ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নির্বাচনে তিন শ’ আসনে জোটগত প্রার্থী দেবে জাতীয় পার্টি

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২১ অক্টোবর ২০১৮

নির্বাচনে তিন শ’ আসনে জোটগত প্রার্থী দেবে জাতীয় পার্টি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন, নির্বাচন হলে তার জোটের পক্ষ থেকে তিন শ’ আসনেই প্রার্থী দেয়া হবে। এজন্য আমরা প্রস্তুত। তবে দেশের স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত বদল হতে পারে। এজন্য তিনি সবাইকে প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন হবে কি হবে না আমরা জানি না। একটি দল সাত দফা দিয়েছে। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, তা মানা সম্ভব নয়। এই অবস্থায় আগামী দিনগুলোয় সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন ৫৯ দলের সম্মিলিত জাতীয় জোটের মহাসমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে এসব কথা বলেন জাপা চেয়ারম্যান এরশাদ। সমাবেশে সুশাসনের লক্ষ্যে ও জাতির মুক্তির জন্য ১৮ দফা ইশতেহার ঘোষণা করেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নিজেদের ‘শক্তিমত্তার’ জানান দিতেই এই মহাসমাবেশের আয়োজন করা হয়। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হলে জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় আসবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রীর এই বিশেষ দূত। বলেন, নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। সরকারকেই নির্বাচনের সুষ্ঠুু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সংসদের সব দল নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে হবে। জাতীয় পার্টি নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তন করতে চায় বলে উল্লেখ করে এরশাদ বলেন, দেশের প্রত্যেকটি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তিনি বলেন, আমি জোটের সবাইকে প্রার্থী তালিকা দিতে বলব। তবে দলের চেয়ে প্রার্থীর যোগ্যতা বেশি হতে হবে। দেশের রাজনীতির ইতিহাসে সর্ববৃহৎ দলের সমন্বয়ে গঠিত জোটের নেতা এরশাদ। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো তিনিও জোট গঠন করেন। লক্ষ্য সম্মিলিত এই জাতীয় জোটকে নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া। জোট গঠনের পর এটাই ছিল সর্ববৃহৎ কর্মসূচী। এই কর্মসূচী ঘিরে দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলা থেকে সকাল থেকেই দলে দলে লোকজন আসতে থাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। প্রতিটি মিছিলেই ছিল নির্বাচনী আমেজ। বিভিন্ন এলাকার সম্ভাব্য প্রার্থীদের সমর্থকরা নেতাদের গুণগান গেয়ে সেøাগান দেন। মিছিলে কৃষক, লাঙ্গল, খড়ের ঘর, বাদ্য, বাজনা, হাতি, ফেস্টুন শোভা পায়। নেতাকর্মীদের হাতে থাকা পোস্টারে লেখা ছিল, ‘চলো চলো ঢাকা চলো, মহা-সমাবেশ সফল কর’। সমাবেশে জাপার কেন্দ্রীয় নেতাসহ শরিক দলের নেতারা বক্তব্য রাখেন। বক্তাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলকে আগামী নির্বাচনে ভোট দিতে নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। সেইসঙ্গে গ্রামে গ্রামে গিয়ে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা তুলে ধরার কথা বলেন। সমাবেশে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে কয়েক দফা মারামারির ঘটনা ঘটে। মহাসমাবেশ কেন্দ্র করে সকাল থেকে প্রেসক্লাব-শাহবাগের রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয় পুলিশ। ফলে আশপাশের সড়কগুলোয় যানজটের কারণে ভোগান্তির সৃষ্টি হয়। অব্যবস্থাপনার কারণে সমাবেশে কাভার করতে আসা সাংবাদিকরাও ভোগান্তিতে পড়েন। আমি বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনীতিক ॥ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ বলেন, দেশে বর্তমানে আমি সবচেয়ে বয়োজ্যষ্ঠ রাজনীতিবিদ, আমার ওপরে আর কারও বয়স নেই। আমি ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়ার পর যত নির্যাতন ও অত্যাচার সহ্য করেছি, আর কোন রাজনীতিক তা সহ্য করেনি। আজ পর্যন্ত আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারি না। তিনি বলেন, ‘আগামী নির্বাচনই হয়ত আমার শেষ নির্বাচন। আমার শেষ জীবনটাকে দেশ ও জাতির জন্য উৎসর্গ করলাম। দেশবাসীর কাছে আমার একটাই চাওয়া, আমাদেও জন্য দোয়া করবেন যেন জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় আসতে পারে। মঞ্চে রওশনের গান ॥ সমাবেশে জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ বলেন, ‘জনগণের উৎসাহ ও আগ্রহ দেখে মনে হচ্ছে আমরা আবার ক্ষমতায় যাচ্ছি। আগামীতে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যা যা করা দরকার তাই করতে হবে।’ বিরোধী দলীয় নেতা বলেন, ‘জাতীয় পার্টিকে ক্ষমতায় যেতেই হবে। কারণ জনগণ আরেকবার সুযোগ দিতে চায়। তাই আমরা যদি এই সুযোগ গ্রহণ করতে না পারি, তাহলে অন্য কোন দল তা পারবে না। আর ক্ষমতায় যেতে হলে দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে হবে। বক্তব্যের এক পর্যায়ে রওশন এরশাদ দুটি গান গেয়ে শোনান। ‘আসল মানুষ না চিনে আমি করেছি মস্ত বড় ভুল, লাঙ্গলে ভোট না দিয়ে করেছি মস্ত বড় ভুল- রংপুরের এই আঞ্চলিক গানটি তিনি গাইতে থাকেন। তার সঙ্গে উপস্থিত নেতাকর্মীরাও ঠোঁট মেলান। এরপর তিনি ‘নতুন বাংলাদেশ গড়বো’ শিরোনামে আরেকটি গান করেন। নেতাকর্মীদের চেয়ার ছোড়াছুড়ি ॥ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ মঞ্চের সামনে জাপা নেতাকর্মীদের মধ্যে কয়েক দফা চেয়ার ছোড়াছুড়ির ঘটনা ঘটে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে লক্ষ্য করে চেয়ার ছুড়ে মারে। এতে বেশকিছু নেতাকর্মী আঘাতও পান। এ সময় শতাধিক চেয়ার ভাংচুর করা হয়। তখন অনুরোধ করে কর্মীদের শান্ত করা হয়। রংপুর থেকে সমাবেশে আসা আদনান ও সোহেব বলেন, আমাদের পার্টি। আর আমাদের বলে যে, কোথায় থেকে আসছি। এ জন্য ওদের চেয়ার ছুড়ে মেরেছি। এরপর এরশাদ বক্তব্য দেয়ার সময় বিভিন্ন এলাকা থেকে নেতাকর্মীরা ব্যানার ওপরে তুলে ধরেন। তখন এরশাদ বলেন, ব্যানার ও পোস্টার নামাতে হবে। তোমরা এগুলো নামাও। পরিস্থিতি শান্ত হলে এরশাদ চেয়ারে বসেই বক্তব্য রাখেন। সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, ইসলামী ফ্রন্টের চেয়ারম্যান এমএ মান্নান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাহফুজুল হক, প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, সালমা ইসলাম এমপি, এসএম ফয়সল চিশতি, শেখ সিরাজুল ইসলাম, আজম খান, ফখরুল ইমাম, হাজী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন, মীর আব্দুস সবুর আসুদ, সুনীল শুভ রায়, খালেদ আখতার, শফিকুল ইসলাম সেন্টু ও জহিরুল আলম রুবেল প্রমুখ। সমাবেশে এরশাদ বলেন, নব্বই সালের পর থেকে জেলে যাওয়ার ভয়ে আমি একদিনও শান্তিতে ঘুমাতে পারিনি। কখন যেন আমাকে জেলে যেতে হয়। তিনি বলেন, জীবনের শেষপ্রান্তে এসেছি। আমার জীবন দেশ ও জাতির জন্য উৎসর্গ করলাম। ১৮ দফা ইশতেহার ॥ সাবেক সেনাপ্রধান এরশাদের ১৮ দফার মধ্যে প্রাদেশিক সরকার গঠন করে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ, নির্বাচন পদ্ধতি ও নির্বাচন কমিশনের সংস্কার ও পুনর্গঠন এবং সন্ত্রাস দমনে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। ইশতেহার পড়ে শুনিয়ে তিনি বলেন, এটা হলো মুক্তির পথ, দেশের মুক্তির পথ, জাতির মুক্তির পথ। দেশবাসীর কাছে কিছু বার্তা পৌঁছে দিতে চাই। সকাল সাড়ে দশটায় শুরু এই মহাসমাবেশ শেষে বক্তব্য রাখেন জাপা চেয়ারম্যান। তার দীর্ঘ বক্তব্যের মধ্যে আগামী নির্বাচনে জোটের ইশতেহারে ১৮ দফার বিষয় নিয়ে বেশি আলোচনা হয়। দফাগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রদেশ, নির্বাচন পদ্ধতি, পূর্ণাঙ্গ উপজেলা, সংখ্যালঘুদের আসন সংরক্ষণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, কৃষকের কল্যাণ সাধন, সন্ত্রাস দমনে কঠোর ব্যবস্থা, জ্বালানি ও বিদ্যুত, ফসলি জমি নষ্ট করা যাবে না, খাদ্য নিরাপত্তা, শিক্ষা পদ্ধতির সংশোধন, স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ, শান্তি ও সহাবস্থানের রাজনীতি প্রবর্তন, সড়ক নিরাপত্তা, গুচ্ছগ্রাম ও পথকলি ট্রাস্ট পুনঃপ্রতিষ্ঠা, পল্লী রেশনিং চালু ও শিল্প অর্থনীতির অগ্রগতি সাধন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোট গঠনের মধ্য দিয়ে নবম জাতীয় সংসদে নির্বাচনে অংশ নেয় জাতীয় পার্টি। পরে ’১৪ সালে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে এরশাদ নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি সংসদে প্রধান বিরোধীদলের তকমা পায়। যদিও নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে এরশাদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলে দলের হাল ধরেন রওশন। নির্বাচনের পর দলটির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান সংসদে প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা হন। এরশাদ হন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। দৃশ্যমান কোন কাজ না থাকলেও এ পদ নিয়ে সরকারের পুরো মেয়াদ কাটাচ্ছেন তিনি।
×