ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

গহীন গর্জন বনে

প্রকাশিত: ০৭:৫১, ১৯ অক্টোবর ২০১৮

গহীন গর্জন বনে

যে কোন চাকরিজীবী মানুষের কাছেই ছুটি একটা আকর্ষণীয় শব্দ বা আনন্দের বিষয়। সাপ্তাহিক ছুটিতে খুব বেশি কিছু করা যায় না, ঘরবাড়ির কাজেই চলে যায়, তবে যদি সেই সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে একটা বন্ধ পাওয়া যায়! তা হলে তো ঈদের খুশি। তেমনি জন্মাষ্টমীর বন্ধসহ তিন দিনের লম্বা ছুটি পেলাম। অনেক দিনের পরিকল্পনা মেধাকচ্ছপিয়ায় ক্যাম্পিং করা। এই ক্যাম্প সাইট একদমই ভিন্ন রকমের। কক্সবাজার থেকে ৪৩ কিলোমিটার আগে মেইন রাস্তার পাশেই গহীন গর্জন বনে। এখানে আছে ফরেস্ট বিভাগের ছোট্ট একটা বাংলো, যেখানে আছে টাইলস করা ঘর আর সঙ্গে দুটো টয়লেট। ক্যাম্পিংয়ে সুবিধার জন্য আছে সর্বক্ষণিক নিরাপত্তা টেন্ট, স্লিপিং ব্যাগ, ম্যাট, পিলো আর খাবার পানির ব্যবস্থা। জড়ঢ়ব-৪ এর সদস্যদের মধ্যে আস্থা বাড়াতে এবং ক্লাইম্বিং ও অন্যান্য আউটডোর এক্টিভিটি প্র্যাকটিস করতে মাঝে মাঝে ২-৩ দিনের ক্যাম্প করা হয়। যা কোন লাভজনক আয়োজন নয়। তিন দিনের ছুটি পেয়ে তাই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ইভেন্ট দেয়া হলো। ঢাকা থেকে ১২ জন, চট্টগ্রাম আর সিলেট থেকে ১ জন করে মোট ১৪ জন, এর মধ্যে কয়েকজন আমাদের পূর্ব পরিচিত আর বাকি সবার সঙ্গে নতুন করে পরিচয় হয়েছে। আয়োজক হিসেবে আমাদের জন্য এটা একদম রিল্যাক্স ক্যাম্প, কোন রকম পরিকল্পনা করে যাওয়া হয়নি। কারণ এই ক্যাম্পটা কিছুটা সারভাইবাল হিসেবে সাজানো হয়েছে। কোন রকমের প্লানিং নাই তাই অংশগ্রহণকারীদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ক্যাম্পের সব কাজ নিজেদেরই করতে হবে। কে কোন্্ কাজ করবে তা ঠিক হয়েছে বিভিন্ন এক্টিভিটির মাধ্যমে। বৃহস্পতিবার ৩০ আগস্ট রাত ১১টা ৩০ মিনিটে যাত্রা শুরু করে পরদিন ভোর ৭টার দিকে আমরা ক্যাম্প সাইটে পৌঁছালাম। ট্রি এক্টিভিটির দিকে তাকাতেই এক অদৃশ্য মায়ায় মন ভরে গেল, মনে হলো এই তো সেদিন মাহির সঙ্গে সাজিদ, পলাশ, মুকিত আর স্থানীয় কর্মীর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল এই এক্টিভিটি, কাজ চলাকালীন আমি দু’বার এসেছিলাম আর দিনব্যাপী থেকে কিছু কাজও করেছিলাম। টঝঅরফ-এর আর্থিক ও জড়ঢ়ব৪-এর কারিগরি সহায়তায় বাংলাদেশ বন বিভাগের আওতায় চট্টগ্রাম ও সিলেটে ক্যাম্পিং জোন আর ট্রি এক্টিভিটি ডেভেলপ করা হয়েছে এবং স্থানীয়দের ক্যাম্প আর এক্টিভিটি পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। নিজেদের মধ্যে পরিচিতি পর্ব শেষে ছোট্ট একটা এক্টিভিটির মাধ্যমে আমরা দুটো দলে ভাগ হলাম, একদল ক্যাম্প সাইট পর্যবেক্ষণ করল আর এক দল বাজার আর রান্নার পরিকল্পনার কাজ করল। আমরা শুধু সকালের নাশতা বাজার থেকে কিনেছি, দুপুর আর রাতের খাবার আমরা নিজেরা রান্না করেছি। একদল চলে গেল বাজারে, সকালের নাশতা আর দুই দিনের বাজারসহ ফিরে আসল। নাশতা শেষে দুই দলের নামকরণ হলো, একদল প্রথমেই নিজেদের নাম ‘কচ্ছপিয়া’ ঠিক করে ফেলল আর অন্য দল স্বাভাবিকভাবেই ‘খরগোসিয়া’ হয়ে গেল। বেশ কয়েকটি দলগত খেলা হলো। জড়ঢ়ব৪-এর অনেকগুলো কার্যক্রমের মধ্যে দলগত খেলার মাধ্যমে দল গঠন করা অন্যতম। এতে করে সহজেই দলের সবার স্বেচ্ছাসেবী মনোভাব