভাল মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব।’ সেই থেকেই বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়। তাও প্রায় বছর তিনেক অতিক্রম করতে গেল। তারপর থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা। বাচ্চু ভাই মাঝে মধ্যেই লন্ডনে আসেন। লন্ডনে এলেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ও দেখা সাক্ষাত হয়। এ বছর তিনি সপরিবারে কান চলচ্চিত্র সম্মেলনে যোগ দিতে এবং ইউরোপ ভ্রমণে বের হয়েছেন। লন্ডনে কয়েকটাদিন যাত্রা বিরতি অতপর ইউরোপের অন্যান্য দেশ ভ্রমণ শেষে শিমুল ভাবিকে নিয়ে স্কটল্যান্ডের এডিনব্যরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ। মাঝ পথে কন্যা এশা কলকাতা ফিরে গেছে বন্ধুর বিয়ের গুরুদায়িত্ব পালন করতে। এই সুযোগে আমারও প্রথম এডিনব্যরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দেখার সুযোগ এসে গেল। বিমানবন্দর দেখার কি বা আছে? তবুও আগে তো আসা হয়নি এখানে। হলিডে ইন এর যে হোটেলে বাচ্চু ভাই আর শিমুল ভাবির থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে তার অবস্থান আবার গ্লাস্গো শহরে, ব্যবধান চল্লিশ মাইল। রাতের বেলায় আলো আঁধারের লুকোচুরির খেলা দেখতে দেখতে এডিনব্যরা গ্লাসগো মোটরওয়ে দিয়ে গাড়ি চালাতে ভালই লাগল। তারপরও বারোটা বেজে গেল, ভয় নেই আমাদের নয়, রাতের। সেরাতে আর বেশি ঘোরাঘুরির সুযোগ ছিল না। তাঁদের হোটেলে রেখেই ফিরে এলাম নিজ গৃহে। পরদিন সাত সকালে বেরিয়ে পড়লাম পরিবার পরিজন নিয়ে। পরিবার বলতে তো ওই ডাক্তার, সবে অবসর জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে শুরু করেছে। কাজ ছাড়া তাঁকে ঘরে বসিয়ে রাখা অনেকটা কষ্টকর তাই দুজনে বেরিয়ে পড়লাম বাচ্চু ভাইদের সঙ্গে। উদ্দেশ্য লক ক্যাটরিন। এখানে আরও একবার বেড়ানোর সুযোগ ঘটেছিল। সেবার সঙ্গে ছিলেন সাহিত্য অঙ্গনের আর এক দিকপাল অধ্যাপক সুশান্ত সরকার। তাঁর সুখ্যাতি যতটা লেখায় ততটা প্রসার ব্যক্তি জীবনে যদি ঘটত তবে তিনি অনেক বড় উচ্চতায় বিচরণ করতে পারতেন। হতে পারতেন অনেকের মধ্যমণি। বিভাগীয় শহর খুলনাতে থাকায় এবং কিছুটা আত্মপ্রচার বিমুখিতার করণে হয়ত তিনি সাহিত্য জগতের অনেকের কাছে ততটা পরিচিতি লাভ করতে পারেননি, যতটা পরিচিতি পাওয়ার যোগ্যতা তাঁর আছে। তবে আমার সৌভাগ্য হয়েছে তাঁর সান্নিধ্য লাভ করার। লেখালেখির জগতে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনেকখানি। উইলিয়ম কেরির উপর তার গবেষণা কর্মের জন্য তিনি উইলিয়ম কেরি সম্মামনা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এ ছাড়াও তাঁর সম্মামনার ঝুলিটা নিতান্ত নগণ্য নয়। উইলিয়ম কেরির উপর বাকি গবেষণা কাজ সমাপ্ত করার জন্য তাঁর ইংল্যান্ডে আসার প্রয়োজন ছিল। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেই কাজে তাঁকে সহযোগিতা করার। তাঁর সহযোগী হিসেবে যতটা পারা যায় সহযোগিতার পাশাপাশি এদিক সেদিক বেড়াতে বেড়াতে এসে হাজির হলাম স্কটল্যা-ের গ্লাসগো শহরের উপকণ্ঠে আমাদের আর এক আস্তানায়, যেখানে পুত্র দেবপ্রতীক ও পুত্রবধূ অপরাজিতা তাদের দুই পুত্রকে নিয়ে সংসার পেতেছে। এ আস্তানায় মাঝে মধ্যেই আসতে হয়। কারণ ওই যে নাড়ির টান। আর আসলেই যে কাছে পিঠে যেদিকে মন যায় চলে যাই কোন উপলক্ষ ছাড়াই। একেবারে উপলক্ষ নেই সেটাই বা বলি কেন? তবে বড় উপলক্ষ নতুন নতুন যায়গায় নতুনের সন্ধানে বের হওয়া। সুশান্ত দাদাকে নিয়ে অনেক কথাই বলার আছে, সে না হয় অন্য কোনদিন অন্য কোন পরিসরে আরও বিস্তারিত কলেবরে গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসা যাবে। আজ লক ক্যাটরিনেই সীমাবদ্ধ থাকি। গ্লাস্গো শহরের উপকণ্ঠে বহু দর্শনীয় স্থান আছে যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার ভ্রমণ পিপাশুদের পদচারণায় মুখরিত হয়। কোন কথা না বাড়িয়ে নির্দ্বিধায় বলা যায় লক ক্যাটরিন তাদের মধ্যে অন্যতম স্থান দখল করে বসে আছে। ভ্রমণ বিনোদনের একটা অপরিহার্য অঙ্গ, এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। প্রথমবার যখন সুশান্ত দাদাকে নিয়ে এখানে এলাম সেবার ততটা আবেগাপ্লুত হইনি, দ্বিতীয়বার যতটা হয়েছিলাম কারণটা আর কিছুই নয়, সময়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি যে নানা সাজে সাজতে ভালবাসে তার তো চাক্ষুস প্রমাণ এই বিলেতে দীর্ঘ ষোল বছরের আভজ্ঞতায় বার বার পেয়েছি। দাদার সঙ্গে প্রথম যেবার গেলাম তখন সময়টা ছিল সম্ভাবত মার্চ মাসের শেষ। প্রকৃতি তখনও শীতের অবগুণ্ঠন খুলি খুলি করেও খুলতে যেন দ্বিধা দ্বন্দ্বে আছে। বাচ্চু ভাই আর ভাবি এলেন ভরা যৌবনে জুন মাসে। আসলে মে মাস থেকেই প্রকৃতি নতুন সাজে সাজতে শুরু করে আর জুনেই তারা অভিসারে যাওয়ার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে পার্টনারের জন্য অপেক্ষার প্রহর গোনা শুরু করে। আমরা ভ্রমণ বিলাসিরা হলাম তাদের পার্টনার। অভিসারিণী অভিসারে যাবার জন্য যেমন নানা সাজে নিজেকে সাজিয়ে প্রস্তুত হয়ে থাকে তখন যদি কোন কারণে না ঘটে অভিসার তবে মন খারাপের আর সীমা থাকে না, তেমনি প্রকৃতিও যেন প্রিয় মানুষ জনকে না দেখার বেদনা ভুলতে পারে না। তাকে কি এত কষ্ট দেয়া যায়? কষ্ট না দিতেই আমাদের এই পথ পরিক্রমা। এই উপলক্ষে আমরা চারজন সেদিন বেরিয়ে পড়লাম সাত সকালে। গ্লাসগো শহরের হলিডে ইন হোটেল থেকে আমাদের বাড়ি আট মাইল দূর। সময়ের ব্যবধানে এটা কোন দূরুত্বই নয়। আগে থেকেই তাঁরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমাদের যাত্রা হলো শুরু। শহরটাকে যতই পিছনে ফেলছি ততই সুন্দরের হাত ছানি। ওই যে বললাম অভিসারিণীর অপেক্ষার কথা। তার আর তর সইছে না। এক সময় হারিয়ে গেলাম গহিন অরণ্যে। সরু আঁকা বাঁকা রাস্তায় কত না বিপদ অপেক্ষা করে আছে। গোপন অভিসারে বিড়ম্বনা তো থাকবেই। তা বলে অভিসার তো বন্ধ রাখা যাবে না। চারদিকে উঁচু উঁচু গাছপালা, পাহাড়, লেক, নদী, ঝরনা আর সদ্য প্রস্ফুটিত কচি কচি পাতাগুলো সূর্যকিরণকে আড়াল করে আবছা আলো আঁধারের এক মোহনীয় পরিবেশের সৃষ্টি করে রেখেছে। যাকে বলা যায় অভিসারের উপযুক্ত পরিবেশ। রোমাঞ্চিত না হয়ে উপায় নেই। কিন্তু বিড়ম্বনা হলো চকিতে খাদে পড়ে না যাই, ধাক্কা না মারি গাছে, কিংবা আঘাত করে না বসি বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়িকে। মাঝে মাঝে রাস্তার বাঁক এমনই যে কিছুই বোঝার উপায় নেই। আবার হর্ন বাজাব সেটা তো রীতিমতো অন্যায়। অন্য পথ ব্যবহারকারীদের কাছে গাড়ি চালনার দক্ষতা নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া। এই একটি বিষয় সকল ড্রাইভার মেনে চলে, নিতান্ত প্রয়োজন না হলে গাড়ির হর্নে হাতের চাপ পড়ে না। চলতে চলতে কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলা আর উপভোগ করা প্রকৃতির অকৃপণ দানে একটু একটু করে সাজিয়ে রাখা সৌন্দর্যের ডালি। কোথাও পাহাড়ের গিরি শিখরে আহরণ আবার কখনও গভীর খাদের কিনার দিয়ে লেকের জল স্পর্শ করে ধন্য হওয়া। মাঝে মধ্যে গ্রামের কোন সম্ভ্রান্ত গৃহস্থ্য পরিবারের বাড়ির আঙ্গিনায় গিয়ে আছড়ে পড়া। ভারি চমৎকার দৃশ্য। রাস্তার ধারে গ্রামের এই বাড়িগুলো এমন পরিপাটি করে সাজানো গোছানো দেখলেই মনটা প্রশান্তিতে ভরে উঠে। এক সময় বন জঙ্গল, পাহাড়, লেক নদী ঝরনাকে ফেলে রেখে সমতলে চলে আসলাম। যেন নতুন দৃশ্যে সাজ সজ্জার আমূল পরিবর্তন। কোথাও কোন গাছের চেহারা চোখে পড়ে না। দেখা যায় না লেক বা ঝরনা। বহু দূরের পাহাড়ের টিলাগুলো মাঝে মাঝে উঁকি মেরে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। সমতলে সবুজ ঘাসের চাঁদরে ঢাকা মাঠের মাঝে আলস্যে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে গরু ভেড়াদের দল। এদের কেউ বা উদর পূর্তিতে ব্যস্ত আবার কেউ বা মনের খুশিতে গুঁতাগুতি, মারামারিতে সময় নষ্ট করছে। কিন্তু নষ্ট করার মতো খুব বেশি সময় আমাদের হাতে নেই। দূরে পাহাড়ের হাত ছানি দ্রুত কাছে টানছে। সে টানকে উপেক্ষা করার সাধ তো নেই সাধ্যও নেই। তাহলে সহযাত্রীরা আমাকে ছেড়ে কথা কইবে না। না, খুব বেশি অপেক্ষার প্রহর গুনতে হলো না। অচিরেই আমরা অবতরণ করতে যাচ্ছি আমাদের কাক্সিক্ষত গন্তব্যস্থল লক ক্যাটেরিন। গাড়ি পার্ক করতেই চোখে যে দৃশ্য ধরা পড়ল তার বর্ণনা কেমন করে দিব? লেক আর তাকে ঘিরে রেখেছে পাহাড়। পৃথিবীর বহু জায়গায় এমন দৃশ্যের ঘনঘটা চোখে পড়বে। কিন্তু এ যে স্কটল্যান্ডের লক ক্যাটেরিন বলে কথা। এখানে এমন নির্জন জন মানববিহীন পরিবেশ কোথায় পাওয়া যাবে?। যদিও লেকের অপর পারে অতিব সুন্দর একটি ভিলা সকলের দৃষ্টিকে আকৃষ্ট না করে পারছে না। তাছাড়া অতিথি অব্যাগতদের পানাহারের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে একটি সুরম্য ভোজানালয়। যার পাদদেশে আছড়ে পড়ছে লেকের জলের ঢেউ। অনতিদূরে লেকের কিনার ঘেঁষে একখানি জেটি। কিছুটা বিরতি দিয়ে তাতে এসে ভিড়ছে প্রমোদতরী। একদলকে নামিয়ে আর এক দলকে নিয়ে ভো শব্দে নোঙর তুলছে। এর যাত্রীরা সকলেই বিলাসি ভ্রমণ পিপাসু। প্রমোদতরীতে চড়ে এরা সুন্দরের পিপাসা মেটায়। প্রকৃতি প্রদত্ত সুন্দরের পূজা করে। যে দৃশ্য লেকের ধারে দাঁড়িয়ে দৃষ্টিগোচর হয় না, মেটে না মনের ক্ষুধা, সে ক্ষুধা তারা প্রমোদতরীতে চড়ে মেটায়। একটা কথা বলতে ভুলেই গেলাম। না বলা কথা নেই বলতে মানা। এই যে আকাশচুম্বি পাহাড়গুলো- দিন নেই রাত নেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মাথায় না আছে ছাতা, না আছে খাতা তবে ঢেকে আছে বরফে সাদা। শীত, বর্ষা, গ্রীষ্ম কোন কিছুতেই মাথা কামানোর বালাই নেই। এই যে বরফের সাদা টুপি পরে আছে কোন কালে খোলার কোন বালাই নেই। তাতে করে আমরা যারা বরফের দেশের মানুষ নই, এবং কস্মিন কালে বরফের সঙ্গে মোলাগত করার সুযোগ হয়নি তাদের জন্য একটা বাড়তি পাওনা। তাই সে যে কালেই এখানে আসার