ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নিরঞ্জন রায়

বাংলা সঙ্গীতের দু’জন গুণী শিল্পীর প্রয়াণ

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ২৪ অক্টোবর ২০১৮

বাংলা সঙ্গীতের দু’জন গুণী শিল্পীর প্রয়াণ

এই অক্টোবর মাসেই আমরা হারালাম বাংলা সঙ্গীতের দু’জন গুণী শিল্পীকে। একজন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গীত পরিচালক, শব্দসৈনিক রঙ্গলাল দেব চৌধুরী এবং আরেকজন বাংলা রক সঙ্গীতের আইকন আইয়ুব বাচ্চু। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের শব্দসৈনিক রঙ্গলাল দেব চৌধুরী ৮৩ বছর বয়সে গত ১৮ অক্টোবর টরেনটোতে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। একই দিন বাংলা সঙ্গীতের অত্যন্ত জনপ্রিয় শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু আমাদের ছেড়ে চলে যান। একজন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দিয়ে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং আরেকজন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করতেন। পার্থক্য শুধু রঙ্গলাল দেব চলে গেলেন পরিণত বয়সে, আর আইয়ুব বাচ্চু অসময়ে অর্থাৎ মাত্র ৫৬ বছর বয়সে। রঙ্গলাল দেব চৌধুরী সিলেট বেতারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের সঙ্গীতের বিকাশ নিয়ে তার অনেক কাজ করার ইচ্ছা ছিল এবং শুরুও করেছিলেন কিন্তু খুব একটা এগুতে পারেননি। ১৯৭৫-এর পর তার ছেলেমেয়েরা কানাডা চলে আসলে তিনিও কানাডা চলে আসেন। সেইসঙ্গে থেমে যায় একজন গুণী শিল্পীর প্রতিভা। কেননা প্রবাসের বৈরী পরিবেশে বাংলা সঙ্গীত নিয়ে অনেক কথাবার্তা বললেও তার সঙ্গীত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ তেমন পাননি। স্বাধীনতা যুদ্ধের অনেক স্মৃতির কথা এবং বাংলা সঙ্গীত নিয়ে তার নানা ভাবনা অনেকের সঙ্গে আলোচনা করেই তিনি মূলত সময় পার করেছেন। সুখ-দুঃখের এবং পাওয়া না পাওয়ার অনেক স্মৃতি ধারণ করেই সুন্দর একটি প্রবাস জীবন পার করে ৮৩ বছর বয়সে চলে গেলেন পরপারে। আইয়ুব বাচ্চুর চলে যাওয়া অনেক বেদনার এবং অনেক কষ্টের। এই মৃত্যু মেনে নেয়া কষ্টকর। বাংলা রক সঙ্গীতে আইয়ুব বাচ্চুকে বলা হয় একটি প্রতিষ্ঠান। সমগ্র বাংলা সঙ্গীত জগতে হাতেগোনা কয়েকজন শিল্পী বাংলা রক সঙ্গীতকে অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তুলেছেন, তাদের মধ্যে আইয়ুব বাচ্চু অন্যতম। আমি রক সঙ্গীতের বোদ্ধা শ্রোতা নই। কিন্তু যে সকল শিল্পী সম্পূর্ণ নতুন এবং বৈরী পরিবেশে বাংলা রক সঙ্গীতকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন তা আমাকে মুগ্ধ করে দিয়েছে। গত শতাব্দীর আশির দশকের শুরুর দিকে আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন আমাদের দেশে এই ব্যান্ড সঙ্গীতের যাত্রা শুরু। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ব্যান্ডের সঙ্গীত পরিবেশন করা হতো। গিটার হাতে বিশাল বহরের এক বাদ্যযন্ত্রের তালে তরুণ শিল্পীরা নেচে নেচে বা কখনও লাফিয়ে লাফিয়ে গান গেয়ে উপস্থিত স্রোতাদের মাতিয়ে তুলত। সে সব গায়কের অন্যতম জনপ্রিয় এক ব্যক্তি ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। যে অনুষ্ঠানে আইয়ুব বাচ্চু সঙ্গীত পরিবেশন করত সেই অনুষ্ঠানে দর্শক-শ্রোতাদের স্থান সঙ্কুলান করা কষ্টকর হয়ে যেত। আইয়ুব বাচ্চু তার নিজস্ব ব্যান্ড, এলআরবি প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেই ব্যান্ড খুব অল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যায়। গত শতকের সত্তর-আশির দশকে এবং তার পরবর্তী সময় বিশ্বব্যাপী সঙ্গীতের জগতে