ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

অন্নপূর্ণা দেবী ও কিছু স্মৃতি

প্রকাশিত: ০৭:৫৭, ১৯ অক্টোবর ২০১৮

অন্নপূর্ণা দেবী ও কিছু স্মৃতি

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কন্যা, অনন্য সাধারণ সঙ্গীতগুরু, আমাদের সিনিয়া-মাইহার ঘরানার মাতৃসমা, ‘গুরুমা’ অন্নপূর্ণা দেবী আর নেই। ১৩ অক্টোবর মুম্বাইয়ের ব্রীচ ক্যান্ডি হাসপাতালে স্থানীয় সময় ভোর ৩টা ৫১ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রূপকথার রাজকন্যার মতো এক গল্প এ অসামান্যা নারীর জীবন। ১৯২৭ সালের চৈতী পূর্ণিমা রাতে ১৬ এপ্রিল (মতান্তরে ২৩ এপ্রিল) ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও মদিনা বেগমের মেয়ে রোশনারার জন্ম হয় ভারতের মাইহার রাজ্যে (বর্তমানে মধ্য প্রদেশের অন্তর্গত)। মাইহারের রাজসভার সঙ্গীতশিল্পী তখন বাবা আলাউদ্দিন খাঁ। জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই মাইহারের মহারাজা ব্রিজনাথ সিং মেয়ের নাম রাখেন ‘অন্নপূর্ণা দেবী’। আর এ নামেই তিনি সারাজীবন পরিচিত হন। তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা বিয়ের পর সঙ্গীতচর্চা করতে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় কনিষ্ঠা কন্যাকে সঙ্গীতে তালিম দিতে চাননি বাবা আলাউদ্দিন খাঁ। কিন্তু শিশু অন্নপূর্ণার সঙ্গীতে অসাধারণ মেধা দেখে শেষ পর্যন্ত তাঁকে তালিম দিতে শুরু করেন। বাবা আলাউদ্দিন খাঁর কাছে ভাই আলী আকবর খাঁ এবং বাবার অন্যান্য শিষ্যদের সঙ্গে তালিম গ্রহণ করেন অন্নপূর্ণা। বাবা বাজাতেন সরোদ, সুরবাহার। মেয়েকে শেখালেন সুরবাহার। বাবার শিষ্যদের অন্যতম ছিলেন রবি শঙ্কর। সেতার শিখতেন বাবার কাছে। ১৯৪১ সালে ১৪ বছর বয়সে রবি শঙ্করের সঙ্গে বিয়ে হয় অন্নপূর্ণা দেবীর। দুজনে একসঙ্গে বাজিয়েছেন কলকাতায়, দিল্লীতে, নানা অনুষ্ঠানে। রবি শঙ্করের চেয়ে অন্নপূর্ণার বাজনা মানুষকে বেশি মুগ্ধ করা, দর্শকশ্রোতার প্রশংসা অন্নপূর্ণা দেবী বেশি পাওয়া রবি শঙ্কর মেনে নিতে পারেননি। সংসার বাঁচাতে তাই অন্নপূর্ণা দেবী জনসম্মুখে বাজানো বন্ধ করে দেন। তাঁদের সে কাহিনীর ছায়া অবলম্বনেই ‘অভিমান’ চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছিল বলে অনেকেই মনে করেন। কিন্তু তারপরও সে বিয়ে টেকেনি। ’৬২ সালে বিচ্ছেদ ঘটান রবি শঙ্কর। ’৪২ সালে জন্ম নেয়া একমাত্র সন্তান শুভেন্দ্র শঙ্করকে তালিম দিয়ে তৈরি করছিলেন মা অন্নপূর্ণা দেবী। রবি শঙ্কর তাও পছন্দ করেননি। নিরবচ্ছিন্ন তালিমের ইতি টেনে ছেলে শুভকে নিজের কাছে আমেরিকায় নিয়ে যান। শুভ বাবার সয়েমড় বাজানো ছাড়া এককভাবে শিল্পী হিসেবে বাজাননি। অল্প বয়সে বিয়ে এবং তিন সন্তানের জন্মের পর শুভ ১৯৯২ সালে মারা যান। ১৯৭৩ সালে ভারতে লেকচার দিতে এসেছিলেন রুশিলংমার পানডিয়া আমেরিকা থেকে। তিনি তখন নামী ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট। সেতারবাদক হিসেবেও সুনাম ছিল তাঁর। ভাই ওস্তাদ আলী আকবরের অনুরোধে তাঁকে তালিম দিতে রাজি হন অন্নপূর্ণা দেবী। প্রস্তাব পাবার দীর্ঘ সময় পর ১৯৮২ সালে রুশিকুমারজীকে বিয়ে করতে সম্মত হন তিনি। তিনি বলেছিলেন বিয়ে করে আবার কষ্ট পেতে