ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোস্তাফা জব্বার

সরকার, শিল্প ও বাণিজ্যের ডিজিটাল রূপান্তর

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ২১ অক্টোবর ২০১৮

সরকার, শিল্প ও বাণিজ্যের ডিজিটাল রূপান্তর

আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার কৌশল হিসেবে শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তর ও ডিজিটাল দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ উন্নয়ন নিয়ে এর আগে আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি যে, কাজটি দারুণভাবে চ্যালেঞ্জিং। একটি ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থাকে ডিজিটাল দক্ষতা প্রদান করা হিমালয় ডিঙ্গানোর চাইতেও বড় কাজ। আমার নিজের মতে শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তর তথা ডিজিটাল দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ গড়ে তোলার চাইতেও কম চ্যালেঞ্জিং নয় ডিজিটাল সরকার প্রতিষ্ঠা করা। আমরা সেই কৌশলটা একই একটু বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই। ডিজিটাল বাংলাদেশ কৌশল ২ : সরকারের ডিজিটাল রূপান্তর ও জনগণের সকল সেবা ডিজিটালকরণ : সরকারের ডিজিটাল রূপান্তর ও জনগণের সকল সেবা ডিজিটালকরণ রাষ্ট্র ও সমাজের ডিজিটাল রূপান্তরের আরেকটি বড় বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকারের ডিজিটাল রূপান্তর। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সরকার নামক প্রতিষ্ঠানটি অত্যন্ত প্রাচীন। এর পরিচালনা পদ্ধতিও মান্ধাতার আমলের। আমরা এখন আধুনিক রাষ্ট্রনামক যে রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বলি এবং জনগণের সেবক সরকার হিসেবে যে সরকারকে চিহ্নিত করি তার ব্যবস্থাপনা বস্তুত প্রাগৈতিহাসিক। এক সময়ে রাজরাজরা সরকার চালাতেন। তবে সেই ব্যবস্থাকে স্থলাভিষিক্ত করেছে ব্রিটিশদের সরকার ব্যবস্থা। সেটি আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে বহন করে আসছি। ব্রিটিশরা চলে যাবার এতদিন পরও সেই ব্যবস্থা প্রবল দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করছে। কথা ছিল সরকার অন্তত শিল্পযুগের উপযোগী হবে এবং তার দক্ষতাও সেই পর্যায়ের হবে। কিন্তু কৃষি যুগ থেকেই আমরা শিল্পযুগের সরকার চালাতে শুরু করার ফলে মানসিকতাসহ সকল পর্যায়েই আমাদের সঙ্কট চরম পর্যায়ের। একদিকে সামন্ত মানসিকতা ও অন্যদিকে আমলাতান্ত্রিকতা সরকারকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। ৪৭ সালে একবার ও ’৭১ সালে আরেকবার পতাকা বদলের পরও ব্রিটিশ আমলাতন্ত্র বদলায়নি। একটি স্বাধীন জাতির জন্য যে ধরনের প্রশাসন গড়ে ওঠা দরকার সেটিও গড়ে ওঠেনি। কাজ করার পদ্ধতি রয়ে গেছে আগের মতো। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। ক. প্রথমত. সরকারী অফিসে কাগজের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বন্ধ করতে হবে। ২১ সালের পর সরকারী অফিসে কাগজ ব্যবহার করা যাবে না। সরকারের সকল অফিস, দফতর, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থায় কাগজকে ডিজিটাল পদ্ধতি দিয়ে স্থলাভিষিক্ত করতে হবে। এ জন্য সরকার যেসব সেবা জনগণকে প্রদান করে তার সবই ডিজিটাল পদ্ধতিতে দিতে হবে। এখানেও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারী দফতরের বিদ্যমান ফাইলকে ডিজিটাল ডকুমেন্টে রূপান্তরিত করতে হবে। নতুন ডকুমেন্ট ডিজিটাল পদ্ধতিতে তৈরি করতে হবে এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতেই সংরক্ষণ ও বিতরণ করতে হবে। এসব ডকুমেন্টের ডিজিটাল ব্যবহার এবং সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া ডিজিটাল করতে হবে। সরকারের মন্ত্রীবর্গসহ এর রাজনৈতিক অংশকেও এজন্য দক্ষ হতে হবে। সংসদকে ডিজিটাল হতে হবে। সংসদ সদস্যদেরও হতে হবে ডিজিটাল ব্যবস্থা ব্যবহারে দক্ষ। বিচার বিভাগকে কোনভাবেই প্রচলিত রূপে রাখা যাবে না। মামলা মোকদ্দমার বিবরণসহ, বিচার কার্যক্রম পরিচালনা সম্পূর্ণ ডিজিটাল হতে হবে। বিচারক ও আইনজীবীদের ডিজিটাল ব্যবস্থা