ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ইন্স্যুরেন্স, দাফন ও ক্ষতিপূরণের টাকা কারও পরিবারই যথাসময়ে পাচ্ছে না

জুতার তলা ক্ষয়ে গেলেও সৌদিতে নিহতদের ক্ষতিপূরণ মিলছে না

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২১ অক্টোবর ২০১৮

জুতার তলা ক্ষয়ে গেলেও সৌদিতে নিহতদের ক্ষতিপূরণ মিলছে না

আজাদ সুলায়মান ॥ কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে মদিনায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় শরীফ নামে এক বাংলাদেশী যুবক। বছর দেড়েক হয়ে গেলেও এখনও তার পরিবার ক্ষতিপূরণ পায়নি। কবে পাবেন সে নিশ্চয়তাও কেউ দিতে পারছে না। তার বাবা দুলাল মিয়া প্রতি মাসেই কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া থেকে ঢাকায় আসেন। এ অফিস সেই অফিসে ঘুরতে ঘুরতে জুতার তলা ক্ষয়ে গেলেও নিস্তার মিলছে না। ছেলের জীবনের মূল্য কত- সে হিসাব মেলাতে পারছেন না দুলাল মিয়া। তার মতো এমন হাজার হাজার ভুক্তভোগীর দেখা মেলে জনশক্তি ও কর্মসংস্থান সংস্থার অফিসে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের অফিসে অফিসে ঘুরতে দেখা যায়। তাদের বার বার আসতে বলা হয়, ডেট দেয়া হয়। প্রতিবছর সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী শ্রমিকরা ঘটনা দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর যে পরিমাণ ইন্স্যুরেন্স, ক্ষতিপূরণ ও লাশ দাফনের টাকা পাওয়ার কথা সেটা থেকে বঞ্চিতই থাকে হতভাগ্য ব্যক্তির পরিবার। শরীফের কাহিনীতে উঠে আসে দেশের এ বিষয়ের পুরো চিত্র। পাকুন্দিয়ার পাটুয়াভাঙ্গা ভিটিপাড়ার দুলাল মিয়ার ছেলে শরীফ বছর দশেক আগে সৌদি আরবের মদিনায় এম্বু নামক স্থানে একটি কারখানায় কাজ করতেন। ওখানে বেতন পেতেন বাংলাদেশী টাকায় ১২ হাজার। তা দিয়েই সংসার চালাতেন দুলাল মিয়া। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার পিছু ছাড়েনি। ছেলের বিয়ের পর হঠাৎ একদিন শরীফের মৃত্যু ঘটে সড়ক দুর্ঘটনায়। সেদিন সন্ধ্যায় কারখানা থেকে বের হলে তাকে বহনকারী গাড়িটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। পাহাড় থেকে নেমে আসা একটি উটকে বাঁচাতে গিয়ে চালক গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু ঘটে শরীফের। সৌদি নিয়মানুযায়ী ওখানকার পুলিশ এ ঘটনায় একটি মামলা করে। যথারীতি লাশ পাঠিয়ে দেয় ঢাকায়। ছেলের মরদেহ গ্রহণ করতে দুলাল মিয়া ঢাকার রাস্তাঘাট চেনে এমন এক যুবক বজলুকে নিয়ে চার হাজার টাকায় একটি মাইক্রোবাস নিয়ে ঢাকায় আসেন। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো হাউসে গিয়ে দিনভর অপেক্ষার পরও লাশ না পেয়ে ফিরে যান। দুদিন পর আবার আসতে হয়। পরে এক সুহৃদের সহযোগিতায় বিমানবন্দর থেকে লাশ বুঝে পান দুলাল মিয়া। একই সঙ্গে লাশ দাফন কাফনের জন্য বিএমএটির দেয়া নগদ ৩৫ হাজার টাকা বুঝে পান। দাফনের পর শরীফের ইন্স্যুরেন্সের ৩ লাখ টাকা নিতে ঢাকায় আসতে শুরু করেন তার বাবা। একবার দুবার নয় চার বার তাকে ঢাকা আসতে হয়েছে। তিনি এ টাকা পেলেও আজ অবধি পাননি শরীফের ক্ষতিপূরণের টাকা। যদিও বিএমএটিএ জানিয়েছে, কর্মস্থলে কেউ মারা গেলে তাকে বড় অংকের একটা ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। দুলাল মিয়াও তাই শুনেছেন। আশায় তিনি সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সি ও বিএমএটি অফিসে আবেদন করেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত চলে গেছে দেড় বছর। এখনও তিনি টাকা পাননি। কবে পাবেন তাও তাকে কেউ নিশ্চিত করতে পারছে না। এমনকি মহাসচিব সেলিম রেজা নিজেও বলতে পারছেন না। জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি সময় সাপেক্ষ। অপেক্ষা করতে হবে। কেউ কেউ অবশ্য আগেই পেয়ে যায়। শরীফের মতো এমন শত শত শ্রমিক শুধু সৌদিতেই পৃথক দুর্ঘটনায় মারা যায় প্রতিবছর। সবারই একই অবস্থা। ক্ষতিপূরণের টাকার আদায় করতে গিয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। শরীফের চেয়ে আরও করুণ অবস্থা কিশোরগঞ্জের সরারচরের হাসান, ভৈরবের মনসুরের। তারাও সৌদিতে কর্মরত অবস্থায় বিভিন্ন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। তিন বছর পেরিয়ে গেলে এখনও সৌদি আরব থেকে কোন ধরনের ক্ষতিপূরণ বা আর্থিক সহায়তা পাননি। লাশ ঢাকায় আসার সঙ্গে সঙ্গে শাহজালাল বিমানবন্দরে কার্গো হাউস থেকে দাফনের জন্য নগদ ৩৫ হাজার টাকা পেতেও বেশ ভোগান্তিতে পড়তে হয়। লাশের উত্তরাধিকার সনদ ও অন্যান্য কাগজপত্রাদি ছাড়া কার্গো হাউসে গিয়ে ফিরতে হয় টাকা ছাড়াই। এ জন্য অনেককেই শূন্য হাতে ফিরতে হয়। মদীনায় এম্বু নামক স্থানে একটি কারখানায় কাজ করতেন শরীফ। বছর দেড়েক আগে কোরবানি ঈদের পরদিন কাজ শেষে কারখানা থেকে মাইক্রোবাসযোগে ফিরছিলেন শরীফ, মাহমুদ ও কায়েস। হঠাৎ পাহাড় থেকে নেমে আসা একটি উটকে বাঁচাতে গিয়ে মাইক্রোবাসটি উল্টে পড়ে যায়। এতে আরোহী তিনজনই ঘটনাস্থলে প্রাণ হারায়। সেদিনই মদীনার পুলিশ এ ঘটনায় বাদী হয়ে থানায় একটি মামলা দায়ের করে। সেই মামলার ফলাফল কি তা আজও জানতে পারেনি এই তিনজনের একজনও। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত দেড় বছরেও শরীফের পরিবার সৌদি আরব সরকারের পক্ষ থেকে এক পয়সাও ক্ষতিপূরণ পায়নি। কবে নাগাদ তা পাবেন কিংবা আদৌ পাবেন কি-না তাও তাদের কাছে পরিষ্কার নয়। জানতে চাইলে দুলাল মিয়া বলেন, শরীফ ছিল বিবাহিত। তার স্ত্রী পুত্র-রয়েছে। ভিটেবাড়ি বিক্রি করে শেষ সম্বল হিসেবে তাকে সৌদি আরব পাঠিয়েছিলাম। খুব আশা ছিল একবার সৌদি যেতে পারলে আর কোন টেনশন থাকবে না। দুর্ভাগ্য হঠাৎ এক কোরবানি ঈদের দিন মদীনায় সড়ক দুর্ঘটনায় সে মারা যায়। এটা কখনোই ভাবিনি যে সৌদি আরব গিয়ে আমার ছেলেটা এক্সিডেন্টে মারা যাবে। দুঃখের কথা কি বলব। সেদিনই মদিনার পুলিশ এ ঘটনায় একটা মামলা করে। কদিন পর শরীফের লাশ আসে। ঢাকা থেকে লাশ নিয়ে আসি, সঙ্গে দাফনের জন্য ৩৫ হাজার টাকা। তার ক’মাস পর জনশক্তি কল্যাণ বোর্ড থেকে ৩ লাখ টাকা পাই। কিন্তু সৌদি আরব থেকে এক পয়সাও ক্ষতিপূরণ পাইনি। এ জন্য আমি কবার ঢাকায় গিয়েছি। কল্যাণ বোর্ডে গিয়ে ঘোরাঘুরি করেছি। কেউ কিছুই জানাতে পারেনি। তারা শুধু ধৈর্য ধরতে বলেন। সৌদিতে মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত নাকি এই টাকা পাওয়া যাবে না। দুলালের মতো এমন হতভাগা বাবাকে প্রত্যেক দিইন কল্যাণ বোর্ডে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। ওই অফিসের ফ্রন্ট ডেস্কে গিয়ে বিপুলসংখ্যক এমন ভুক্তভোগীকে বসে থাকতে দেখা যায়। তাদের কোন ধরনের সুস্পষ্ট তথ্য দেয়া হয় না। কখন কার ক্ষতিপূরণের