ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

দাপুটে জয়ে শুভ সূচনা বাংলাদেশের

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২২ অক্টোবর ২০১৮

দাপুটে জয়ে শুভ সূচনা বাংলাদেশের

অনলাইন রিপোর্টার ॥ সেঞ্চুরি করেই দুই হাতে ব্যাট নিয়ে দোলাতে থাকলেন ইমরুল কায়েস। ঠিক যেমনটি সন্তানকে দোলানো হয়। ইমরুল তার ২২দিনের পুত্র সন্তানকে উদ্দেশ্য করেই এমনভাবে সেঞ্চুরি উদযাপন করলেন। তার এ দাপুটে সেঞ্চুরিতে জিম্বাবুইয়েও ২৮ রানে উড়ে গেল। একটা সময় বিপদে দুলতে থাকা বাংলাদেশ দলকে ইমরুলই টেনে তোলেন। ম্যাচও জেতান। বাংলাদেশও তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেল। টস জিতে আগে ব্যাটিং করে বাংলাদেশ দল ২৭১ রান ৮ উইকেট হারিয়ে ৫০ ওভারে করে। ইমরুল একাই ১৪৪ রানের ইনিংস খেলেন। ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস খেলেন। ইমরুলের সঙ্গে সাইফউদ্দিনের ক্যারিয়ার সেরা ৫০ রান এবং এ দুইজনের সপ্তম উইকেটে করা দেশের হয়ে ১২৭ রানের জুটিতেই এত বড় স্কোর গড়া সম্ভব হয়। ১৩৯ রানেই যেখানে ৬ উইকেট পড়ে যায় বাংলাদেশের। সেখান থেকে দলকে মজবুত অবস্থানে নিয়ে যান ইমরুল-সাইফউদ্দিন। এরপর জবাব দিতে নেমে ৯ উইকেট হারিয়ে ৫০ ওভারে ২৪৩ রান করতে পারে জিম্বাবুইয়ে। বড় স্কোর গড়তে পারলেই জিম্বাবুইয়েকে চাপে ফেলে জয় তুলে নেয়া যাবে। তা আগে থেকেই জানা ছিল বাংলাদেশের। সেই স্কোরটি কত হলে ভাল হয়? অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা দেশের মাটিতে খেলা বলে আগেরদিনই বলেছিলেন, আড়াইশ রান হলেই হবে। কিন্তু বাংলাদেশ দল করে ২৭১ রান। তখনই আসলে বাংলাদেশের জেতার সম্ভাবনা যেন শতভাগ হয়ে যায়। জিম্বাবুইয়ের অবশ্য শুরুটা দারুণ হয়। কিন্তু ৪৮ রানে মুস্তাফিজের কাটারে ঝুওয়াউ (৩৫) আউট হওয়ার পর ৫৯ রানে নাজমুল অপুর ঘূর্ণির ফাঁদে পড়ে টেইলর (৫) যখন আউট হয়ে যান, জিম্বাবুইয়ে যেন নুয়ে পড়ে। ৬৩ রানে গিয়ে হ্যামিল্টন মাসাকাদজা (২১) রান আউট হওয়াতেতো জিম্বাবুইয়ের মেরুদ-ই ভেঙ্গে যায়। ৮৮ রানে গিয়ে যখন সিকান্দার রাজাও (৭) অপুর ঘূর্ণিতে কাত হলেন, তখন জিম্বাবুইয়ের হার যেন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ১০০ রান হতে মিরাজের স্পিন জাদুর সামনে পড়ে এরভিনও (২৪) সাজঘরে ফেরেন। পিটার মুর ও শন উইলিয়ামস মিলে কিছুটা এগিয়ে যান। কিন্তু ১৪৫ রানে গিয়ে মুরকে (২৬) এলবিডব্লিউ করে দেন মিরাজ। ৩ রান যোগ হতেই তিরিপানো রান আউট হয়ে যাওয়ার পর ১৬৯ রানে মিরাজের বলে