ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রামবাংলার ঐতিহ্য, গৃহস্থের সমৃদ্ধির প্রতীক

প্রকাশিত: ০৪:৪৯, ২০ অক্টোবর ২০১৮

গ্রামবাংলার ঐতিহ্য, গৃহস্থের সমৃদ্ধির প্রতীক

বিশ্বজিৎ মনি ॥ একদা ‘গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ’ এই ছিল গ্রামবাংলার গৃহস্থের ঐতিহ্য। কার কয়টা ধানের গোলা আছে, কার কয়টা পুকুর আছে, তা দিয়ে বিচার করা হতো কে কত বড় বিত্তশালী। সেই গ্রামবাংলার সমৃদ্ধির প্রতীক ধানের গোলা এখন বিলুপ্ত প্রায়। হারিয়ে যাচ্ছে কৃষকের ঐতিহ্যবাহী এই ধানের গোলা। মাঠের পর মাঠ ধানক্ষেত থাকলেও অধিকাংশ কৃষকের বাড়িতে নেই আজ ধান মজুদ করে রাখার সেই বাঁশ-বেত ও কাদা দিয়ে তৈরি ধান রাখার গোলাঘর। অথচ এক সময় সমাজের নেতৃত্ব নির্ভর করত কার কটি ধানের গোলা আছে এই হিসাব কষে। কন্যা পাত্রস্থ করতেও বর পক্ষের বাড়ি থেকে ধানের গোলার খবর নিত কনে পক্ষের লোকজন, যা এখন শুধুই রূপকথা মাত্র। বরের বাড়িতে কটা ধানের গোলা আছে তার ওপর নির্ভর করে বরের বাবার আয়-অবস্থা বিচার করা হতো। ধানের গোলা না থাকলে সে ঘরে কন্যা সম্প্রদান করতে চাইতেন না গৃহস্থরা। বিগত দিনে গ্রাম অঞ্চলে বাড়িতে বাড়িতে বাঁশ দিয়ে গোল আকৃতির তৈরি করা ধানের গোলা বসানো হতো উঁচুতে। গোলার মাথায় থাকত টিনের তৈরি পিরামিড আকৃতির টাওয়ারের মতো, যা দেখা যেত অনেক দূর থেকে। গোলা নির্মাণ করার জন্য বিভিন্ন এলাকায় আগে দক্ষ শ্রমিক ছিল। এখন আর দেশের বিভিন্ন জেলায় শহর থেকে আসা গোলা নির্মাণ শ্রমিকদের দেখা মিলে না। পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় নিয়োজিত হয়ে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছেন তারা। গ্রাম অঞ্চলে বাড়িতে বাড়িতে বাঁশ, বাঁশ ফাটিয়ে কাবারি (বাতা) ও কঞ্চি দিয়ে প্রথমে গোল আকৃতির কাঠামো তৈরি করা হতো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বর্গ অথবা আয়তক্ষেত্র আকারে গোলা তৈরি করা হতো। এরপর তার গায়ের ভেতরে-বাইরে মাটির আস্তরণ লাগানো হতো। এর মুখ বা প্রবেশ পথ রাখা হতো বেশ ওপরে (ধান বের করার জন্য অনেকে নিচে বিশেষ দরজা রাখতেন) যেন চোর/ডাকাতরা চুরি করতে না পারে। ধানের গোলা বসানো হতো উঁচুতে। গোলার মাথায় থাকত বাঁশ ও খড়ের তৈরি বা টিনের তৈরি ছাউনি। গোলায় শুকানো ধানের চাল হতো শক্ত। কিন্তু সম্প্রতি রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও আধুনিক কলের লাঙ্গল যেন উল্টে-পাল্টে দিয়েছে গ্রামাঞ্চলের চালচিত্র। গোলায় তোলার মতো ধান আর তাদের থাকে না। গোলার পরিবর্তে কৃষকরা ধান রাখা শুরু করে ঘরের দোতলায় আবার যাদের একটু বেশি ধান উৎপাদন হয়, তারা স্থানীয় আড়তদারদের কাছে একটি হিসাব কষে বিক্রি করে দেন। তবে কালের সাক্ষী হয়ে আজও ধান রাখার গোলা রেখে স্মৃতি বহন করছেন, নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার উত্তরবাড়িতে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মরহুম দেওয়ান আজিজুর রহমানের বাড়িতে। সেখানেই পাঁচটি ধানের গোলা রয়েছে। মরহুম আজিজুর রহমানের ছেলে নিয়ামতপুর সদর ইউপি চেয়ারম্যান বজলুর রহমান নইম বলেন, আমার দাদার আমল থেকে রয়েছে এই ধানের গোলা। আমার দাদা, তারপর আমার বাবা তার আমরা সেই স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছি। আমাদের ছাড়াও এখানে আমার প্রতিবেশী মরহুম আনিসুর রহমানের ছেলেদের দুইটি এবং আমার মামা মরহুম আকতারুজ্জামানের ছেলে নিয়ামতপুর সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদ হাসান বিপ্লবের একটি ধানের গোলা রয়েছে। এছাড়াও নিয়ামতপুর উপজেলায় হাতে গোনা কয়েকটি ধানের গোলা রয়েছে মাত্র। এমন ধানের গোলা জেলার পোরশা উপজেলার পোরশা গ্রামসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় রয়েছে। বর্তমানে গোলা থাকলেও অনেক কৃষক গোলায় ধান রাখতে পারেন না। ধান আবাদের উপকরণ কিনতেই কৃষকের বিস্তর টাকা ফুরিয়ে যায়। তাই তাদের ইচ্ছে থাকলেও গোলা ভরে ধান রাখতে পারেন না। ক্ষেত থেকে ধান ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ফরিয়া পাইকারদের কাছে তারা ধান বিক্রি করে দেয়। বর্তমান যুগে এসে কৃষকের ধানের গোলা ও ডোলা এখন শহরের বিত্তশালীদের গুদাম ঘরে পরিণত হয়েছে। গ্রামের কৃষকরাও এখন গোলার পরিবর্তে ইটের তৈরি গুদাম ঘরে ধান রাখছে। ফলে গোলার কদর দিন দিন ফুরিয়ে আসছে। বর্তমানে কৃষকের ধান চলে যাচ্ছে এক শ্রেণীর অসাধু মুনাফা লোভী ফড়িয়া ও আড়তদার ব্যবসায়ীর দখলে। ইট বালু সিমেন্ট দিয়ে তৈরি পাকা গুদাম ঘরে মজুদ করে রাখা হচ্ছে হাজার হাজার মেট্রিক টন ধান-চাল। অনেক ক্ষুদ্র কৃষক বস্তা ও ব্যারেল ভর্তি করে রাখছে আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমে উৎপাদিত ধান চাল। বাস্তবতা বড়ই নিষ্ঠুর। আগামী প্রজন্মের কাছে গোলা ঘর একটি স্মৃতিতে পরিণত হচ্ছে। আধুনিক গুদাম ঘর ধানচাল রাখার জায়গা দখল করছে। ফলে গোলা ঘরের ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন।
×