ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঠাকুরগাঁওয়ের শীতের আগাম সবজি যাচ্ছে বিদেশে

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ২১ অক্টোবর ২০১৮

ঠাকুরগাঁওয়ের শীতের আগাম সবজি যাচ্ছে বিদেশে

নিজস্ব সংবাদদাতা, ঠাকুরগাঁও ॥ শীতকালীন আগাম সবজি চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন ঠাকুরগাঁওয়ের অনেক বেকার যুবকসহ বিপুলসংখ্যক কৃষক। এ মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় আগাম সবজির বাম্পার ফলনও দেখা যাচ্ছে। এতে লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছেন এ অঞ্চলের চাষী ও ব্যবসায়ীরা। এসব সবজি জেলার চাহিদা মিটিয়ে পরে চলে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় এবং রফতানি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও। শীত আসার আগেই চাষীরা লাল শাক, পালং শাক, শিম, টমেটো, বেগুন, লাউ, শসা, মিষ্টি কুমড়া, ডাটা, চিচিঙ্গা, পটল, মুলা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, করলা, টমেটোসহ বিভিন্ন জাতের শীতকালীন সবজি চাষ করেছেন। ফলে এখন ঠাকুরগাঁওয়ের অনেক এলাকার বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে সবুজ সবজির সমারোহ। প্রতিদিনই ভোরে জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে কৃষকরা নিয়ে আসছেন এসব সবজি। দামও পাচ্ছেন ভাল। এছাড়া স্থানীয় শ্রমিকরাও কাজের নিশ্চয়তা ও ন্যায্য মজুরি পাওয়ায় বেশ খুশি। নারগুন এলাকার শ্রমিক মজনু বলেন, আগে এ সময় তাদের অলস সময় পাড় করতে হতো। কিন্তু আগাম সবজি চাষের কারণে এখন তারা ভীষণ ব্যস্ত সময় পাড় করছে। দূর হচ্ছে অভাব অনটন। নারগুন এলাকার বেগুন চাষী মোঃ আফতাব উদ্দিন জানান, গতবছরের তুলনায় এবারে ফলন বেশি দেখা যাচ্ছে। এ বছর ৬-৭ লাখ টাকা আয় হবে বলে তিনি আশা করছেন। সদর উপজেলার চামেশ্বরী গ্রামের কৃষক আহসান জানান, কীটনাশকমুক্ত সবজি উৎপাদনে সবজি ক্ষেতে পোকা দমনে ফাঁদ ব্যবহার, জৈব সার, সময়মতো ফসলের যতœœ নেয়ায় অল্প খরচ করে লাভবান হচ্ছেন তিনি। তার এ উৎপাদিত সবজি সংগ্রহে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার পাইকাররা আসছেন প্রতিদিনই। সবজি চাষে বছরের পর বছর লাভের অঙ্ক বাড়তে থাকায় আশপাশের কয়েকটি গ্রামের অনেক যুবক এখন সবজি চাষে ঝুকছেন। তিনি জানান, ১২ বছর আগে পরীক্ষামূলকভাবে ৩০ শতক জমিতে সবজি আবাদ শুরু করি। এখন ১০ একর মাটিতে আগাম সবজি আবাদ করছি। মেহেদী আহসান উল্লাহ জানান, ১০ একর জমির করলা বিক্রি করে তার লাভ হবে ৭ লাখ টাকার মতো। ফলে তার দেখাদেখি এলাকার অনেক বেকার যুবকরা এখন সবজি চাষে নামছেন। তিনি আরও জানান, তার উৎপাদিত করলা দুবাই, বাহরাইন, অস্ট্রেলিয়া, হংকংসহ ৭টি দেশে রফতানি হচ্ছে। উৎপাদনের দিক থেকে তিনি সর্বোচ্চ ফলন পাচ্ছেন। এখন জেলায় তিনি মডেল কৃষকে পরিণত হয়েছেন। সবজি চাষের কারণে আমি রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক পেয়েছি। এছাড়াও কীটনাশকমুক্ত সবজি