ব্যবহারে দক্ষ হতে হবে। সরকারের আইনশ্ঙ্খৃলা রক্ষাকারী বাহিনীসমূহ, ভূমি ব্যবস্থা, স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত সকল সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে রূপান্তরিত করতে হবে। সরকারের কাছে থাকা অতীতের সকল তথ্য ডিজিটাল করতে হবে। সরকারের সকল ডাটা সুরক্ষিত রাখতে হবে। খ. দ্বিতীয়ত. সরকারের সকল কর্মচারী-কর্মকর্তাকে ডিজিটাল যন্ত্র দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে জানতে হবে। এজন্য সকল কর্মচারী-কর্মকর্তাকে ব্যাপকভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। নতুন নিয়োগের সময় একটি বাধ্যতামূলক শর্ত থাকতে হবে যে, সরকার যেমন ডিজিটাল পদ্ধতিতে কাজ করবে সরকারে নিয়োগপ্রাপ্তদের সেই পদ্ধতিতে কাজ করতে পারতে হবে। হতে পারে যে, প্রচলিত শিক্ষা-প্রশিক্ষণ থেকে এই যোগ্যতা কারও পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হবে না। এজন্য সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের শর্ত হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তির সাধারণ জ্ঞানকে একটি শর্ত হিসেবে রেখে এদের সকলের জন্য নতুন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে। জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থায় ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহারের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে শেখাতে হবে। গ. তৃতীয়ত. সকল সরকারী অফিসকে বাধ্যতামূলকভাবে নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকতে হবে এবং সকল কর্মকা- অনলাইনে প্রকাশিত হতে হবে। সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও সার্বক্ষণিকভাবে নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকতে হবে। সরকার যে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করছে তার সঙ্গে ডাটা সেন্টার স্থাপন, ডাটা সেন্টারের ব্যাকআপ তৈরি বা আরও প্রাসঙ্গিক কাজগুলো করতে হবে। ঘ. চতুর্থত. সরকারের সকল সেবা জনগণের কাছে পৌঁছানোর জন্য জনগণের দোরগোড়ায় সেবাকেন্দ্র থাকতে হবে। যদিও এরই মাঝে ইউনিয়ন পর্যায়ে ডিজিটাল কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে, তথাপি সিটি কর্পোরেশন ও তার প্রতি ওয়ার্ডে, পৌরসভা ও তার প্রতি ওয়ার্ডে এবং সামাজিক কেন্দ্র, বাজার, ডাকঘর ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ডিজিটাল কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। দেশজুড়ে থাকতে হবে বিনামূল্যের ওয়াইফাই জোন। জনগণকে সরকারের সঙ্গে যুক্ত হবার প্রযুক্তি ব্যবহারকে সকল সুযোগ দিতে হবে। থ্রিজির প্রচলন এই বিষয়টিকে সহায়তা করলেও এর ট্যারিফ এবং সহজলভ্যতার চ্যালেঞ্জটি মোকাবেলা করতে হবে। সারা দেশে বিনামূল্যের ওয়াইফাই ব্যবস্থা স্থাপন করতে হবে। ঙ. পঞ্চমত. দেশের বিদ্যমান সকল আইনকে জ্ঞানভিত্তিক সমাজের উপযোগী করতে হবে। সেই অনুপাতে আইন ও বিচার বিভাগ এবং আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহকে জ্ঞানভিত্তিক সমাজের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। রাষ্ট্রকে মেধাসম্পদ রক্ষা ও ডিজিটাল অপরাধ মোকাবেলায় সকল প্রকারের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। চ. ষষ্ঠত. সরকারের সঙ্গে যুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, আধা সরকারী প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহকে ডিজিটাল করতে হবে। অর্থনীতি, শিল্প-কল কারখানা, মেধাসম্পদ, আইন-বিচার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সামরিক বাহিনীকে ডিজিটাল করতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নিজেদের অক্ষমতা ও অযোগ্যতাকে অতিক্রম মাত্র ছয়টি করে পয়েন্টে যত ছোট করে আমি কাজগুলোর কথা উল্লেখ করেছি তাতে মনে হতে পারে খুব সহজেই বোধহয় সব হয়ে যাবে। কিন্তু আমি মনে করি সরকার যুদ্ধকালীন প্রস্তুতিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেও ২০২১ সালে একটি ডিজিটাল সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনে হিমশিম খাবে। আমি নিজে মনে করি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে ডিজিটাল সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এর প্রধানতম কারণ হচ্ছে সরকার তার নিজের প্রশাসনকে ডিজিটাল করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারেনি। সরকারের জনবলের মাঝে প্রযুক্তি ব্যবহারের অদক্ষতা ছাড়াও আছে দুর্নীতির প্রকোপ। ডিজিটাল ব্যবস্থা প্রয়োগ করা হলে সরকারের দুর্নীতিবাজ আমলারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে তারা ডিজিটাল রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে ঠেকিয়ে দেবার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ভূমি, বিচার, আইনশৃঙ্খলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশেষভাবে দুর্নীতির কোটারি আছে। এই খাতগুলোতে যদি কঠোরভাবে ডিজিটাল রূপান্তরের প্রয়াস গ্রহণ না করা হয় তবে ডিজিটাল সরকারের ধারণাই ভেস্তে যাবে। তৃতীয় কৌশল : শিল্প ও অর্থনীতির ডিজিটাল রূপান্তর : শিল্প ও অর্থনীতির ডিজিটাল রূপান্তর শিক্ষা এবং সরকার ডিজিটাল করার পর যা খুব দ্রুত ডিজিটাল হতে হবে তা হলো শিল্প ও অর্থনীতি। শিল্প-কল কারখানা-ব্যবসা-বাণিজ্য যদি প্রচলিত ধারার বাইরে বের হতে না পারে তবে যেমন করে আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজার অন্যের দখলে যাবে তেমনি আমরা প্রতিযোগিতার দুনিয়াতে টিকে থাকতে পারব না। খুবই প্রাসঙ্গিকভাবে এটি অনুভব করা দরকার যেÑ দুনিয়া চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কথা বলবে। এর মূল লক্ষ্য বস্তুত শিল্প কল কারখানাকে ডিজিটাল করা। এ জন্য আজকের দুনিয়াতে ব্যবসা বাণিজ্য ডিজিটাল হওয়াটা নতুন কোন ঘটনাই নয়। শিল্প কল কারখানা যদি ডিজিটাল না হয় তবে সেটিও দুনিয়াতে টিকে থাকতে পারবে না। এজন্য আমার কয়েকটি সুপারিশ হলো : ক. ব্যবসার কেনাকাটা, লেনদেনে ডিজিটাল করতে হবে। একটি কাগজের মুদ্রাবিহীন বাণিজ্যব্যবস্থা থেকে একটি ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। খ. ব্যবসার ব্যবস্থাপনাকে ডিজিটাল করতে হবে। প্রচলিত খাতা কলমের হিসাব-নিকাশ বা হাজিরা-বেতনকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে রূপান্তর করতে হবে। গ. উৎপাদন ব্যবস্থার যেখানে যেখানে ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার করা যায় সেখানে সেখানে ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে। প্রয়োজনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স বা আইটি প্রযুক্তির সহায়তা নিতে হবে। নতুন প্রযুক্তির পণ্য উৎপাদন করতে হবে এবং বিদ্যমান শিল্প কল কারখানার সঙ্গে নতুন প্রযুক্তি যুক্ত করতে হবে। ঘ. ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সকলকে ডিজিটাল শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। সাধারণ শিল্পযুগের দক্ষতা দিয়ে যে ডিজিটাল যুগের ব্যবসা-বাণিজ্য করা যাবে নাÑ তা সবাইকে বুঝতে হবে এবং সবাইকে সেভাবে প্রশিক্ষিত করতে হবে। ঙ. ব্যবসা বা শিল্পের ধরনকে সৃজনশীল খাতে প্রবাহিত করতে হবে। সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন ও আবিষ্কারকে ভিত্তি করে প্রচলিত পণ্যকে সৃজনশীল পণ্যে রূপান্তর করতে হবে। চ. সরকারকে তার অর্থনৈতিক কর্মসূচী জ্ঞানভিত্তিক কর্মসূচীতে রূপান্তর করতে হবে। সরকারের সকল পরিকল্পনাও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিকে বিবেচনায় রেখে করতে হবে। আমরা যে ২০৪১ সালে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলব এবং আমাদের অর্থনীতি যে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি হবে সেটি বিবেচনায় নিয়ে সকল অর্থনৈতিক কর্মকা- করতে হবে। আমাদের মনে রাখা দরকার যে, জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ছাড়া একটি উন্নত দেশ গড়ার স্বপ্ন কখনও পূরণ হবে না। লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান-সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক
×