কট এন্ড বোল্ড হন মাভুতা (২০)। নবম উইকেটে গিয়ে উইলিয়ামস ও জার্ভিস মিলে ৬৭ রানের জুটি গড়েন। এ দুইজন জিম্বাবুইয়েকে পুরো ইনিংস খেলার দিকে নিয়ে যান। ২৩৬ রানে গিয়ে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের বলে জার্ভিস (৩৭) আউট হন। শেষপর্যন্ত জিম্বাবুইয়ের পক্ষে সর্বোচ্চ রান করা উইলিয়ামস হাফসেঞ্চুরি করেন। পুরো ৫০ ওভারই খেলে জিম্বাবুইয়ে। শুরু থেকে চাপে থাকে বাংলাদেশ। লিটন কুমার দাসের সঙ্গে ইমরুল কায়েস ওপেনিংয়ে ব্যাট করতে নামেন। দুই পেসার কাইল জারভিস ও টেন্ডাই চাতারা মিলে দুই ওপেনারকে চাপে রাখেন। ১ রান হতেই লিটন রান আউট হওয়া থেকে বাঁচেন। এরপর আবার নিজের স্কোরবোর্ডে আর ১ রান যোগ হতে ক্যাচ আউট হওয়া থেকেও বাঁচেন। যদিও শর্ট কাভারে জার্ভিসের বলে সিকান্দার রাজার ধরা ক্যাচটি মাটি স্পর্শ করে। রাজাই থার্ড আম্পায়ার নেয়ার মতো করে আম্পায়ারদের ইঙ্গিত করেন। তাতে লিটন বেঁচে যান। দলের ৯ রানের মধ্যে দুইবার আউট হওয়া থেকে বাঁচেন লিটন। রানের খাতা মজবুত হচ্ছে না। অথচ একের পর এক আউট হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে থাকে। ডোনাল্ড তিরিপানোর বলে ইমরুলও একবার ক্যাচ আউট হওয়া থেকে বাঁচেন। শেষপর্যন্ত ১৬ রানে গিয়ে ৪ রান করা লিটন আউট হয়েই মাঠ ছাড়েন। চাতারার করা ষষ্ঠ ওভারের প্রথম বলে দুর্বল শটে মিড অফে ঝুওয়াউয়ের হাতে ধরা পড়েন লিটন। চাতারা যে কী বিধ্বংসী বোলিং করতে থাকেন। একই ওভারের শেষ বলে গিয়ে অভিষিক্ত ফজলে মাহমুদ রাব্বিকে বাউন্সারে কাত করেন চাতারা। হঠাৎ করে উঠে আসা বলটি বুঝতে পারেননি রাব্বি। বল ব্যাটে স্পর্শ করে উইকেটরক্ষক টেইলরের কাছে যায়। টেইলরও বামদিকে শূন্যে লাফিয়ে ক্যাচটি তালুবন্ধী করেন। ১০০তম ক্যাচ ধরেন টেইলর। অভিষেক ম্যাচটি দুঃস্মৃতিতেই পরিণত হয়ে থাকল রাব্বির। রানের খাতা খোলার আগেই আউট হয়ে যান। গত পাঁচ বছরে অভিষেক হওয়া দেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে শূন্য রানে অভিষেক হওয়া ব্যাটসম্যান হয়ে থাকেন রাব্বি। আর চাতারা যেন উড়তে থাকেন। এক ওভারেই ২ উইকেট শিকার করে ফেলেন। ১৭ রানে ২ উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়ে যায় বাংলাদেশ। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে তিন বছর পর দ্বিপক্ষীয় সিরিজে খেলতে নেমে শুরুতেই চাপে পড়ে যায় বাংলাদেশ। দেশের মাটিতে দুই বছর পর দ্বিপক্ষীয় ওয়ানডে সিরিজে খেলতে নেমে খাদের কিনারায় পড়ে যায় দল। সেই চাপ থেকে দলকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন ইমরুল কায়েস ও মুশফিকুর রহীম। ১০ ওভারে ৩৯ রান করা দলের রানের গতি দুইজন মিলে বাড়ানোর চেষ্টাও করতে থাকেন। দুইজনের জুটি যখন ৪৯ রানে যায়, দলের রান ৬৬ হয়, তখন মুশফিক (১৫) আউট হয়ে যান। আবার বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়ে যায় বাংলাদেশ। সেখান থেকে ইমরুল ও মোহাম্মদ মিঠুন মিলে এগিয়ে যেতে থাকেন। ইমরুল হাফসেঞ্চুরিও করে ফেলেন। তাকে যোগ্য সঙ্গ দিতে থাকেন মিঠুন। দুইজন মিলে ৫০ রানের জুটিও গড়ে ফেলেন। রানও ১০০ অতিক্রম করে ফেলে। সুন্দর চলছিল খেলা। দুইজন দারুণ খেলছিলেনও। হঠাৎ করেই সব ওলট পালট হয়ে যায়। মুহূর্তেই যেন উইকেট পড়ার ঝড় উঠল। দলের ১৩৭ রানের সময় ১৫ রান করা মিঠুনও জার্ভিসের গতির সামনে কাত হলেন। বাউন্সারে উইকেটরক্ষকের কাছে ক্যাচ দিয়ে মাঠ ছাড়লেন। জুটি ৭১ রানেই অবসান ঘটল। মিঠুন আউট হওয়ার পর দলের স্কোরবোর্ডে আরও ২ রান যোগ না হতেই মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ও মেহেদী হাসান মিরাজও (১) সাজঘরে ফেরেন। জার্ভিসের গতির সামনে মিঠুনের পর রিয়াদ ও মিরাজও দলের জন্য কিছুই করে যেতে পারেননি। ৬ উইকেট হারিয়ে দলও মহাবিপদে পড়ে যায়। এমন অবস্থায় একজনকে বড় স্কোর করতেই হতো। তা না হলে দল ২০০ রানও করতে পারবে কিনা, সেই শঙ্কায় জাগে। তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসান নেই। তখন এ দুইজনকে ছাড়া খেলা অসম্ভব। এমন কথাই উঠত। আবার মুশফিক, মাহমুদুল্লাহও নিজেদের মেলে ধরতে পারেননি। তাতে করে বড় বিপর্যয়ই দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু ইমরুল যে ছিলেন। একদিকে উইকেট পড়তে থাকে। আরেকদিকে ইমরুল যে বিশেষ কিছু উপহার দিতে প্রস্তুত ছিলেন। ষষ্ঠ উইকেট যখন পড়েছিল, তখন বাংলাদেশের স্কোর ছিল ১৩৯ রান। লিটন, রাব্বি, মুশফিক, মিঠুন, মাহমুদুল্লাহ, মিরাজ আউট হন। মিঠুন ছাড়া বাকি দলের নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যানরা ব্যর্থ হয়ে সাজঘরে ফেরেন। তখন ইমরুলের স্কোরবোর্ডে ৭৩ রান জমা থাকে। অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানদের মধ্যে শুধু থাকেন ইমরুলই। সঙ্গে সাইফউদ্দিন, মাশরাফি, মুস্তাফিজুর রহমান ও নাজমুল ইসলাম অপু থাকেন। ইমরুল কোনভাবে আউট হলে কিংবা বাকিরাও দ্রুত আউট হলে জিম্বাবুইয়ের কাছে হার নিয়েই হয়ত মাঠ ছাড়তে হবে। এমন যখন ধুঁকধুঁক অবস্থা, ধীরে ধীরে দৃশ্যপট পাল্টে যেতে থাকে। ম্যাচের পুরো চিত্রই পাল্টে দিতে থাকেন ইমরুল ও সাইফউদ্দিন। দেখতে