চান না। রুশিকুমারজী ২০১৩ সালে ৭৩ বছর বয়সে আকস্মিকভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করা পর্যন্ত ছিলেন তাঁর নিত্যসঙ্গী। অন্নপূর্ণা দেবীকে পরম যতেœ আগলে রেখেছিলেন তিনি। অন্নপূর্ণা দেবী পঞ্চাশের দশকে জনসম্মুখে বাজানো বন্ধ করেছিলেন। আর কখনও জনসম্মুখে তিনি বাজাননি। তালিম দিয়েছেন শিষ্যদের। নীরবে নিভৃতেই সঙ্গীত নিয়ে জীবনযাপন করেছেন। কালেভদ্রে দুয়েকটি যে সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতকার তাঁর সারাজীবনে প্রকাশিত হয়েছে তা থেকেই তাঁকে জানবার সুযোগ পেয়েছে মানুষ। তাঁর কোন বাজনা তিনি কখনও এ্যালবাম হিসেবে প্রকাশ করেননি। পঞ্চাশের দশকের অনুষ্ঠানগুলোর কোন কোনোটির বাজনা কারও কারও ব্যক্তিগত রেকর্ডিং থেকে পাওয়া গেছে যা এখন ইন্টারনেটের বদৌলতে শুনবার সুযোগ পায় সঙ্গীতপ্রেমীরা। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে আছেন তাঁর ভাই ওস্তাদ আলী আকবর খাঁর ছেলে সরোদ শিল্পী আশীষ খাঁ, বাঁশীবাদক প-িত নিত্যানন্দ হলদিপুর ও প-িত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, সিতারবাদক প-িত নিখিল ব্যানার্জী। এঁদের মধ্যে প-িত নিত্যানন্দ হলদিপুর সেই আশির দশকের মধ্যভাগ থেকে ‘গুরুমা’র সঙ্গে ছিলেন তাঁর শিষ্য হিসেবে, সন্তানের মতো প্রতিদিন। গুরুমা’র সকল প্রয়োজনে তাঁর পাশে থেকেছেন। বিশেষ করে রুশিকুমারজীর মৃত্যুর পর ‘গুরুমা’কে পরম যতেœ আগলে রেখেছিলেন নিত্যানন্দদা। আমার প্রয়াত শ্বশুর আমিনর রহমান ছিলেন কিংবদন্তি বংশীবাদক পান্নালাল ঘোষের প্রথম দুজন শিষ্যের অন্যতম। তিনি ‘সিনিয়া ঘরানার খলিফা’ হিসেবে খ্যাত ওস্তাদ দবীর খাঁরও শিষ্য ছিলেন। পান্নাবাবু ‘বাবা’ আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। আবার ‘বাবা’ আলাউদ্দিন খাঁ ছিলেন ওস্তাদ দবীর খাঁর দাদা ওস্তাদ ওয়াজির আলী খাঁ-এর শিষ্য। আলাউদ্দিন খাঁ তাঁর ছেলে আলী আকবর খাঁকে ওস্তাদ দবীর খাঁর কাছে পাঠিয়েছিলেন তালিমের জন্য। বাবা ওস্তাদ দবীর খাঁর চেয়ে বয়সে ও সুনামে অনেক বড় হলেও সঙ্গীতের জগতের রীতি অনুযায়ী তাঁর নিজের গুরুর বাড়িতে ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন দীক্ষা সম্পন্ন করতে। আলী আকবর বাবার লেখা চিঠি নিয়ে এসেছিলেন দবীর খাঁ সাহেবের কাছে। চিঠিটি ছিল বাংলায় লেখা। সেটি পড়ে তার অর্থ বুঝিয়ে বলার দায়িত্ব পড়েছিল আমিনর রহমানের ওপর। ‘বাবা’ লিখেছিলেন, তিনি যতদূর সম্ভব ছেলেকে তালিম দিয়েছেন, এবার পাঠাচ্ছেন ছেলেকে দবীর খাঁ সাহেবের কাছে তালিম সম্পন্ন করবার জন্য। প্রকৃতপক্ষে গুরুবাড়ির অনুমোদনের জন্যই পুরোপুরি তৈরি ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন তিনি। সে সূত্রেই আলী আকবর ও আমিনর রহমান গুরুভাই, সতীর্থ। একই সময়ে তাঁরা শিষ্য ছিলেন দবীর খাঁর। আমার শ্বশুর ওস্তাদ দবীর খাঁর সূত্রে সিনিয়া ঘরানা এবং পান্নাবাবুর সূত্রে সিনিয়া-মাইহার ঘরানার। আমার স্বামী ও ছেলে সে সূত্রে সিনিয়া ও সিনিয়া-মাইহার ঘরানার উত্তরসূরি। নিত্যানন্দদার সঙ্গে আমার স্বামীর সম্পর্ক তিন দশকের অধিক সময়ের। অন্নপূর্ণা দেবী আমার স্বামী আর ছেলের বাজনা শুনতে নিত্যানন্দদাকে দিল্লীতেও পাঠিয়েছিলেন। ওঁদের