ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বই ॥ নয়া বসত

প্রকাশিত: ০৭:৫৬, ১৯ অক্টোবর ২০১৮

বই ॥ নয়া বসত

আব্দুল মান্নান সরকার এর লেখা ‘নয়াবসত’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১৪ সালে। নয়া বসত সম্পর্কে লিখতে গিয়ে প্রথমেই লিখতে হচ্ছে যে এটি লেখকের একটি উচ্চাভিলাষী উপন্যাস। উচ্চাভিলাষী বলা এ কারণে যে, লেখক একটি জনপদের প্রায় সমস্ত কিছুকে তুলে আনতে চেয়েছেন তার এই উপন্যাসে। দক্ষিণ বাংলার একটি বিশেষ অঞ্চল লেখক যার নাম দিয়েছেন মায়ার চর, যা একটি ছদ্মনাম। ভোলা জেলার বিশেষ কোন চর, সেখানে প্রথম জন বসতি গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে তার চলমান ইতিহাস, ঐতিহ্য, জীবনযাপন, আর্থসামাজিক অবস্থা, পরিবেশ পরিস্থিতি সমস্ত কিছুই তিনি কাহিনীর বুননে তুলে ধরতে চেয়েছেন। নয়া বসত উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীর ব্যক্তিগত জীবন কাহিনী স্পষ্টত অগ্রসর হয়েছে লেখকের নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও চাহিদাকে কেন্দ্র করেই। এখানে লেখকের মুন্সিয়ানা খুবই লক্ষণীয়। প্রধান ও অন্যান্য চরিত্র, তাদের আচার-আচরণ সংগঠিত হচ্ছে কাহিনীর ছক অনুযায়ীই, তাদের ব্যক্তিগত উত্থান-পতন ও বিস্তৃতভাবে অংকিত হয়েছে, আবার একই সঙ্গে একটি জনপদের সামষ্টিক জীবনযাপনের অভ্যাস ও সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে তা। এরকম বৈশিষ্ট্য বাংলা ভাষার হাতেগোনা কিছু উপন্যাসেই শুধু আছে। নয়াবসত উপন্যাসের শৈল্পিক কাঠামো বা এ সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্যের প্রসঙ্গে আলোচনার আগে আমরা এর কাহিনীর দিকে একবার নজর বুলিয়ে নিতে পারি। কাহিনীর শুরু হয়েছে চর অঞ্চলের লাঠিয়াল সরদারের জীবন কথার মধ্য দিয়ে। মূল উপন্যাস থেকেই খানিকটা উদ্ধৃত করা যেতে পারে, ‘বহু বছর আগে চৈত্র সংক্রান্তির এক রাতে কুরান মৃধা ছেলের হাতে লাঠি তুলে দিয়ে বলেছিল, ‘শক্ত আতে লাডি দর’ লাডি খেলা হিক্কা রাক’ এই যার মাইর প্যাচ বালা কইরা বুজতে হইবে। আর মনে রাইকতে হইবে এইডা খালি খেলা না, এই লাডি তোরে ভাত কাপুড় যোগাইবে হারা জীবন’। বাপের কথাগুলো মন্ত্রশক্তির মতো কাজ করেছিল ছেলে করিমের উপর। অভিষেকের আয়োজন ছিল বেশ জাঁকালো। জোতদার আনু খাঁ সে আয়োজন করেছিল। হাজার বিঘা জোত জমির মালিক, তার দাপট শক্তির প্রদর্শনী না করলে চলে না। নিজের বাহিনী, আশপাশের চরগুলোর নামকরা সব লাঠিয়ালকে দাওয়াত করে আনা হয়েছিল, আর তাদের গরু খাসি জবাই করে মেহমানদারি করেছিল আনু খাঁ (পৃষ্টা-৭)’। অস্ত্রের শক্তিই ছিল সেই সব চর অঞ্চলের দখল দারিত্বের মূল। কাজেই কুরান মৃধার মতো লাঠিয়াল সরদারের কদর ছিল জোতদারের কাছে। কিন্তু সেই কুরান মৃধাই শেষবার জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আর লাঠি ধরবে না বলে প্রতিজ্ঞা করে। সে ছেলে করিমকে জাঁকজমকের সঙ্গে লাঠি খেলায় দীক্ষা দিয়েছিল তাকেও নিবৃত্ত