তৈরি হয় এবং দলনেতা হওয়ার দক্ষতা তৈরি হয়। যে কোন ক্যাম্পেই নানা ধরনের মানুষের সংমিশ্রণ ঘটে, যাতে কেউ থাকে অনেক হাস্যোজ্জ্বল আবার কেউ থাকে একটু গম্ভীর স্বভাবের, কারও কারও থাকে দাম্ভিকতা আবার কেউ হয় ভাবলেশহীন সহজ-সরল মানুষ। হিউম্যান রিসোর্স নিয়ে পড়ালেখার কারণেই হয়ত আমি বিভিন্ন মানুষের বিশেষণ করে মজা পাই। এই ক্যাম্পেও ছিল কিছু মজাদার মানুষ যারা নিজেদের হাসি ঠাট্টা দিয়ে জমিয়ে রেখেছিল আবার এমন মানুষও ছিল যে কিনা পৃথিবীর ওপরই বিরক্ত। ক্যাম্পটিতে বয়সে ছোট-বড় মিলে সমতার এক সুন্দর সমন্বয় ছিল। কিছু কিছু মানুষের স্বেচ্ছাসেবীতা যেমন অবাক করেছে আবার কাজকে বাইপাস করার সুদক্ষ প্রতিভাতেও আমি মুগ্ধ হয়েছি। ক্যাম্পের আকর্ষণীয় বিষয় ছিল নিজেরা রান্না করা, সবার ছোট ছোট অবদানে এক এক বেলার খাবার পরিবেশনা। আমার ভাগে তেমন কাজ আসেনি, আলু পেঁয়াজ কাটা, চাল-ডাল ধুয়ে দেয়া আর সালাদ বানানোর মধ্যেই আমার অবদান সীমাবদ্ধ ছিল। বৃষ্টির জন্য ইট দিয়ে বানানো চুলায় আগুন ধরাতে বেশ বেগ পেতে হলো আর এর মাঝেও কিছু মানুষের ভেতরের স্বেচ্ছাসেবী অবদান দেখা গেল যা কোন লোক দেখানো বা প্রশংসা নির্ভর না। শুভ, যাকে মনে হচ্ছিল একদম চুপচাপ আর তেমন কোন কাজের না, রান্নার সময় চুলার আগুন বহমান রাখতে ওর অবদান অনস্বীকার্য। ক্যাম্পের প্রথম দিন দুপরের খাবার ছিল ভাত, মুরগির মাংস, বেগুন ভাজা আর ডাল। রাতে ছিল আলু ভর্তা আর ডাল সঙ্গে কিছুটা দুপুরের রয়ে যাওয়া মুরগির তরকারি। মূল এক্টিভিটির স্থান থেকে কিছুটা ট্র্যাকিং পথ ছিল আমাদের প্রথম রাতের ক্যাম্প সাইট, মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজে ঘেরা, সঙ্গে সারি সারি গর্জন গাছ আর কয়েকজন প্রকৃতি প্রেমী মিলে এক স্বর্গীয় অনুভূতি। ক্যাম্প সাইট পরিষ্কার করে আমরা সবাই টেন্ট পিচ করলাম, কারও কারও জন্য ছিল যা প্রথম বারের অভিজ্ঞতা। সেখানে আমরা চা খেলাম, মূল ক্যাম্প সাইট থেকে রাতের খাবার শেষ করে চলে গেলাম টেন্ট এরিয়াতে। ক্যাম্পিংয়ে রাতের আকর্ষণ মাফিয়া খেলা হলো। তারপর ঠিক হলো পালা করে রাতভর পাহারা দিতে হবে কারণ মেধাকচ্ছপিয়ার অন্যতম আকর্ষণ বন্য হাতির আনাগোনা। ক্যাম্প সাইট ডেভেলপ করার সময় হাতির পায়ের ধাক্কায় বাংলোর ভেতরেই চার্জার ফ্যান পড়ে গিয়েছিল। জোড়ায় জোড়ায় ক্যাম্প পাহারা চলল, আমার রোস্টার ছিল ভোর চারটায়, আমি উঠতেই একজন বলল যে আগের জোড়ার রোস্টার কিছুক্ষণ আগেই শুরু হয়েছে, তাই আমি ঘুমাতে পারি। ভোরবেলা স্থানীয় প্রহরী এসে টহল দিয়ে গেল। মুখোমুখি হলাম ভোরের সৌন্দর্যের, অন্যরকম এক অনুভূতি। পাশের টেন্টে নাক ডাকার শব্দ শুনেই ছুটে গেলাম রেকর্ড করতে যেন পরে পচাতে পারি। দ্বিতীয় দিন সকালের নাশতা শেষ হতে না হতেই শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি! বৃষ্টিতেই চলল ব্যায়াম, ট্র্যাকিং আর প্রতিযোগিতা। বৃষ্টির মধ্যে পাহাড়ী পথচলা, কিছুটা পিচলে যাওয়া, চোখে ঝাপসা দেখা সব মিলে এক অন্যরকম ভাললাগা! সবশেষে আমি আর মাহি ক্যাম্পে পৌঁছালাম ট্রেইলের যাবতীয় প্লাস্টিক কুড়াতে কুড়াতে। এ রকম একটা নৈসর্গিক স্থানে মানুষ কিভাবে চিপস/চকোলেট/পানির খালি বোতল ফেলে যায়? আমার দেশটার জন্য আমার অনেক মায়া হয়, আমরাই আমাদের ভূমিকে দিন দিন বসবাসের অযোগ্য করে দিচ্ছি!
×