ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল খায়ের

সংগ্রামী গণনায়ক তোফায়েল আহমেদ

প্রকাশিত: ০৪:৩৩, ২২ অক্টোবর ২০১৮

সংগ্রামী গণনায়ক তোফায়েল আহমেদ

উনসত্তরের গণআন্দোলনের মহানায়ক, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বাংলাদেশ লিবারেশ ফ্রন্ট সংক্ষেপে বিএলএফ তথা মুজিব বাহিনীর অন্যতম অধিনায়ক, স্বৈরশাসন বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অকুতোভয় সংগঠক, সর্বোপরি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য কিংবদন্তি রাজনীতিক তোফায়েল আহমেদের আজ ৭৬তম জন্মদিন। পিতা আজহার আলী ও মাতা ফাতেমা খানমের কোল আলো করে ১৯৪৩ সালের ২২ অক্টোবর দ্বীপজেলা ভোলার কোড়ালিয়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ’৪৭-এ ভারতবর্ষ বিভক্ত হলে পূর্ব বাংলা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। শুরু হয় নব পর্যায়ের ঔপনিবেশিক শাসন। পাকিস্তান শাসনামলের দ্বিতীয় বছর তথা ’৪৯-এ আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা হয়। একই বছর তোফায়েল আহমেদের নিজ গ্রামে কোড়ালিয়া ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে লেখাপড়ায় হাতেখড়ি। এরপর খায়েরহাট জুনিয়র হাই স্কুল থেকে ষষ্ঠ এবং বোরহানউদ্দীন হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। বোরহানউদ্দীন হাই স্কুলে যখন ভর্তি হন তখন বাড়ি থেকে ৭ মাইল দূরে অবস্থিত স্কুলে পায়ে হেঁটে যাতায়াত করতে হতো। স্কুলে তখন কোন হোস্টেল ছিল না। আজ থেকে প্রায় ৬৮ বছর আগে তখনকার ভোলায় বিদ্যুত ছিল না, বৈদ্যুতিক বাতি, ফ্যান এসব কিছুই ছিল না। কেরোসিনের কুপি বা হারিকেনের স্বল্প আলোই ছিল একমাত্র ভরসা। পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলায় তার অপার আগ্রহ। প্রতি বছর স্কুল স্পোর্টসে এ্যাথলেটিক্সের প্রতিটি ইভেন্টে চ্যাম্পিয়ন হন। প্রথমে স্কুল চ্যাম্পিয়ন, পরে মহকুমা চ্যাম্পিয়ন এবং জেলায় গিয়ে রানারআপ হন। ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল এবং সাঁতার তার প্রিয় খেলা। ১০০ মিটার স্প্রিন্ট, ২০০ মিটার স্প্রিন্ট, ৪০০ মিটার স্প্রিন্ট এবং হপ স্টেপ অ্যান্ড জাম্প এই চারটি ইভেন্টে তিনি ছিলেন স্কুলের গর্ব। স্কুলে পড়াকালে শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত নাটক ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’-এ শাইলকের ভূমিকায় অভিনয় করেন। রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ হওয়া প্রসঙ্গে বিদ্যালয় জীবনের একটি ঘটনার স্মৃতি তর্পণ করে বলেন, ‘অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা আছে। ১৯৫৭ সনে ভোলায় উপনির্বাচন হয়। যে উপনির্বাচনে মতিউর রহমান শাহ বিজয়ী হন। হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর সঙ্গে এসেছেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সকলের প্রিয় নেতা ‘মুজিব ভাই’। নেতৃবৃন্দ এসেছিলেন সি-প্লেনে। ইলিশা নদীতে সেই প্লেন অবতরণ করে। আমাদের স্কুল মাঠে বিশাল জনসভা। প্রায় লক্ষাধিক লোক সমবেত হয়েছিল জনসভায়। সোহ্রাওয়ার্দী সাহেবের বক্তৃতার আগে বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা করেন। সে কী সুন্দর বক্তৃতা! তিনি যখন বক্তৃতা শুরু করেন, পুরো জনসভায় পিনপতন নিস্তব্ধতা। মনে আছে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনেছি। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যদি কখনও রাজনীতি করি তাহলে এই নেতার রাজনীতিই করব। কারণ, রাজনীতি করব এটা তো চিন্তার মধ্যেও ছিল না। রাজনীতির এই চিন্তা সেদিন থেকেই মাথায় প্রবিষ্ট হয়।’ বাবা-মায়ের আদরের সন্তান তোফায়েল আহমেদ পরম মমতাময়ী মায়ের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘মা আমাকে ভীষণ আদর করতেন। কখনই কাছ-ছাড়া করতে চাইতেন না। যে কারণে হোস্টেলে যখন ছিলাম তখন প্রতি সপ্তাহে মায়ের কাছে গিয়ে থাকতে হতো।’ শিক্ষকবৃন্দের প্রতি হৃদয়ের গভীর থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, ‘শিক্ষকগণ আমাকে ভীষণ স্নেহ করতেন। শিক্ষকরা তার কাছে ছিলেন পিতৃতুল্য। বিদ্যালয় জীবনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘অধ্যয়নের সুনিয়মিত অভ্যাস আর ক্রীড়া ক্ষেত্রে একচ্ছত্র আধিপত্য অচিরেই আমাকে স্কুল ক্যাপ্টেনের মর্যাদায় অভিষিক্ত করল। দশম শ্রেণীতে আমি ক্লাস ক্যাপ্টেন থেকে হলাম স্কুল ক্যাপ্টেন। স্কুল চলাকালে প্রতিদিন ক্লাস শুরুর পূর্বে মাঠে সকল ক্লাসের ছাত্রদের এ্যাসেম্বলি লাইনে দাঁড়াতে হতো। সকলের কণ্ঠে সমস্বরে জাতীয় সঙ্গীত গীত হতো। ক্যাপ্টেন হিসেবে আমি সকলকে ইংরেজীতে শপথ বাণী পাঠ করাতাম। আমার এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে, আমার কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে সকলে বলত, I Solemly promise to dedicate my life to the service of humanity... যাঁরা আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন তাদের আমরা সর্বদা শ্রদ্ধা করতাম, সম্মান করতাম। ১৯৬০-এ ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে এটা ছিল তাঁর জন্য বেদনাদায়ক। সে জন্য ঢাকা কলেজ ছেড়ে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি হন। তাঁর মাতৃভক্তি অনন্য এবং অনুসরণীয়! কলেজে পড়াকালে ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অভিযাত্রার শুরু। তারপর ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়ে ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ, ক্লাস ক্যাপ্টেন, স্কুল ক্যাপ্টেন, পরে ছাত্রলীগের এ্যাসিস্টেন্ট সেক্রেটারি, এ্যাডমিন সেক্রেটারি, ব্রজমোহন কলেজের ক্রীড়া সম্পাদক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ইকবাল হলের (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ক্রীড়া সম্পাদক, পরে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচন, তারপর হলের নির্বাচিত সহ-সভাপতি, সোশ্যাল সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের ভিপি, ডাকসুর ভিপি, ’৬৯-এর গণআন্দোলনে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র এবং ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন এবং ’৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ’৬৭ থেকে ’৬৯ সাল পর্যন্ত ডাকসুর ভিপি থাকাকালে চারটি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে বঙ্গবন্ধু মুজিব প্রদত্ত ৬ দফা হুবহু ১১ দফায় অন্তর্ভুক্ত করে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন। উল্লেখ্য, ’৬৬-এর ৮ মে থেকে ’৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ৩৩ মাস কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’র সকল রাজবন্দীকে নিঃশর্ত মুক্তিদানে তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সারা বাংলায় তৃণমূল পর্যন্ত তুমুল গণআন্দোলন গড়ে তোলেন এবং ’৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুজিবসহ সকল রাজবন্দীকে মুক্তিদানে স্বৈরশাসককে বাধ্য করেন। পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) ১০ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে মুক্তমানব শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। আর ’৬৯-এর ২৫ মার্চের মধ্যে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে পদত্যাগে বাধ্য করে গৌরবের যে ইতিহাস সৃষ্টি করেন তা ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের ড্রেস রিহার্সেল। ’৭০-এর ৭ জুন আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে ভোলা-দৌলত খাঁ-তজুমুদ্দী-মনপুরা আসন থেকে বঙ্গবন্ধু তাঁকে ২৬ বছর বয়সে মনোনয়ন দেন। ’৭০-এর ১২ নবেম্বর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে দেশের উপকূলীয় এলাকায় ১০ লক্ষাধিক লোক মৃত্যুবরণ করে। এর মধ্যে ভোলায় তাঁর নির্বাচনী এলাকা ছিল সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কারণে উপকূলীয় এলাকার কয়েকটি আসনের নির্বাচন পিছিয়ে ’৭১-এর ১৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় এবং উক্ত আসন থেকে মাত্র ২৭ বছর বয়সে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ’৭১-এর ৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঐতিহাসিক সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শপথ অনুষ্ঠানে তিনি শপথ গ্রহণ করেন। এরপর ’৭১-এর মার্চের ১ তারিখ পূর্বাহ্নে আহুত জাতীয় পরিষদ অধিবেশন একতরফাভাবে স্থগিত ঘোষণায় সারা দেশ প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন সংঘটিত করতে তিনি উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন। পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে ২৫ মার্চ রাত ১২টায় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে বাঙালী নিধনে গণহত্যা শুরু