ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

একটি কিশোর প্রাণের স্বপ্ন

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ২১ অক্টোবর ২০১৮

একটি কিশোর প্রাণের স্বপ্ন

আজ থেকে প্রায় পাঁচ শ’ বছর আগে থমাস মোর নামে এক ইংরেজ লেখক একটি বই রচনা করেছিলেন, যার নাম ইউটোপিয়া। শব্দটি তিনি গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর কাছ থেকে নিলেও মোর ইউটোপিয়ার মাধ্যমে এমন একটি সমাজের চিত্র অঙ্কন করতে চেয়েছিলেন, যেখানে মানুষের বসবাস হবে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে। তাঁর কল্পিত দ্বীপরাষ্ট্রটি ছিল আইন, সুশাসন ও পারস্পরিক সুসম্পর্কের প্রতীক। শ্রেণীবৈষম্য, দারিদ্র্য, ধর্মীয় হানাহানি, সম্পদের প্রতি অযাচিত লোভ ও যুদ্ধপ্রবণতা প্রশ্রয় পাবে না এই রাষ্ট্রে। যদিও বাস্তবে এই রাষ্ট্র অনুপস্থিত পৃথিবীতে তবু মানুষ তার স্বপ্নের সমান। সভ্যতার ঊষালগ্নে মানুষ যেসব স্বপ্ন দেখেছিল তার বাস্তব রূপ আজকের পৃথিবী। থমাস মোরের আদর্শ রাষ্ট্র গ্রন্থের দু’একটি স্মরণযোগ্য চরণÑ ‘সুন্দর মুখম-ল কাউকে কাছে টানতে সমর্থ হলেও তাকে ধরে রাখতে প্রয়োজন সুন্দর চরিত্র ও ভাল স্বভাব।’ তার গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো ‘কোন কিছুর মালিক না হয়েও যে কারও পক্ষে ধনী হওয়া সম্ভব। যেমন আনন্দ, দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন ও মনের শান্তির চেয়ে দামী কোন সম্পদ মানুষের কাজে আসে না।’ আমার মনে হয়, থমাস মোরের ইউটোপিয়া বাস্তবায়ন করা পৃথিবীতে এমন কোন কঠিন ব্যাপার নয়। এমন রাষ্ট্রের জন্য দরকার প্রশিক্ষিত নতুন মানুষ, যারা আনন্দময় সৃষ্টিশীল রাজ্যের বাসিন্দা হবে। আর সেই মানুষ তৈরির জন্য নিঃসন্দেহে কিশোর-কিশোরীরাই উপযুক্ত নাগরিক, যারা পৃথিবীর পথে এখনও সম্পূর্ণ অনগ্রসর হয়নি। আমাদের সামনে প্রতিনিয়ত শিশু-কিশোররাই বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে কর্মময় জীবনে প্রবেশ করছে- তাদের হাতেই অর্জিত হচ্ছে শ্রম ও আইনের অধিকার। পৃথিবীর সম্পদের মালিকানা বিবেচনা করলে দেখা যাবে; পৃথিবীর অধিকাংশ সম্পদের মালিক প্রবীণরা অথচ তারাই আনন্দহীন, ক্ষয়িষ্ণু জীবনচেতনা দ্বারা তাড়িত। অপরদিকে কিশোররা নিজে কোন সম্পদের মালিক না হওয়া সত্ত্বেও উদ্যম, সম্ভাবনা ও আনন্দময় জীবন যাপন করে থাকে। জীবন-জগত সম্বন্ধে কৌতূহল, অজানাকে জানা ও স্বত্বাধিকার অর্জনের অদম্য চেতনা তাদের আগামীর পথে চালিত করে। কিন্তু জীবনের পথে চলতে গিয়ে তারাও অচিরেই হারিয়ে ফেলে চারিত্রিক সৌন্দর্য ও বাহ্য-সম্পদহীন নিষ্কলুষ আনন্দ। কিশোররা সর্বদা তাদের আগে আসা মানুষদের অভিজ্ঞতা কিংবা তাদের অভীপ্সিত নায়কের কর্মপ্রেরণায় জীবনের সঙ্কট মোচন করতে চায়। কিন্তু তাদের সেই অভিজ্ঞতা প্রায়ই মধুর হয় না; বিদ্যমান সমাজের নানা কানা গলির ভেতর দিয়ে পথ চলতে গিয়ে পরিণামে তারাও একই কর্দমে প্রতীত হয়। কারণ কিশোর বয়সে সবাইকে এক অস্থির নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যদিও আমরা সবাই এই বয়সটি পার করে আসি তবু কেউ এর অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাই না। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, এ বয়সটিকে আমরা আপদ হিসেবেই বিবেচনা করে থাকি, তাদের- ‘আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি।’ থমাস মোরের অনেক আগেই শিশুদের শিক্ষা নিয়ে প্লেটো ব্যাপক চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন। সেসব শিক্ষা অতিরিক্ত সামরিকায়ন ও ব্যক্তি নিরপেক্ষ হওয়ায় সমালোচিত হলেও তার সম্প্রসারণ হিসেবে কেউ যদি একটি গ্রামকে প্রতীকী ‘কিশোর-গ্রাম’ হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন। যেখানে কিশোররাই থাকবে সার্বিক চেতনার কেন্দ্রে। যেহেতু সকল পিতা-মাতাই চায় তার সন্তানের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী, আর সেই বাসযোগ্য পৃথিবীতে তাদের কালের শিশু-কিশোররাই বসবাস করবে, সেহেতু সমাজের সকল কিশোর উন্নয়নে সামগ্রিক পরিকল্পনাই এর একমাত্র ভিত্তি হতে পারে। কেবল ব্যক্তি বিশেষের উন্নয়ন দ্বারা ব্যক্তি নিরাপদ থাকতে পারে না। যে সমাজে সে বসবাস করে সেই সমাজের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভারসাম্যের প্রয়োজন পড়ে। ব্যক্তি সংগঠন সরকারী কিংবা বেসরকারী যে কোন উদ্যোগে তা সম্ভব। ইতোমধ্যে পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের সম্মানিত সভাপতি আর্থ-দার্শনিক ড. খলীকুজ্জমান আহমদের নেতৃত্বে যার অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে- যার নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে কিশোরদের দ্বারা একটি বাসযোগ্য ইউটোপিয়া গড়ে তোলা অসম্ভব নয়। এটি সম্মিলিত প্রয়াসের দ্বারা অর্জিত হলেও সেই সব মানুষের নেতৃত্বে এগিয়ে আসতে হবে, যারা কিশোরদের নিয়ে আগামী দিনের বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন। কিশোরদের থেকে যে জিনিসটি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা প্রত্যাহার করে নিয়ে থাকে- তা হলো আনন্দ ও সৃষ্টিশীল অংশগ্রহণের ক্ষমতা। যারা একদিন এই পৃথিবীর আনন্দ সহযাত্রী হবে, অথচ তাদের আমরা বন্দিত্বের মধ্যে পালন করে থাকি। তাদের ইচ্ছা ও স্বতঃস্ফূর্ত জানার কৌতূহলকে অবদমন করে থাকি। বেড়ে ওঠার দিনগুলোতে নানা অবদমন ভবিষ্যতে তাদের অসহিষ্ণুতার পথে চালিত করে। প্রতিটি মানব শিশুর মধ্যে রয়েছে তার নিজের মতো করে ভাববার ক্ষমতা। পৃথিবীর যে আলো-বাতাসে তারা বড় হতে থাকে তার সকল কিছুর সঙ্গে একদিন তার অপরিচয় ছিল। শিশু-কিশোররা তার নিজের নিয়মে স্পর্শ ও অনুভব দ্বারা সেসবের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে থাকে। সে নদীর দিকে তাকায়, বৃক্ষের দিকে তাকায়Ñ সে দেখতে থাকে প্রাণিকুল, বিশ^ব্রহ্মা-। চারপাশের মানুষ তাকে জানাতে থাকে এই পৃথিবীর প্রাণী ও বস্তুনিচয়ের সঙ্গে তাদের কি ধরনের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু সেই জানা প্রায়ই পরিবেশবান্ধব হয় না; পূর্ব নির্ধারিত সামাজিক শ্রেণীকরণের দ্বারা আমরা তাদের বিচ্ছিন্ন করে তুলি। কিন্তু এমন একটি কিশোর-গ্রামের স্বপ্ন সংগঠিত করা অসম্ভব নয় : যেখানে সকল পিতা-মাতা বলবে- আমাদের সন্তানরা কেবল আমাদের সন্তান নয়, তারা আমাদের মাধ্যমে এসেছে, আমাদের থেকে নয়; আমাদের চিন্তার দ্বারা তাদের