ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

আইয়ুব বাচ্চুর বিদায়

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ২২ অক্টোবর ২০১৮

আইয়ুব বাচ্চুর বিদায়

এক সময় যার গিটারের সুর আর দরাজকণ্ঠে সারা বাংলা আবেগে শিহরিত হতো, তা এখন শুধুই দুঃসহ স্মৃতি। একেবারে অসময়ে চলে গেলেন এই কিংবদন্তি সঙ্গীত সাধক। ১৯৬২ সালে চট্টগ্রামে জন্ম নেয়া এই সঙ্গীতরূপকার মাত্র ৫৬ বছর বয়সে নিজের বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান ঘটালেন। চলে যান অন্য এক জগতে সবার ধরাছোঁয়া আর দৃষ্টির বাইরে। শৈশব-কৈশোর অতিক্রান্তের সুবর্ণ সময়ে বন্দরনগরীর পাহাড়, সমুদ্র আর ঘন সবুজের বনায়নের নির্মল সান্নিধ্যে গড়ে ওঠেন। সাংস্কৃতিক বৈভবে নিজের শিল্পী জীবন তৈরি হওয়াও ছিল এক স্নিগ্ধ আবহের অনুপম ঝঙ্কার। সঙ্গীত শিল্পে তাঁর পদচারণা ছিল মাত্র ১৬ বছর বয়সে। ‘হারানো বিকেলের গল্প’ বাণী সমৃদ্ধ এই গান দিয়ে সঙ্গীত শিল্পে শুভ সূচনা হলেও গিটার বাদক হিসেবে তার নাম, যশ ছড়াতেও বেশি সময় লাগেনি। সঙ্গীতের অকৃত্রিম বোধ নিয়ে যার জন্ম, বেড়ে ওঠা; সুরের অনবদ্য ঝঙ্কার তাকে সব সময়ই নিমগ্ন করবে এই স্বাভাবিক চেতনাকে লালন করা আইয়ুব বাচ্চু অতি অল্প সময়ে গানের ভুবনে নিজের জোরালো ভূমিকাকে নিরন্তর গতিতে এগিয়ে নিয়ে যান। রবিন নামে শিশুকাল থেকে পরিচিত এই বরেণ্য শিল্পী অতি সাধারণ মানুষের একেবারে নিকটতম ছিলেন। সুরের মূর্ছনায় নিজেকে যেভাবে সমর্পণ করতেন, একইভাবে চারপাশের অগণিত দর্শক-শ্রোতাকে মাতিয়ে দিতেও সময় নিতে হতো না। গিটারের অনবদ্য সুরের ঝঙ্কারে বিমুগ্ধ দর্শক-শ্রোতা এক অনাবিল আনন্দযজ্ঞে অবগাহন করত। আর সেই জগতের মহানায়ক আইয়ুব বাচ্চু নিরন্তর সাধনযজ্ঞে কতভাবেই না নিজেকে সমৃদ্ধ আর ভরিয়ে তুলতেন, সত্যিই তা এক অতুলনীয় অনুভব। গিটার বাজানো, কথা সাজানো, সুরের সাগরের নিমগ্ন এক সুর তাপস প্রায় ৪০ দশক ধরে যে মাত্রায় দর্শক-শ্রোতাকে নিয়ে যান, সেখানে তার তুলনা তিনি নিজেই। বাংলা গানের ব্যান্ড জগতে তাঁর অবিস্মরণীয় ভূমিকা সঙ্গীত বলয়ের অন্যমাত্রার এক শাখাকে কতখানি এগিয়ে দিয়েছে, তা তার অগণিত ভক্তের অন্তর্নিহিত বোধ আর অভিরুচির মধ্যেই ঋদ্ধ হয়ে আছে। ‘সোলস’-এ ব্যান্ড সঙ্গীতের প্রথম থেকেই অনবদ্য গিটার বাদকের ভূমিকায় তিনি বরণীয় হন। এরপর সঙ্গীতের অফুরন্ত ভান্ডার নিয়ে শুধু সামনের দিকেই এগিয়ে যাওয়া। আশি আর নব্বই দশকে সঙ্গীত ভুবনের সুবর্ণ সময় পার করা ছিল এক যুগান্তকারী পর্ব। বিপুল উৎসাহ আর উদ্যমে নিজেকে শিল্পীর কাতারে তৈরি করতে গিয়ে সর্বস্ব উজাড় করে দেয়া ছাড়া অন্য কোন কিছু তাঁকে তাড়িত করতে পারেনি। ১৯৯১ সালে এলআরবি নামে নিজের তৈরি করা ব্যান্ড তাকে নিয়ে যায় আরও বহু দূর। একের পর এক গানের এ্যালবামে সমৃদ্ধ হতে থাকে ব্যান্ড সঙ্গীতের অনন্য ভুবন। আইয়ুব বাচ্চুর উদাত্ত কণ্ঠবাণী আর সুরের ব্যঞ্জনা সারা বাংলাকে আলোড়িত করতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ভক্তের সংখ্যাও নিরন্তর ধারায় এগিয়ে যায়। সে সুর আর জোরালো কণ্ঠ কখনও থেমে যেতে পারে অকালে, অসময়ে সেটা কেউ ভাবনায়ও আনতে পারেনি। মরণের মতো দুঃসহ মহাসত্য এই কিংবদন্তি অজেয় শিল্পীকে তার ভক্তদের কাছ থেকে দূরে, আরও বহু দূর নিয়ে যায়। অগণিত ভক্তের ভালবাসা আর শোকের বন্যায় এই অমর শিল্পীকে মহাপ্রয়াণের পথে যাত্রা করতে হয়। সময়ের প্রজন্মের কাছে যিনি ছিলেন এক বলিষ্ঠ পথনির্দেশক, গানের ভা-ারকে পূর্ণ করার অবিচলিত নায়ক, শুধুমাত্র মৃত্যু তাকে কোন ভক্তের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না। তাঁর গান, সুর ব্যান্ড জগতই শুধু নয়, মিষ্টি সুরে গিটার বেজে ওঠার অনুপম রাগ-অনুরাগ সবই তাকে অমরত্ব দেবে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সজীব, সচল মানুষটিকে আর কখনও দেখা যাবে না। কেবল স্মৃতি বিজড়িত পর্বে আমাদের স্মরণ চেতনায় চিরস্থায়ী আসন সুদৃঢ় করবেন এই কষ্টকর অনুভূতি বয়ে বেড়াতে হবে। মৃত্যুঞ্জয়ী এই অকৃত্রিম শৈল্পিক যোদ্ধার বিদেহী আত্মার প্রতি সশ্রদ্ধ নিবেদন, শান্তিতে বাকি অনন্ত জীবন কাটুক এটাই অগণিত ভক্তের সর্বশেষ চাওয়া। তাঁকে হারানোর বেদনা প্রশমিত করার এই মুহূর্তে সান্ত¡নার কোন পথ আমাদের সামনে নেই। তবে এই গভীর শোক সামলে তাঁর সৃষ্ট জগতকে বাঁচিয়ে রাখা সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকের বিশেষ দায়িত্ব। আর সেই দায়বদ্ধতায় আমরা সদ্য প্রয়াত আইয়ুব বাচ্চুকে তার যথার্থ মর্যাদায় সমাসীন করতে পারব।
×