করলে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করতে জাতির জনকের পূর্ব নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সীমান্ত অতিক্রম করে প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং ১০ এপ্রিল মুজিবনগরে ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ গঠন, ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ প্রণয়ন ও অনুমোদন এবং ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ রাষ্ট্র সৃষ্টিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এরপর ১৭ এপ্রিল সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের পরমাকাক্সিক্ষত বিজয় অর্জনে বদ্ধপরিকর তোফায়েল আহমেদ ছিলেন ‘মুজিব বাহিনী’র অঞ্চলভিত্তিক দায়িত্বপ্রাপ্ত চার প্রধানের একজন। বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা, ফরিদপুর, যশোর, কুষ্টিয়া ও পাবনা সমন্বয়ে গঠিত মুজিব বাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর ৩০ লক্ষাধিক প্রাণ আর ৪ লক্ষাধিক মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হলে ১৮ ডিসেম্বর তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। একই বছরের ২২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ দেশে ফিরে এলে বিমান বন্দরে তাঁদের বীরোচিত সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন। বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মানুষ সোচ্চার হলে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দানে বাধ্য হয়। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১৪ জানুয়ারি প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তোফায়েল আহমেদকে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব নিয়োগ করেন। ’৭২-এর ১০ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হয়। গণপরিষদ সদস্য হিসেবে সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ৪ নবেম্বর গণপরিষদ কর্তৃক সর্বসম্মতিতে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’ গৃহীত হয় এবং ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর গণপরিষদের ৩৯৯ জন সদস্যের সঙ্গে তিনি ‘শহীদের রক্তে লেখা’ সংবিধানে স্বাক্ষর করেন। এরপর ’৭৩-এর ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোলা থেকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ, অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জনে বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহচর হিসেবে তিনি নিরলস পরিশ্রম করেন। ’৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার প্রতিষ্ঠার পর প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তিনি রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী নিযুক্ত হন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সফরে সঙ্গী হন। ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, অটোয়াতে কমনওয়েলথ সম্মেলন, লাহোরে ওআইসি সম্মেলন, আলজিরিয়ায় জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন, নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন এবং জ্যামাইকায় কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগদান এবং যুগোশ্লাভিয়া ও ইরাক সফর করেন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির জনকের নির্মম হত্যাকা-ের পরপরই তাঁকে প্রথমে গৃহবন্দী ও পরে পুলিশ কন্ট্রোল রুম এবং রেডিও অফিসে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। একই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘ ৩৩ মাস তিনি কারান্তরালে ছিলেন। ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০৮ এবং ২০১৪ সনের সংসদ নির্বাচনে পর পর তিনি এমপি নির্বাচিত হন। ’৯১ এবং ’৯৬-এর নির্বাচনে ভোলা-১ ও ভোলা-২ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিন জোটের রূপরেখার ভিত্তিতে ’৯১-এর জাতীয় সংসদে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনর্প্রবর্তনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। একই বছর আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য নির্বাচিত হন। পবিত্র সংবিধান থেকে কলঙ্কিত ‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’ অপসারণ, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার এবং মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তাঁর