ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

মানসিক চাপে থাকলে শিশুদের হোমওয়ার্ক করাটা অনেক কঠিন হয়ে যায়

প্রকাশিত: ২০:১২, ২১ অক্টোবর ২০১৮

মানসিক চাপে থাকলে শিশুদের হোমওয়ার্ক করাটা অনেক কঠিন হয়ে যায়

অনলাইন ডেস্ক ॥ শিশুদের প্রতিনিয়ত রাগান্বিত বা আক্রমণাত্মক আচরণ সহ্য করা বাবা-মা অথবা শিক্ষক কারও জন্যই স্বাভাবিক বা সুখকর অভিজ্ঞতা নয়। তাদের এই আবেগের বহি:প্রকাশ যদি বাড়ির বাইরে হয় তাহলে এর পরিণতি ওই শিশুর জন্য আরও গুরুতর হতে পারে। সেক্ষেত্রে কিভাবে বুঝবেন যে আপনার কেবল "দুষ্টু" নাকি তার এই অস্থির আচরণের পেছনে মানসিক অসুস্থতাই মূল কারণ? শিশুরা কেন চিৎকার চেঁচামেচি করে? এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিতে যুক্তরাজ্যের মেন্টাল হেলথ ফাউন্ডেশন সম্প্রতি ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সী এক হাজার ৩২৩ জনের ওপর জরিপ পরিচালনা করে। সেখান থেকে জানা যায় যে, শিশুদের আচরণ তখনই পরিবর্তন হয় যখন তারা দুশ্চিন্তা বা মন খারাপের মধ্যে থাকে। জরিপে অংশগ্রহণকারী এক চতুর্থাংশের দাবি যে তারা যখন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে বা মন খারাপ থাকে তখন তারা মারামারি বা ঝগড়াঝাঁটিতে জড়িয়ে পড়ে। বাকি আরও এক চতুর্থাংশ বলেছে মানসিক চাপে থাকলে তাদের হোমওয়ার্ক করাটা অনেক কঠিন হয়ে যায়। "যেসব শিশু সহজেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। তাদের জন্য যেকোনো নতুন, অপরিচিত, কঠিন বা চাপযুক্ত জায়গা সম্ভাব্য হুমকি হিসাবে বিবেচিত হবে।" "যখন শিশুরা মানসিক চাপে থাকে বা কোন হুমকি অনুভব করে। তখন তাদের শরীরে প্রচুর পরিমাণে হরমোন এবং অ্যাড্রেনালিনের সৃষ্টি হয়। যার কারণে তাদের শরীর শক্তিশালী, দ্রুতগামী ও ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে এবং তারা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। এবং এই প্রতিক্রিয়া একপর্যায়ে প্রাকৃতিক-ভাবেই মিলিয়ে যায়।" এতে সহজেই বোঝা যায় যে, অল্প বয়সীদের মানসিক উদ্বিগ্নতা কিভাবে খেলার মাঠের হাতাহাতি অথবা রাগের বিস্ফোরণে পরিণত হতে পারে। খারাপ আচরণ মানেই কি মানসিক সমস্যা? শেফিল্ডের ওয়েলস হাই স্কুলের নির্বাহী প্রধান শিক্ষক পেপ ডি'আসিও বলেন, "শিক্ষার্থীরা কখনোই স্কুলে এসে এটা বলে না যে, 'আজ আমি খারাপ আচরণ করতে যাচ্ছি," । এই আচরণগত সমস্যার পেছনে অবশ্যই কোন না কোন কারণ রয়েছে। এসব কারণ জানতে যাচাই করে নিতে হবে শিশুর পেছনের জীবনের কিছুটা ঘটনা। খারাপ আচরণ প্রকাশ মানেই যে সে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার আক্রান্ত এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। এ ব্যাপারে মনরোগবিদ ক্যরেন ইয়াং জানিয়েছেন, মানসিক উদ্বিগ্নতা, সুস্থ মস্তিষ্কের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া থেকে সৃষ্টি হতে পারে। তাদের এমন প্রতিক্রিয়া সুস্থ মস্তিষ্কেরই কাজ। তবে এটাও ঠিক যে, খারাপ আচরণের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতির যোগসূত্র রয়েছে। "কারো যদি কোন সহায়তার প্রয়োজন হয় এবং সঠিক সময়ে যদি সে সেই সাহায্য না পায় তাহলে সেটা ব্যক্তির আচরণকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।" রাগের বহি:প্রকাশ ছেলে ও মেয়েদের কি সমান? রাগের প্রতিক্রিয়া সাধারণত মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের বেশি হয়ে থাকে। কেননা ছেলেদের নানা জায়গায় বাধার মুখে পড়ার হার মেয়েদের চেয়ে বেশি। "ছেলেরা স্বভাবতই তাদের আচরণের বহি:প্রকাশ ঘটায়। তারা লড়াই বা বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে। এবং তাদের হতাশা সহজেই আঁচ করা যায়। "অন্যদিকে মেয়েরা তাদের অনুভূতিকে স্বভাবতই দাবিয়ে রাখে। - তারা শুধু একা থাকতে চায়।" কখন বুঝবেন এটা মানসিক সমস্যা? করণীয় কি? সাধারণত যেসব ছেলে বিক্ষিপ্ত আচরণ করে তাদের ওপর অনেক সময় খারাপ ছেলের লেবেল জুড়ে