উৎপাদন ও উৎপাদিত সবজি এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করায় সারাদেশের ছয়জন কৃষকের মধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে আমাকে সনদ ও ক্রেস্ট প্রদান করেছে। শীতকালীন সময়ে প্রতিদিন শুধু মাত্র আমার জমিতে দৈনিক ৬০-৭০ জন শ্রমিক কাজ করেন। আমার এ সফলতা দেখে আশপাশের কয়েকটি গ্রামের বেকার যুবক এখন সবজি আবাদ করছেন। এখন এলাকায় প্রতিদিন ৩-৪শ’ শ্রমিক কাজ করছেন। তবে আমি চাই সরকার সল্প সুদে অধিক পরিমাণে ঋণ সহয়তা করলে কৃষিতে আরও ভাল ভূমিকা পালন করা সম্ভব হবে। একই গ্রামের বেকার যুবক তাজুল ইসলাম জানান, চার বিঘা জমিতে ফুলকপি ও বাঁধাকপির আবাদ করেছেন তিনি। ক্ষেত থেকেই বিক্রি করে পেয়েছেন ছয় লাখ টাকা। সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ পেলে আরও বেশি সবজির আবাদ করবেন তিনি। বেগুনবাড়ি এলাকার কৃষক আনোয়ার হোসেন জানান, এবার পাঁচ শতক জমিতে বরবটি-শিমের আবাদ করেছেন। এতে খরচ হয়েছে তিন হাজার টাকা। এ পর্যন্ত নয় হাজার টাকার শিম বিক্রি করেছেন। আরও পাঁচ হাজার টাকার শিম বিক্রি করার আশা তার। ভুল্লী এলাকার চাষী মতিউর রহমান জানান, আট বিঘা জমিতে বেগুন চাষ করেছেন। এবার ফলন হয়েছে ভাল। প্রতিমণ বেগুন উৎপাদনে খরচ হয়েছে চার শ’ টাকা বিক্রি হচ্ছে ১২শ’ টাকা দরে। রানীশংকৈল উপজেলার শালবাড়ি গ্রামের কৃষক মোঃ সেন্টু তিন বিঘা জমিতে ফুলকপির আবাদ করেছেন। ইতোমধ্যে কপি বড় হয়েছে। চলতি সপ্তাহেই তিনি ফলন বাজারে তুলতে পারবেন বলে আশা করছেন। ঢাকার পাইকারী বাজারের ব্যবসায়ী লোকমান হাকিম জানান, কারওয়ান বাজারে এ জেলার সবজি বিক্রি করেন তিনি। এ জেলার সবজির মান ভাল। এবার ব্যবসায় তার ভাল লাভ হচ্ছে। কৃষি বিভাগের মতে, এবার জেলায় সাত হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি চাষ হয়েছে। এতে উৎপাদন হবে এক লাখ ৫১ হাজার মেঃটন শাক-সবজি। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোঃ আফতাব হোসেন জানান, কৃষকরা যে ফসলে মুনাফা পায়, সেটাতেই ঝুঁকে পড়েন। শুধু এ জেলায় নয়, সারাদেশে সবজির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাই কৃষকরা অধিক মুনাফা লাভের আশায় আগাম সবজি চাষে ঝুকে পড়েছেন। কৃষি বিভাগের লোকজনের নিয়মিত মনিটরিংয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের সংখ্যা বেড়েছে। আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে উৎপাদন বাড়ায় কৃষকদের মুনাফাও বেড়েছে কয়েকগুণ। এ অঞ্চলের সবজি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে চলে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশালসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশগুলোতে। তিনি আরও বলেন, সবজি সংরক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করাসহ সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ পেলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এ অঞ্চলের কৃষকরা ভূমিকা রাখবে ।
×