ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নৌপথ সচল রাখতে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকায় কেনা হবে ৩৫ ড্রেজার

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২৪ অক্টোবর ২০১৮

নৌপথ সচল রাখতে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকায় কেনা হবে ৩৫ ড্রেজার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশের নৌপথগুলো আন্তর্জাতিক পরিবহন ব্যবস্থার আওতায় নেয়া সম্ভব হলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে। কিন্তু নাব্য সঙ্কটে নৌরুটগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে ওঠে। ফলে অভ্যন্তরীণ পরিবহন ব্যবস্থায়ও নৌপথের কার্যকর ব্যবহার সম্ভব হয় না। এ পরিস্থিতিতে দেশের নৌপথ সচল রাখতে ৩৫টি ড্রেজার কেনার জন্য ৪৪৮৯ কোটি তিন লাখ টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে সরকার। মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ‘৩৫টি ড্রেজার ও সহায়ক জলযানসহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি সংগ্রহ এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পসহ ২১টি প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ২১টি প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট খরচ ধরা হয়েছে ১৯ হাজার ৭৭৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারী তহবিল থেকে ১৭ হাজার ৩১৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, বাস্তবায়নকারী সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন হবে ২৩৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা এবং বৈদেশিক সহায়তা থেকে ২ হাজার ২২৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা দেয়া হবে। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ অনুমোদন দেয়া হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন একনেক চেয়ারপার্সন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা সচিব জিয়াউল ইসলাম, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এমরান কবির চৌধুরীসহ অন্যরা। পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, আমাদের ডেল্টা প্ল্যান যে নেয়া হয়েছে সেখানে নদী খাল বিল এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সারাবিশ্বেই। এসবের হাত থেকে অব্যাহতি পাব না। তবে এটিকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় সে চেষ্টা করতে হবে। তাই নদী শাসনের বিকল্প নেই। মন্ত্রী বলেন, এই প্রকল্পের মধ্য দিয়ে অভ্যন্তরীণ নৌপথের এক শ’ নদী খনন করে প্রায় ৮ হাজার কিলোমিটার নৌপথের নাব্য উন্নয়ন ও সংরক্ষণের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ নৌরুট ও ফেরি রুটগুলোর সারাবছর ফেরি, লঞ্চ, কার্গো ভেসেল ও অন্যান্য নৌযান নির্বিঘেœ চলাচলের উপযোগী করা হবে। পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান ড্রেজিং চাহিদা মেটানোর জন্য বিআইডব্লিউটিএয়ের ড্রেজিং সক্ষমতাও বাড়বে। জানা গেছে, দেশের নদীগুলোর নাব্য সংরক্ষণের জন্য বছরে যে পরিমাণ ড্রেজিং করা প্রয়োজন, বিআইডব্লিউটিএয়ের পর্যাপ্ত ড্রেজার ও সহায়ক জলযান না থাকায় সে চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশ নৌপথে যাতাযাতের জন্য আন্তর্জাতিক নৌরুট চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। এর আওতায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথও রয়েছে। দেশের নৌপথগুলো আন্তর্জাতিক পরিবহন ব্যবস্থার আওতায় নেয়া সম্ভব হলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে। কিন্তু নৌরুটগুলো নাব্য সঙ্কটের মুখে পড়লে তা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে ওঠে। তাই নৌরুটগুলোর নাব্য উন্নয়ন ও সংরক্ষণ ড্রেজিং কার্যক্রম আরও জোরদার করা প্রয়োজন। পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, বিআইডব্লিউটিএয়ের ড্রেজার বহরে বর্তমানে ২৫টি ড্রেজার রয়েছে, যা দিয়ে বছরে প্রায় ১১৪ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং করা যায়। চলমান একটি প্রকল্পের আওতায় ২০১৮ সালে ১০টি এবং ২০১৯ সালে ১০টি ড্রেজার সংগ্রহ হবে। ফলে ২০১৯ সালে বিআইডব্লিউটিএয়ের ড্রেজিং ক্ষমতা বেড়ে প্রায় ৩৪৬ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার হবে। এদিকে, বেসরকারী ড্রেজার সংখ্যাসহ বর্তমানে দেশের মোট ড্রেজিং সক্ষমতা বছরে প্রায় ৮৪৬ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার। অন্যদিকে বিআইডব্লিউটিএয়ের বার্ষিক ড্রেজিং চাহিদা প্রায় ১ হাজার ৬৫৫ লাখ ১০ হাজার ঘনমিটার। অর্থাৎ বর্তমানে বার্ষিক ড্রেজিং ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৮০৮ লাখ ৬০ হাজার ঘনমিটার। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের এই প্রকল্প সেই ঘাটতি অনেকটাই পূরণে সক্ষম হবে। একনেকে অনুমোদন পাওয়া অন্য প্রকল্পগুলো হচ্ছে, কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার পুনর্নির্মাণ, এটি বাস্তবায়নে খরচ হবে ৬২৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। এই বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, প্রত্যেক জেলখানায় একটি করে কোর্ট রুম স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার পুনর্নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যাতে আসামিদের সশরীরে কোর্টে হাজির হতে না হয় সেজন্য ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে কোর্ট রুম থেকে কোর্টের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। এছাড়া দ্বিতীয় নগর উন্নয়ন প্রকল্পভুক্ত নগরগুলোর জন্য একটি করে মাস্টারপ্ল্যান তৈরিরও নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, নগরগুলোতে যাতে প্রকল্পের দ্বৈততা সৃষ্টি না হয়। সেজন্য মাস্টার প্ল্যান প্রয়োজন। ৩৫টি ড্রেজার ও সহায়ক জলযান সংগ্রহসহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি সংগ্রহ এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ খরচ ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৪৮৯ কোটি তিন লাখ টাকা। দ্বিতীয় নগর অঞ্চল উন্নয়ন প্রকল্প খরচ ধরা হয়েছে ১ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা। এই প্রকল্প নিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, দ্বিতীয় নগর অঞ্চল উন্নয়ন প্রকল্পটি ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর। প্রকল্পের আওতায় ২৫৭ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন, ১৫৩ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ, ১ হাজার ৭২২ মিটার ব্রিজ বা কালভার্ট নির্মাণ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। এটি বাস্তবায়িত হবে ঢাকা বিভাগের সাভার এবং সাভার পৌরসভা, ধামরাই পৌরসভা, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন, কালিয়াকৈর পৌরসভা, নারায়ণগঞ্জ জেলার কাঞ্চন, তারাব, সোনারগাঁও পৌরসভা এবং রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজার উপজেলা, মানিকগঞ্জের মানিকগঞ্জ ও সিংগাইর পৌরসভা এবং নরসিংদী পৌরসভায়। এছাড়া খুলনা বিভাগের খুলনা সিটি কর্পোরেশন, চালনা পৌরসভা, যশোর জেলার যশোর, নওয়াপাড়া ও ঝিকরগাছা পৌরসভা এবং বাগেরহাট জেলার মোংলা পৌরসভায়। এছাড়াও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক পুনর্বাসনসহ নর্দমা ও ফুটপাথ উন্নয়ন খরচ ধরা হয়েছে ৭৭৪ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। বরিশাল শহরের জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজিত নগর উন্নয়ন প্রোগ্রাম খরচ ধরা হয়েছে ১৩০ কোটি ১৯ লাখ টাকা। সৌর বেস স্টেশন স্থাপনের মাধ্যমে দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে টেলিটক নেটওয়ার্ক কভারেজ শক্তিশালীকরণ, খরচ ৪০৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা। ভূমি অধিগ্রহণ ও ইউটিলিটি স্থানান্তর প্রকল্প: সাপোর্ট টু ঢাকা (কাঁচপুর)-সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ এবং উভয় পাশ্বে সার্ভিস লেন নির্মাণ, খরচ ৩ হাজার ৮৮৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা। কেরানীহাট-বান্দরবান জাতীয় মহাসড়ক যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ, খরচ ২৩৫ কোটি তিন লাখ টাকা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন খরচ ধরা হয়েছে ১ হাজার ৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রকল্প নিয়ে কথা বলতে গিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, এখন থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শীতকালে অতিথি পাখি দেখতে গেলে দর্শনার্থীদের জন্য টিকেটের ব্যবস্থা করতে হবে। সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় বাড়বে। সেই সঙ্গে সেখানকার সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বিদেশে এ রকম কিছু দেখতে গেলে টাকা লাগে আমরাও এখন সেটি করব। অনুমোদন পাওয়া আরও প্রকল্প হলো, বাংলাদেশ সরকারী কর্মকমিশন সচিবালয়ের ৭টি আঞ্চলিক কার্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ, খরচ হবে ১২৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা। সিপিজিসিবিএল-সুমিতোমো ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে ভূমি অধিগ্রহণ ও আনুষঙ্গিক কার্যক্রমে খরচ ধরা হয়েছে ১ হাজার ২৭০ কোটি ৯ লাখ টাকা। পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র সংযোগ সড়ক ও আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণে খরচ ধরা হয়েছে ২৫০ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এস্টাবলিস্টমেন্ট অব থ্রি হ্যান্ডলুম সার্ভিস সেন্টারস ইন ডিফারেন্ট লুম ইনটেনসিভ এরিয়া প্রকল্পে খরচ ৮৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা। বাংলাদেশ তাঁত শিক্ষা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট নরসিংদীর আধুনিকায়ন ও অবকাঠামোগত সম্প্রসারণে খরচ ধরা হয়েছে ৬০ কোটি ১৫ লাখ টাকা। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অবকাঠামো উন্নয়ন খরচ ৬৯০ কোটি টাকা। গড়াই নদী ড্রেজিং ও তীর সংরক্ষণ খরচ ৫৯১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের চর-বাগাদী পাম্প হাউস ও হাজিমারা রেগুলেটর পুনর্বাসন খরচ ১১৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। রংপুর বিভাগ কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পে খরচ ধরা হয়েছে ৩২১ কোটি ২২ লাখ টাকা। মহিষ উন্নয়ন (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকল্পে খরচ ধরা হয়েছে ১৬২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফে পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন কার্যক্রম জরুরী সহায়তা, খরচ ৫৫৮ কোটি ৩৩ লাখ টাকা এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬৫৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
×