দেয়া হয়। সুতরাং বাবা-মা এবং শিক্ষকরা কীভাবে বুঝতে পারবেন যে তাদের বাচ্চার খারাপ আচরণ সীমা অতিক্রম করছে এবং মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে মোড় নিয়েছে? দাতব্য ওয়েবসাইট মেন্টালি হেলদি স্কুলসের মতে, বাচ্চাদের আচরণ থেকেই জানা যায় যে তারা কিভাবে নিজেদের গোপন সমস্যা বা দুর্দশার সঙ্গে মানিয়ে চলছে। তাই এটা বোঝা জরুরি যে শিশুটি তার আচরণের মাধ্যমে আপনাকে কিছু বলার চেষ্টা করছে কিনা। এ ব্যাপারে প্রাক্তন শিক্ষক ব্রেন্ডা ম্যাকহিউ জানান, "আমাদের স্কুলে একবার ১০ বছর বয়সী একটা ছেলে বলেছিল যে সে মনে করতো যে সবাই তাকে 'মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা আক্রান্ত কড়া ছাত্র' হিসাবে দেখে। "কিন্তু সে নিজেকে একজন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানুষ হিসাবে বর্ণনা করে - যার সঙ্গে তার মায়ের শারীরিক স্বাস্থ্য এবং ঘন ঘন হাসপাতালে ভর্তি থাকা যুক্ত - সে জানেনা এ বিষয়ে সে কিভাবে কথা বলবে বা পরিস্থিতি কিভাবে সামলাবে।" ওয়েস্টমিনস্টারের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আচরণগত সমস্যায় আক্রান্ত ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সী মেয়েদের ওপর একটি ছোট জরিপ চালানো হয়। এই মেয়েরা নিজেদেরকে উদ্বেগ-জনিত সমস্যায় আক্রান্ত বলে বর্ণনা করলেও শিক্ষকরা তাদের "বিক্ষিপ্ত মানসিকতার" বলে লেবেল জুড়ে দেয়। আরও পড়তে পারেন: এক্ষেত্রে স্কুলগুলোর মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। তারা বলেন, "আমরা যদি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলি প্রাথমিক অবস্থায় মোকাবিলা না করি, তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম তাদের জীবনের শুরু থেকে ব্যর্থতার ঝুঁকিতে থাকবে।" অতিরিক্ত রাগান্বিত শিশুরা সাধারণত একটা দ্বন্দ্বে ভোগে যে তারা কাকে বিশ্বাস করবে? এসব শিশুর মেজাজ পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, তাদের বেশিরভাগের আবেগ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা খুবই কম। এজন্য তারা চাইলেও একে নিজের আয়ত্তে রাখতে পারেনা। এ কারণে এক পর্যায়ে তারা মানুষের সঙ্গে স্বাভাবিক যোগাযোগের ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে তাই যদি এই আচরণগুলো সময়ের সাথে চলতেই থাকে এবং মেজাজ প্রকাশের স্বাভাবিক সীমা অতিক্রমকে তারা আর পরোয়া করেনা। সেই-সঙ্গে যে আচরণ তাদের বিকাশ এবং জীবনের সম্ভাবনার পথে বিপদ ডেকে আনে। তখন এই বিষয়টিকে খতিয়ে দেখা জরুরি বলে মনে করেন গবেষকরা। কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার মানসিক অসুস্থতা বলতে কেবল কান্নায় ভেঙে পড়া, নিজেকে সবার থেকে আলাদা করে ফেলা বা নিজেকে আঘাত করা বোঝায় না। মেন্টাল হেলথ ফাউন্ডেশনের পরিচালক ডাক্তার অ্যান্টনিস কৌসৌলিস বলেছেন, অল্প বয়সীদের যারা এ ধরণের আচরণগত মানসিক সমস্যায় ভুগছে। তাদের ক্ষেত্রে প্রায়ই একটা প্রশ্ন ওঠে যে, "তারা কি নিজেরা সমস্যাগ্রস্ত নাকি তারা কোন সমস্যার মধ্যে আছে?" গুরুতর এবং স্থায়ী আচরণগত সমস্যা ডাক্তারি ভাষায় কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার হিসাবে পরিচিত - যেটা শৈশবের সাধারণ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর একটি। শিশুর কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার থাকার কয়েকটি লক্ষণ: বেশিরভাগ সময় ঝগড়াটে, ক্রদ্ধ, অসহযোগী এবং খিটখিটে মেজাজ থাকা। ঘন ঘন রাগের তীব্র বহি:প্রকাশ বা চিৎকার চেঁচামেচি করা। প্রতিনিয়ত ঝগড়া করার মেজাজে থাকা। এবং যেকোনো কিছু ঠিকঠাক না হলে সেজন্য অন্যকে দোষারোপ করা। মিস ম্যাকহিউ জানান, "এটি এমন একটি সমস্যা যা দীর্ঘসময় ধরেই চলে আসছে।" তবে কখন এটি স্বাভাবিক আচরণ এবং কখন এটি রোগের উপসর্গ? সেটা ধরতে পারা খুব কঠিন বলে তিনি জানান। এক্ষেত্রে শিশুর বাজে আচরণের হার কেমন সেটা বের করাই আসল কাজ বলে তিনি জানান। সূত্র : বিবিসি বাংলা
×