সম্পর্ক প্রতিদিনের। রোজ সকাল শুরু হয় দুজনেরই মেসেজ বিনিময়ের মধ্য দিয়ে। প্রতিদিনই ‘গুরুমা’ কেমন আছেন, কোন রাগের তালিম এখন চলছে, কি বলছেন ‘গুরুমা’ সেদিন, এমনসব তথ্য বিনিময় চলে রোজ। আজ মেসেজটি এসেছে স্বাভাবিক সময়ের অনেক আগেই। আমাদের সময় ভোর ৪টা ৩৯ মিনিটে। নিত্যানন্দ দা জানালেন অন্নপূর্ণা দেবীর চলে যাবার খবরটি। মনে পড়ল ২০১১ সালের ৩০ জুনের কথা। সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাসে অংশ নিয়ে সে সন্ধ্যায়ই রওনা হয়েছিলাম ইউরোপে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে যোগ দিতে। যাত্রাপথে মুম্বাইয়ে ছিলো ৬ ঘণ্টার যাত্রাবিরতি। ঢাকা বিমানবন্দর থেকেই হঠাৎ মনে হওয়ায় স্বামীকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম মুম্বাইয়ে যাত্রাবিরতির সময় অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গে দেখা করবার কোন সুযোগ হবে কি না। বললেন কথা বলে দেখবেন। একটু পরেই জানালেন রুশিকুমারজী অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন যেতে। তাঁকে বলা হয়েছে, ‘এক ত্রিপুরার মেয়ে আরেক ত্রিপুরার মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে চায়।’ (তাঁর বাবার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর আমার বাবার বাড়ি চাঁদপুরÑদুটোই একসময় ত্রিপুরার অংশ ছিল।) নিত্যানন্দ দা মুম্বাই বিমানবন্দর থেকে নিয়ে যাবেন অন্নপূর্ণা দেবীর ফ্ল্যাটে। শুনেই আমি শিহরিত বোধ করলাম। যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম তখন কিন্তু সত্যিই ভাবিনি দেখা করার সুযোগ পাব। কারণ তিনি কারও সঙ্গে দেখা করেন না। মুম্বাই পৌঁছে নিত্যানন্দদার সঙ্গে গেলাম ‘গুরুমা’র বাসায়। দরজা খুললেন রুশিকুমারজী। সাদরে নিয়ে ছোট্ট বাসার বসার ঘরে নিয়ে বসালেন। আমার সঙ্গে ছিলেন আমার তৎকালীন পিএস, বর্তমানে ভুটানে আমাদের মান্যবর রাষ্ট্রদূত জিষ্ণু রায় চৌধুরী। একটু বাদেই তিনি ঘরে ঢুকলেন। সাদা আদ্দি কাপড়ের তৈরি লম্বা শোবার পোশাক। চুল দুটো বেণী করা। হালকা পাতলা ছোটখাটো গড়নের ৮৪ বছর বয়সী শ্যামলা এক নারী। ধীর পায়ে স্মিত হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। দুহাত বাড়িয়ে দিলেন। আমার দুহাত ধরে তাঁর সামনে বসালেন। আমি অভিভূত। বাকরুদ্ধ যেন। মোলায়েম স্বরে কথা বললেন। আমার দুই গাল বেয়ে তখন অশ্রু ঝরছে। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে তাঁকে জানালাম আমরা তাঁকে কত ভালবাসি। শুনলাম, বললাম আরও অনেক কথা। আপ্যায়িত হলাম। ফিরে আসবার আগে বললাম, “আপনি একবার আসুন বাংলাদেশে। ‘বাবা’ আলাউদ্দিন খাঁর মেয়ে অন্নপূর্ণা দেবী আমাদের সম্পদ। আমরা তাঁকে একবার আমাদের মাঝে পেতে চাই।’’ বললেন ইচ্ছে করলেও পারেন না আসতে। দুজনে দুজনার হাত ধরে বসে থাকা, হাসি, কান্না, দু হাতে চুমু দেয়া, বুকে জড়িয়ে ধরা, কথা বলাÑ মনে হলো যেন দীর্ঘদিন বাদে আবার দেখা হয়েছে খুব আপন দুই বাঙালী মেয়ের। কিছুক্ষণের সে আদর, স্নেহ, ভালবাসা, আশীর্বাদ আমার মনের মধ্যে চিরদিনের জন্য গেঁথে রইল। তিনি চলে গেলেন। অন্নপূর্ণা দেবী, আপনি শান্তিতে থাকুন। আপনার স্মৃতি চিরদিন অম্লান থাকবে।
×