দেখতে ১১৮ বলে ক্যারিয়ারের তৃতীয় ওয়ানডে সেঞ্চুরি করে ফেলেন ইমরুল। দলের রানও বাড়তে থাকে। যেখানে ২০০ রান করাটাই কঠিন হয়ে পড়েছিল। সেখানে দল ২০০ রানও করে ফেলে। ইমরুলের সঙ্গে সাইফউদ্দিনও সমানতালে এগিয়ে চলতে থাকেন। রুবেল হোসেনের পরিবর্তে খেলেন সাইফউদ্দিন। কিন্তু এ পেস অলরাউন্ডার সুযোগ পেয়েই নিজেকে মেলে ধরেন। নয়মাস পর জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পেয়েই ঝলক দেখান। এমন সময় জৌলুস ছড়ানো ব্যাটিং করেন, যখন দলের খুব প্রয়োজন ছিল। দেখতে দেখতে ২০১০ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মুশফিক ও নাঈম ইসলামের সপ্তম উইকেটে করা ১০১ রানের জুটিকেও পেছনে ফেলেন। এ উইকেটে দেশের হয়ে রেকর্ড জুটি গড়েন দুইজন। ১২৭ রানের জুটি যখন হয়, দলের স্কোরবোর্ডে যখন জয়সূচক রান জমা হয়ে যায়, ২৬৬ রান হয়; তখন ইমরুল আউট হয়ে যান। তার সামনে দেশের হয়ে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ ১৫৪ রান করা তামিমকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু ইনিংস শেষ হওয়ার ৮ বল বাকি থাকতে ১৪০ বলে ১৩ চার ও ৬ ছক্কায় ১৪৪ রান করে আউট হন ইমরুল। সময়োপযোগী অসাধারণ এক ইনিংস খেলে মাঠ ছাড়েন ইমরুল। যে ইনিংসটি বিপর্যস্ত হয়ে পড়া বাংলাদেশকে জয়ের আশায় ভাসাতে শুরু করে দেয়। তবে ইমরুলের সঙ্গে ম্যাচটিতে আসলে সাইফউদ্দিনও প্রশংসা কুড়ান। তিনি যে ইমরুলকে যোগ্য সঙ্গ দেন। না হলেতো দল আগেই ধসে পড়ত। শেষপর্যন্ত সাইফউদ্দিনও ক্যারিয়ার সেরা ৫০ রান করে আউট হন। ৬৯ বলে ৩ চার ও ১ ছক্কায় এই রান করে ইনিংস শেষ হওয়ার ৫ বল বাকি থাকতে সাইফউদ্দিন সাজঘরে ফেরেন। যেন জয়ের নিশ্বাস ফেলতে ফেলতেই বের হন সাইফউদ্দিন। আর মনেতো আনন্দ ছিলই। খেলার সুযোগ পেয়েই যে মাতিয়ে দিয়েছেন। সাইফউদ্দিন আউটের পর মাশরাফি (২*) ও মুস্তাফিজ (১*) মিলে দলকে ২৭১ রানে নিয়ে গিয়ে মাঠ ছাড়েন। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেই মাঠ ছাড়েন অধিনায়ক মাশরাফি। জিম্বাবুইয়ের ৫০ ওভার যখন শেষ হয়, তখন জয়ের আনন্দ ও শান্তি নিয়েও মাঠ ছাড়েন মাশরাফি। সবচেয়ে বেশি হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন যেন ইমরুল। পুত্র সন্তানের বাবা হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই এমন এক ইনিংস খেললেন। যে দাপুটে ইনিংস দলকেও সহজেই জেতাল। জিম্বাবুইয়ে পুরো ৫০ ওভার খেললেও কখনোই মনে হয়নি জিততে পারে জিম্বাবুইয়ে। জিম্বাবুইয়েকে উড়িয়ে দিল বাংলাদেশ।
×