করে লাঠিধরা থেকে। খুব অপ্রত্যাশিত হলেও এই পরিবর্তন কিন্তু কাহিনীর গতি পথকে ভিন্ন দিকে প্রভাবিত হতে সাহায্য করে। এখানে এই পরিবর্তনের কারণও কিন্তু লেখক পরবর্তী অধ্যায়ে ব্যাখ্যা করেছেন। কুরান মৃধা জেলে থাকতে কোন এক বামপন্থী রাজনীতিকের সংস্পর্শে আসেন। সেখান থেকে হয়তো আর এই মনোজগতের পরিবর্তন ঘটে থাকতে পারে। যে করিম মৃধার নিয়তি ছিল জোতদারের লাঠিয়াল হওয়া, বাপের এই পরিবর্তনের জন্য তার শান্তি ও স্বস্তির জীবনের পথ খুলে যায়। সে কিছুদিন আনু খাঁর বাথানে গরু-মহিষের পরিচর্যার কাজ করে। তারপর তার সুযোগ হয় ভিন্ন জীবনের পা দেওয়ার। এই ভিন্ন জীবন হচ্ছে নতুন বাসস্থান গড়ার কর্মকা-। বঙ্গোপসাগরের মধ্যে নতুন চর জেগে উঠলে সেখানে লোক বসতি স্থাপনের জন্য জমি বরাদ্দ দেয় সরকার। মাথা পিছু পাঁচ একর করে জমি দেওয়া হবে এই আশ্বাস পেয়ে করিম মৃধা ও তার আরও কিছু সহগামী চলে বসতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে বহু পুরুষের বসতি ছেড়ে যায়। তারা দীর্ঘ নদীপথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছেছিল সেই জঙ্গাকীর্ণ এক নয়া ভূখ-ে। এই ভূখ- তারা সরকার থেকে বন্দোবস্ত পেয়েছিল। কুড়িটি নৌকায় করে মোট চল্লিশটি পরিবার গিয়েছিল। চরটি ছিল একটি বাদাবন। তারাদিন রাত পরিশ্রম করে জঙ্গল কেটেছিল, সাপ খোপের সঙ্গে সংগ্রাম করে সেখানে জন বসতি গড়ে তুলেছিল। তার বর্ণনা লেখক দিয়েছেন নিবিড় পর্যবেক্ষণে আর গভীর বিশ্বস্ততার সঙ্গে। সেই ভূখ-ে এই সব মানুষের জীবন যাত্রাই হলো নয়া বসতের মূল কাহিনী। কিন্তু এই সব মানুষ বলতে সেই ভূখ- শুধু সেই চল্লিশ পরিবারেই সীমিত থাকেনি, চরটি বাসযোগ্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে এসেছে আরও অনেক মানুষ। এসেছে ভালো মানুষেরা, আবার এসেছে লোভী ও সুযোগ সন্ধানী মানুষেরাও। সমস্ত মিলে এক জমজমাট জীবনযাত্রার ঠিকানা হয়ে উঠেছে নয়াবসতের এই জনপদ। সেই ১৯৭০ এর ভয়াল জলোচ্ছ্বাস আজও রক্তে তোলপাড় তোলে। লেখক সেই ভয়ঙ্কর জলোচ্ছ্বাসের রাতের চিত্র এঁকেছেন যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস নিয়ে। সত্যিকার অর্থে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছাড়া যথার্থ বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। সেই বিভীষিকার। লেখকের চিত্রায়ন মূর্ত করে তোলে সেই রাত্রিকে। একই রকমভাবে সমুদ্রে ট্রলারে করে মাছ মারার দৃশ্যায়ন এ বাস্তবের কাছাকাছিই পৌঁছে যায়। সমুদ্রে চোরাচালান কিংবা মাছ আহরণ বড় ক্যানভাসের সম্ভাবনা জাগায়, লেখক সেখানে বিস্তারিত বলার ভঙ্গিতে বয়ান করেন। আবার অনেক সময় উপর থেকে ভাসা ভাসাভাবে দেখার মতো করে দেখেন তিনি কাহিনীর বর্ণনার ক্ষেত্রে। এখানে অপ্রাসঙ্গিক সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম এই অঞ্চলের মানুষগুলোকে রক্ষ করে তোলে। সেই রক্ষতাকেই লেখক তুলে আনতে পেরেছেন, নয়াবসত উপন্যাসের বিশেষ সার্থকতা এখানেই। ইয়াসির আজিজ
×