টাকা আসবে কিংবা কে পাবে না পাবে কোন কিছুই জানাতে পারে না কল্যাণ বোর্ডের লোকজন। উপরোক্ত অনেকের সঙ্গে দুর্ব্যবহারেরও অভিযোগ রয়েছে। জানা যায়, প্রতিবছর শুধু সৌদি আরবেই প্রবাসী শ্রমিক মৃত্যুর হার কমপক্ষে মাসে গড় পড়তা ৩০টি। মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য সব দেশ মিলিয়ে মাসে কমপক্ষে দুই শতাধিক শ্রমিকের মরদেহ ঢাকায় আসে। এদের বেশিরভাগই বিনা পয়সায় দেশে ফিরিয়ে আনে বিমান বাংলাদেশ। এরা সবাই কর্মস্থলে মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ ও অন্যান্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। গত সপ্তাহে টানা তিনদিন প্রবাসী কল্যাণ বোর্ডে গিয়ে এমন একজনকেও পাওয়া যায়নি- যিনি সৌদি আরব থেকে পাঠানো ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। বছরের পর বছর ধরে তারা এখানে সেখানে দৌড়াদৌড়ি করেও কোন সুরাহা পাচ্ছে না। তবে কল্যাণ বোর্ডের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সৌদিতে শ্রমিকরা বৈধভাবে যাবার পর যেভাবেই তার মৃত্যু ঘটুক, স্বাভাবিক অস্বাভাবিক, তাকে ওই সৌদি শ্রম আইন অনুযায়ী একটা ন্যূনতম ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করাটা বাধ্যতামূলক। ইন্টারন্যাশনাল মাইগ্রেশন ল’ অনুযায়ীও, শ্রমিকরা এ সুবিধা পাবেন। যদিও ক্ষতিপূরণের হার বা পরিমাণ নির্ভর করে কোন অবস্থায় কার কখন মৃত্যু ঘটে তার ওপর। যেমন একজন শ্রমিক কর্মস্থলে অন ডিউটি যদি মারা যায়, তাহলে তাকে একটা মোটা অংকের পরিমাণই ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। আবার কেউ কর্মস্থল থেকে ফেরার পর নিজ রুমে অন্য দৈব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালে সে ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ কম হবে। এখানে আরও একটি অনেক ফ্যাক্টর কাজ করে। এ সুবিধা কেবল বৈধ শ্রমিকরাই পাবেন, যাদের ম্যানপাওয়ার কার্ড আছে। আবার অবৈধ শ্রমিকদের যদি এ কার্ড নাও থাকে, সেক্ষেত্রে সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাস যদি তাকে সত্যায়িত করে দেয় তাহলেও সে ক্ষতিপূরণ পেতে পারে। এ প্রসঙ্গে জেদ্দায় বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, কর্মস্থল থেকে বাসায় ফেরার পথে যদি অফিসিয়াল গাড়িতে থাকাবস্থায় দুর্ঘটনায় মারা যায় কোন শ্রমিক তাহলেও এক রকম ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। একই শ্রমিক যদি নিজ দায়িত্বে অন্য কোন গাড়িতে যাবার সময় মারা যায়, সেটা পরিমাণ হবে ভিন্ন। কে কোন পরিস্থিতিতে মারা যায়, এক্ষেত্রে কোম্পানির দায় দায়িত্ব কতটুকু তার ওপর ভিত্তি করেই একটা ন্যূনতম ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। এটা নির্ধারণ করা হয় পুলিশী মামলায়। প্রতিটি ঘটনা দুর্ঘটনার পরই সেখানকার পুলিশ মামলা দায়ের করে। সে মামলায় শুনানির পর একটা রায়ে কোম্পানিকে যতটুকু দায়ী করা হয় ঠিক তার বিপরীতে প্রাপ্য পাওনাই দেয়া হয়। এ বিষয়ে তিনি বলেন, সৌদিতে মামলা বা আইনী প্রক্রিয়াটা খুব দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ। কয়েক বছর লেগে যায় একটি মামলা করতে। যদিও এক্ষেত্রে বাংলাদেশের শ্রমিক পরিবারের করার কিছু থাকে না। ভিকটিমের পরিবারের পক্ষে মূলত সৌদি দূতাবাসের লেবার উইং এ দায়িত্বটুকু পালন করে। মামলা যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি ঘটে, সেজন্য তদারকি করতে হয়। সৌদিতে কর্মস্থলে মারা যাবার পর কেন এত সময় লাগছে তার কোন ব্যাখ্যা দিতে পারে না কল্যাণ বোর্ড। প্রশ্ন করা হলে মহাপরিচালক সেলিম রেজা সরাসরি কোন সদুত্তর দিতে পারেনি। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সৌদি থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় দায়িত্ব এই বোর্ডের। কিন্তু তারা যে সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না তার জ্বলন্ত উদাহরণও রয়েছে। শরীফের কেইস স্টাডি দেখলেই প্রমাণ মিলে কেন গত দেড় বছরেও তার বাবা এ সুবিধা পাননি। কল্যাণ বোর্ডে ঢুকতে গেলেই যে ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয় বা জেরার মুখে পড়তে হয় তাতে অনেকেই নিরাশ হয়ে ফিরে যায়। এক ভুক্তভোগী বাবা জানান, দুবছর আগে জেদ্দায় তার ছেলে মামুন জেদ্দায় মারা গেছেন কর্মস্থলে। সেই টাকা আজও দেয়া হচ্ছে না। ঢাকায় আসলে বলা হয় সৌদি থেকে কোন খবর আসে নাই। সৌদি থেকে কেন খবর আসতে এত সময় লাগে জানতে চাইলে কল্যাণ বোর্ডের একজন কর্মকর্তা বলেন, এটার জন্য সেখানকার বাংলাদেশ দায়ী। যদি দূতাবাস থেকে নিয়মিত মামলাগুলোর তদারকি করা হতো তাহলে এত সময় লাগতো না। এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিদেশে ২৮টি দূতাবাসে শ্রম উইং রয়েছে মন্ত্রণালয়ের। কোন প্রবাসী শ্রমিক মারা গেলে তার লাশ দেশে আনার ক্ষেত্রে দূতাবাসের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়। দূতাবাসের ছাড়পত্র পাওয়ার পর লাশ দেশে পাঠানো হয়। তারপর আইনী প্রক্রিয়া শেষ করেই একজন শ্রমিক ক্ষতিপূরণ পায়। যা বেশ জটিল ও সময় সাপেক্ষ। এ দিকে শাহজালালে প্রবাসীদের লাশের সঙ্গে প্রাপ্য দাফনের জন্য নগদ ৩৫ হাজার টাকা পেতে এখনও ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। যদিও শাহজালাল বিমানবন্দর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইউসুফ বনসুরির বিশেষ পদক্ষেপের দরুণ এ জটিলতা অনেকাংশে দূর হয়েছে। বিমান জানিয়েছে, প্রতিদিনই হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবাসী শ্রমিকের মরদেহ আসে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিগত চার দশক ধরেই বিদেশ থেকে প্রবাসীদের মরদেহ বিনা খরচে দেশে আনছে। বিমানের কার্গো (ইম্পোর্ট) সেকশন থেকে এ লাশ নেয়ার জন্য বৈধ ওয়ারিশ বা স্বজনদের বলা হয়। লাশের সঙ্গে নগদ ৩৫ হাজার টাকার চেক বুঝে পেলেও অনেকেই বঞ্চিত হয়। এমনই একনজন চাঁদপুরের মতলব ফারাজি কান্দির মনির হোসেন। গত ১৭ ডিসেম্বর রিয়াদে তার ভাই জাকির সরকার মারা যান। তাকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে ফোন করে জানানো হয়-ঢাকায় লাশ আসবে আগামী ২৯ ডিসেম্বর। সে হিসেবে তিনি একটি মাইক্রোবাস নিয়ে ঢাকায় আসেন। কার্গো হাউসে গেলে তাকে আধাঘণ্টার মধ্যেই বিমানের পক্ষ থেকে লাশের কাগজপত্র বুঝিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু কাস্টমস আর কল্যাণ বোর্ডের প্রক্রিয়াগত জটিলতার দরুন সারাদিন ভুগতে হয়। সেদিন লাশ পেলেও নগদ ৩৫ হাজার টাকার চেক দেয়া হয়নি। কেন পাননি প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের লোকজন যদি আগেই জানিয়ে দিতো, লাশের সঙ্গে ৩৫ হাজার টাকার চেক দেয়া হবে এবং এ জন্য ওয়ারিশ সার্টিফিকেট লাগবে। তাহলে আমরা সেইভাবেই কাগজপত্র নিয়ে ঢাকায় যেতাম। সেটা আগে থেকে জানানো হয়নি। ঢাকায় যাওয়ার পর কল্যাণ বোর্ড থেকে একটি ফরম পূরণ করার জন্য দেয়া হয়। সেটা পূরণ করার খুবই জটিল। গ্রাম গঞ্জের সাধারণ অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত সাধারণ মানুষের পক্ষে সেটা পূরণ করা সহজ ব্যাপার নয়। যে কারণে সেদিন ওয়ারিশ সার্টিফিকেট সঙ্গে না নেয়ায় ওই ৩৫ হাজার টাকার চেক আজও আনা হয়নি। জানা যায়, ম্যানপাওয়ার ক্লিয়ারেন্স কার্ড করার সময় প্রত্যেক প্রবাসী ২৫০ টাকা সার্ভিস চার্জের পাশাপাশি কল্যাণবোর্ডে ৩৫০০ টাকা চাঁদা দেন। এই চাঁদার প্রধান খরচের খাত হলো এই অনুদান বা সহায়তা! প্রত্যেক প্রবাসী চাঁদা দেয়। কিন্তু হাজারে একজন মারা যায়। সবার চাঁদায় এই তহবিল গঠিত হয়, যে কয়জন মারা যান, কেবল তারাই এই অনুদান পান। আক্ষরিক অর্থে লাশ সংক্রান্ত যাবতীয় সার্ভিসই প্রবাসীদের প্রিপেইড সার্ভিস। তারপরও লাশের সঙ্গে এই ৩৫ হাজার টাকার চেক গ্রহণের গলদঘর্ম হতে হয়। গত বৃহস্পতিবার সরেজমিন দেখা যায়, এ পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি ঘটেছে। হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ ইউসুফ স্ব-উদ্যোগে কার্গো হাউসেই ওয়ানস্টপ সার্ভিসের পুরো ব্যবস্থা করেছেন। এখন সেটা দিবারাত্রি খোলা রাখা হচ্ছে। কাস্টমসের কর্তারাও এখন সার্বক্ষণিক থাকছেন। সেখানে আগত স্বজনদের জন্য বসার ও টয়লেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আগে ৮নং গেট দিয়ে লাশ বের করা হলেও এখন সেটা কার্গো হাউস দিয়েই বের করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ ইউসুফ জনকণ্ঠকে বলেন, ভোগান্তি যা হওয়ার তাতো হয়েই গেছে। এখন সে কথা বলে আর লাভ কি। এখন আগের তুলনায় অনেক সহজীকরণ করা হয়েছে। বিশেষ করে বিদেশে থাকা মিশন থেকে এখন লাশের সব ধরনের আগাম তথ্য একটি বিশেষ ফরমেটে বিমানবন্দরের কল্যাণ বোর্ডের ডেস্কে দেয়া হচ্ছে। এখান থেকে লাশের স্বজনের কাছে তাৎক্ষণিক তথ্য পাঠানো হয়। কি কি কাগজপত্র সঙ্গে আনতে হয় সেটাও বলে দেয়া হচ্ছে। এটাকে আরও সহজ করার উপায় খোঁজা হচ্ছে। সচিব যা বলেন ॥ এ সব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব রওনক জাহান শনিবার জনকণ্ঠকে বলেন, এটা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সর্বশেষ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এতে ওই দেশে নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ আদায়ের প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও স্বল্প সময়ে যাতে নিশ্চিত করা যায় সে পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়টিও ছিল। আমরা আশা করছি এ প্রক্রিয়া সহজীকরণ করা সম্ভব। বিশেষ করে আমি এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেয়ার পর সৌদিতে গিয়ে দূতাবাসের কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। প্যানেল লয়ার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, শ্রমিকদের বিদেশে যাবার সময় যাতে বিমানবন্দরে কোন ধরনের হয়রানি হতে না হয়, তাদের মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। খুব শীঘ্রই আপনারা তা দেখতে পাবেন।
×