আমূল পরিবর্তন সাধিত হতে থাকে। গতানুগতিক মেলোডি এবং ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের ধারা পরিবর্তন করে রক সঙ্গীত খুব দ্রুতই জায়গা করে নিতে থাকে। ক্রমেই বিশ্বব্যাপী এই রক সঙ্গীত খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই পরিবর্তনের ঢেউ আমাদের দেশেও লাগতে শুরু করে। তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ইংরেজী ও হিন্দী রক সঙ্গীতের ভক্ত বনে যায়। এমন সময় বাংলাদেশের উদীয়মান কিছু শিল্পী গিটার বাজিয়ে বাংলায় রক সঙ্গীতের চর্চা শুরু করেন এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তা পরিবেশনও শুরু হয়ে যায়। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সঙ্গীতের এই ধারা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই কাজে অনেক ত্যাগ স্বীকার করে সর্বোচ্চ অবদান রেখেছেন এবং সফল হয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু। আইয়ুব বাচ্চু যে শুধু চমৎকার বাংলা রক সঙ্গীত পরিবেশন করতেন তাই নয়, রক সঙ্গীতের মঞ্চ মাতানোর ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। আইয়ুব বাচ্চুর গান ক্যাসেট বা সিডিতে শুনতে যত না আনন্দ পাওয়া যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি উপভোগ করা যায় তার মঞ্চের পরিবেশনা। আইয়ুব বাচ্চু শুধু রক সঙ্গীত গায়ক ছিলেন তাই নয়, তিনি বিশিষ্ট গিটার বাদকও ছিলেন। তাকে বলা হয় গিটারের জাদুকর। তিনি যে সময় গিটার হাতে নিয়েছিলেন তখন এই বাদ্যযন্ত্রটি সহজলভ্য ছিল না। এমনকি এই বাদ্যযন্ত্রে প্রশিক্ষণ দেয়ার মতো দক্ষ গিটার বাদকও ছিল না। এমন পরিবেশে আইয়ুব বাচ্চু গিটার সংগ্রহ করে নিজে বাজানো শিখেছেন এবং দক্ষতা অর্জন করেছেন। তিনি রক সঙ্গীতের অনেক জনপ্রিয় গানে সুর দিয়েছেন। তার নিজস্ব একটি রেকর্ডিং হাউস ছিল বলে জেনেছি। তরুণ প্রজন্মের অনেক রক সঙ্গীতশিল্পী তৈরি করার ক্ষেত্রে রয়েছে তার সবচেয়ে বড় অবদান। আইয়ুব বাচ্চুর গান গেয়েই এই প্রজন্মের তরুণ শিল্পী নোবেল জীবাংলার সা রে গা মা পা অনুষ্ঠানের চলতি সিজনে স্থান করে নিয়েছেন। সেই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক নোবেলকে ঢাকা থেকে আগত বাংলাদেশের রকস্টার বলেই পরিচয় করিয়ে দেয়। আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর একদিন পরই জী-বাংলার সা রে গা মা পার যে এপিসোর্ডটি প্রচারিত হয়েছিল সেখানে নোবেল আইয়ুব বাচ্চুর সুরে একটি গান এত চমৎকারভাবে পরিবেশন করেছিলেন যা শুনে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতা এবং বিচারকগণ অভিভূত হয়ে যান। নোবেলের কণ্ঠে সেই গান শুনে উপস্থিত সকল বিচারক তাকে শত ভাগ নম্বর তো দিয়েছিলেনই, অধিকন্তু বিচারক হিসেবে আসা মোনালী ঠাকুর নোবেলের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে একটি গান গাওয়ার ইচ্ছাও পোষণ করেছেন। আইয়ুব বাচ্চু বাংলা রক সঙ্গীতে অসামান্য অবদান রেখে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থেকে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে এমন এক সময় চলে গেলেন যখন বাংলার ব্যান্ড সঙ্গীত তার হাত ধরে আরও সমৃদ্ধ হতে পারত। তার এই অকাল মৃত্যুতে বাংলা সঙ্গীতে এমন ক্ষতি হয়ে গেল যা খুব সহজে পূরণ হওয়ার নয়। সব মৃত্যুই তা সে পরিণত বয়সের মৃত্যুই হোক আর অকাল মৃত্যুই হোক সমান কষ্টের এব সমান বেদনার। আমরা এই অক্টোবর মাসে যে দু’জন গুণী শিল্পী রঙ্গলাল দেব চৌধুরী এবং আইয়ুব বাচ্চুকে হারিয়েছি তাদের আত্মার শান্তি কামনা করি। লেখক : ব্যাংকার ২৩ অক্টোবর ২০১৮, টরনটো, কানাডা [email protected]
×