ভূমিকা অগ্রগণ্য। ’৯৬-এ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের গণরায়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর মহান জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্যের সরকারে তিনি শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। অর্পিত দায়িত্ব সাফল্যের সঙ্গে যথাযথভাবে পালন করে দেশ-বিদেশে রাষ্ট্র ও সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেন। মন্ত্রী হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সম্মেলনে যোগদান করে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পণ্য উন্নত দেশগুলোতে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকারের অঙ্গীকার আদায় করেন। এ সময় তিনি স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মুখপাত্র নির্বাচিত হন। মহান জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক স্বৈরশাসন বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংঘটিত করে সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন এবং সাংবিধানিক শাসন প্রতিষ্ঠায় বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী তোফায়েল আহমেদের অবদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। যে কারণে তিনি এরশাদ আমলে ৪ বার এবং ’৯৫-৯৬-এ ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার’-এর অধীনে নির্বাচনের দাবিতে যে আন্দোলন হয় তাতে খালেদা জিয়ার আমলে দীর্ঘদিন কারাবন্দী ছিলেন। এছাড়াও ২০০২-এ খালেদা-নিজামী জোট সরকারের শাসনামলে তাঁকে কারাবন্দী করা হয়। রাজনৈতিক জীবনে সর্বমোট ৭ বার তিনি কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। কিন্তু কোন স্বৈরশাসক তাঁকে কারাগারে আটকে রাখতে পারে নাই। মহান মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্রীয় আদর্শ-গণতন্ত্র, বাঙালী জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র-বাস্তবায়নে নিবেদিতপ্রাণ নেতার মূল মন্ত্র ‘অসত্যের কাছে কভু নত নহে শির, ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ লড়ে যায় বীর।’ রাজনৈতিক জীবনে ব্যাপক সংগ্রাম ও বিস্তর বন্ধুর পথ তাঁকে অতিক্রম করতে হয়েছে। সংগ্রামী জীবনে সততা, মেধা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও বাগ্মিতার ফলে সকল প্রতিকূলতা অতিক্রম করে জনকলাণমূলক রাজনীতির অভীষ্ট লক্ষ্যে তোফায়েল আহমেদ এগিয়ে চলেছেন। ’৭৫-এর পর রাজনীতির ক্ষেত্রে দল ও মতাদর্শ পরিবর্তনের হিড়িক পড়ে যায়। রাজনীতিকরা স্বৈরশাসকের বেচা-কেনার সামগ্রীতে পরিণত হয়। প্রলোভন ও হুমকির মুখে বহু আদর্শবাদী আদর্শচ্যুত হলেও তিনি ছিলেন নির্ভীক, ব্যতিক্রম এবং অনন্য। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চেতনার একনিষ্ঠ অনুসারী হিসেবে শুধু দেশের মানুষের কাছেই নয়, সমগ্র বিশ্বেই বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারক হিসেবে তিনি পরিচিত। ২০০১-এর ১ অক্টোবরের নির্বাচনে চার দলীয় জোটের ষাড়যন্ত্রিক কর্মকান্ডে তাঁর অনুকূলে প্রাপ্ত নির্বাচনী রায় ছিনিয়ে নেয়া হয়। এ নির্বাচনের পর দেশব্যাপী খালেদা-নিজামীর সরকার সংখ্যালঘু জনসাধারণসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর প্রচন্ড অত্যাচার-নির্যাতন করে। বিশেষ করে ভোলায় এই নির্যাতনের মাত্রা ছিল ভয়াবহ! এর বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হন এবং চারদলীয় জোট ও ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিরোধী আন্দোলনে গুরুদায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ভোলা-২ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং জাতীয় সংসদের শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করে ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। স্বাধীন বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করার মহতী স্বপ্ন বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম সারথী সংগ্রামী গণনায়ক তোফায়েল আহমেদের শুভ জন্মদিনে তাঁর দীর্ঘজীবন কামনা করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা থেকে নিবেদিত পঙ্ক্তিমালা- হে নূতন দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদ্ঘাটন সূর্যের মতন। রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন। ব্যক্ত হোক জীবনের জয়, ব্যক্ত হোক তোমা মাঝে অসীমের চিরবিস্ময়! [email protected]
×