সুযোগ হউক না কেন। স্কটল্যান্ডের যে দিকটাকে হাইল্যান্ড বলে সেদিকটাতে সারা বছরই পাহাড়গুলো বরফের আস্তরণে ঢেকে থাকে। তবে বরফের ঘনত্বটা তাপমাত্রার কারণে কমবেশি হয়ে থাকে। লক ক্যাটেরিনকে ঠিক সেই অর্থে হাইল্যান্ড বলা যায় না তবে কিছু পাহাড়ের উচ্চতা এতটাই বেশি যে, জমাট বরফ জলে পরিণত হওয়ার সুযোগই পায় না। তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, যেদিনে থেকে মানুষের মধ্যে ভ্রমণের নেশা পেয়ে বসেছে সেদিন থেকে লক ক্যাটিরিনের মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যম-িত স্থানগুলোর কদরও বাড়তে শুরু করেছে। সঠিক সে ইতিহাস জানা না গেলেও যেটুকু জানা যায় তাতে করে বলা যায় সভ্যতার ঊষা লগ্ন থেকেই মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে চলেছে লক ক্যাটিরিন। ঝরৎ ডধষঃবৎ ঝপড়ঃঃ স্কটল্যান্ডের একজন বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ এবং স্কটিশ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। তার লেখা কবিতা, সাহিত্য রচনা এবং ইতিহাস চর্চা করতে গিয়ে বার বার লক ক্যাটিরিনের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। এখানকার সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য তার সব থেকে জনপ্রিয় পদক্ষেপের মধ্যে ছিল বাষ্পচালিত স্টিমার। শত বছরের অধিক সময় ধরে পর্যটকদের মনোরঞ্জন করে চলেছে এই স্টিমার। স্যার ওয়াল্টার স্কট পতাকাবাহী বিখ্যাত এই স্টিমারে চড়ে এক সঙ্গে যেমন জানা যাবে এর ইতিহাস, অজানা অভিযানে সামিল হওয়ার পাশাপাশি একরাশ প্রশান্তিতে ভরে উঠবে মন। এখানেই শেষ নয়। আরও কিছুটা পথ যেতে এখনও যে বাকি। সকলে মিলে গাড়িতে উঠে পড়লাম। মাত্র দশ মিনিটের ড্রাইভ। একদিকে উঁচু পাহাড় আর অন্যপাশে লেক, মনোরম দৃশ্য সর্বত্র বিরাজমান। মনে পড়ে গেল সেই বিখ্যাত গানের কলি ‘এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো বল তো’ পথ আসলে শেষ হয়না। কিন্তু এই প্রথম দেখলাম পথেরও শেষ হয়। পহাড়ের ঢাল দিয়ে নেমে এলাম আর এক লেকের কিনারে। এখানেও মানব সভ্যতার কিছু নিদর্শন চোখে পড়ল। বেশ কয়েকখানা বাড়ি অনেক যতেœ সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয়েছে। একটু খোঁজ করতেই জানা গেল এগুলো কটেজ। আমাদেরই মতো যারা বেড়াতে আসেন, কাটাতে চান এই নির্জন মনোরম পরিবেশে রাতের পর রাত, তাদেরই জন্য তৈরি করা হয়েছে আবাসন। গাড়ি থেকে নামতেই কিসের যেন অবিরাম আওয়াজ কানে ভেসে আসতে লাগল। কয়েক পা এগিয়ে যেতেই অবাক হয়ে গেলাম ও মা, এ যে দেখি ঝরনা। বহুদূর থেকে উঁচু ঘন বনের মধ্য দিয়ে সাপের মতো এঁকে ঁেবকে জলের ¯্রােত দ্রুতলয়ে শ্বশব্দে প্রায় ত্রিশ ফুট গভীরে লেকের জলে আছড়ে পড়ছে। ঠিক ঝরনাটার উপরে তৈরি করা হয়েছে পাটাতন। বানানো আছে পাহাড়ে উঠার সিড়ি। ভয় কি? সিড়ি ধরে উপরে উঠে গেলেই চোখ জুড়িয়ে যাবে। একদিকে ঝরনা আর লেক। লেকের অপর পাড়ে পাহাড়ের হাতছানি। আর অন্যদিকে জঙ্গল। আমরা তো জঙ্গলের মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছি। কোনটা ছেড়ে কোনটাকে আগলে রাখি। কতক্ষণ কারও মুখে কোন কথা নেই, এদিক-ওদিক তাকিয়ে থাকা আর উপভোগ করা নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আঁধার।
×