ক্লিষ্ট করব না, আমরা কেবল ভালবাসার দ্বারা তাদের চেতনাকে উজ্জীবিত করব। তারা তো আগামী পৃথিবীর মানুষ- তাদেরই সেখানে বসবাস করতে হবে। তারা অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করে তাদের নিজের জীবন উদ্যাপন করবে। এই পৃথিবীর প্রাণিকুল ও জীবজগতের তারা প্রভু নয়, তারা তাদেরই অংশ। নারী কেবল নারী হওয়ার জন্য, পুরুষ কেবল পুরুষ হওয়ার জন্য পাবে না অগ্রাধিকার; ধর্ম নয়, বর্ণ নয় কেবল তাদের পছন্দের কর্মের শ্রেণী বিভাজন তাদের হবে একমাত্র পেশাগত পরিচয়। তাদের কাছে আমরা গল্প শোনাব পূর্বপুরুষদের সাহসের- বলব, মানুষ কতদূর এগিয়েছে। তারা জানবে নিজের দেশ, মানচিত্র, ভূগোল, ইতিহাস; জানবে চর্যার কাল থেকে মানুষ কেমন করে এতদূর এসেছে, কিভাবে তরুণ কিশোর মুক্তিযোদ্ধারা একটি স্বাধীন জাতির জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু মানুষের লড়াই নিরন্তর; থেমে গেলেই তার মৃত্যু, সবকালে সব মানুষকেই সক্রিয় থাকতে হয়; কেবল অতীতের গৌরব গাথার ওপরে মানুষ টিকে থাকতে পারে না; সেই গৌরবকে তার ধরে রাখতে হয়। তাদের বলতে হবে- এখানে জন্মেছিলেন শ্রীজ্ঞান অতীশ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্গবন্ধু। পাখির কলকাকলিতে তাদের ভাঙবে ঘুম, বিদ্যালয়ে থাকবে বিস্তীর্ণ খেলার মাঠ, শরীর চর্চা কেন্দ্র। বছরের কোন একদিন তাদের শিক্ষকগণ বলবেনÑ চল আমরা একটি নদীর উৎসমুখ দেখে আসি, দেখে আসি সোমপুর বিহার, হিমালয় পর্বত। তারা জানাবে পৃথিবীতে মানুষ আছে নানা বর্ণের, নানা ভাষার, কিন্তু তাদের মৌলিক চেতনার কোন পার্থক্য নেই। এমন কিছু অর্জন আছে যা নিজেকে করতে হয়, কিছু আছে জাতিগত, আবার এমন কিছু অর্জন পৃথিবীর সকল প্রান্তের মানুষ ভাগাভাগি করে নেয়। যেমন বিজ্ঞানের আবিষ্কার, প্রযুক্তির উন্নয়ন, মানুষের দুঃসাহসিক অভিযান সকল মানুষ ভাগাভাগি করে নেয়। তাদের জানাতে হবে আমরা যেমন নিজের জন্য বাঁচি তেমন অন্যের বাঁচাকে নিশ্চিত না করলে পরিণামে আমরাও বাঁচতে পারি না। তাদের বলতে হবেÑ আমি নয় আমরা, শ্রেষ্ঠ নয় অন্যতম; আমরা কেউ রাজা নই, সবাই রাজা- সবার উপস্থিতি, সবার অংশগ্রহণ আছে বলেই পৃথিবী এত সুন্দর। এই ইউটোপিয়ার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে এসেছেন কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, এগিয়ে এসেছেন পিকেএসএফ পরিবার। প্রবীণদের জ্ঞানে নবীনদের তারুণ্যদীপ্ত স্বপ্নে দেশকে রাঙিয়ে দেয়ার যে স্বপ্ন কিশোর-কিশোরী সম্মেলনের মাধ্যমে পল্লবিত হয়ে উঠছে- আশা করা যায় তা অচিরেই আমাদের কিশোরদের আনন্দময়, ভারসাম্যপূর্ণ, ক্ষুধামুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক, সৃষ্টিশীল ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। নতুন কিছু স্বাপ্নিক মানুষ এই অভিযাত্রায় যুক্ত হবে। তাদের অর্থবিত্ত, অভিজ্ঞতা, অবসরের সময় দিয়ে- নিজের এলাকার কিশোরদের নিয়ে গড়ে তুলবেন কিশোরদের প্রাণময়তাপূর্ণ গ্রাম। আমাদের সোনার কিশোর-কিশোরীরা গড়ে তুলবে সেই ইউটোপিয়া- ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র- যার স্বপ্ন একদিন লালন করতাম আমরা। লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক
×