ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

লেবাননের অর্থনীতিতে দুর্যোগের ঘনঘটা

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ২৪ অক্টোবর ২০১৮

লেবাননের অর্থনীতিতে দুর্যোগের ঘনঘটা

বৈরুতের দিগন্তের দিকে চোখ মেললে প্রধান যে দৃশ্যটা চোখে পড়বে তা মসজিদের মিনার বা গির্জার চূড়া নয় বরং দেখা যাবে একের পর এক কনস্ট্রাকশন ক্রেন। চারদিকে সব বিলাসবহুল এ্যাপার্টমেন্ট উঠছে। যার এক একটির মূল্য ১০ লাখ ডলার। মনে হবে অর্থনীতিতে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। লেবাননের অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির জন্য পর্যটন, নির্মাণ ও অর্থলগ্নির ওপর নির্ভর করে। মনে হবে যেন এই তিনটিরই জোয়ার বইছে। কিন্তু বাস্তবে এ সবই মায়া বা বিভ্রম। লেবানন দেশটার অর্থনীতি আসলে রুগ্ন। সেখানে রিয়েল এস্টেট মন্দার দিকে চলেছে। ব্যাংকগুলোও সঙ্কটকবলিত হতে যাচ্ছে যার পরিণতিতে এর মুদ্রা হুমকির মুখে রয়েছে। একটা অর্থনৈতিক ধস সৃষ্টি হলে উদ্বাস্তু আকীর্ণ এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনে বিক্ষত এই দেশটির স্থিতিশীলতা বিপন্ন হতে পারে। ব্যাংকিং খাত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীদের এখানে টেনে এনেছে। এই খাতে সঙ্কট দেখা দিলে তা লেবানন সীমান্তের বাইরে তা অনুভূত হবে। পর্যটন শিল্প দিয়েই শুরু করা যাক। আঞ্চলিক অসন্তোষের কৃষ্ণ অধ্যায় থেকে এই শিল্প উঠে দাঁড়াচ্ছিল। ট্যুরিস্ট আগমন ২০১৭ সালে ৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যায় পৌঁছে। তবে ২০১০ সালে তুঙ্গে থাকার সময়কার সংখ্যা থেকে এটা এখনও কম। কিন্তু এই শিল্পে এখন অস্থিরতা শুরু হয়েছে। গত নবেম্বর মাসে সৌদি আরব সেই দেশ সফরে যাওয়া লেবাননী প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরিকে আটক করে পদত্যাগে বাধ্য করে এবং পরে সেই অবস্থান বদলে ফেলে। এ ঘটনার এক মাসের মধ্যে পর্যটনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। হোটেলগুলোতে ট্যুরিস্টদের বুকিং দেয়া ১৪ শতাংশ কমে যায়। ট্যুরিস্টদের ব্যয়ের সবচেয়ে বড় অংশ হতো সৌদি ট্যুরিস্টদের হাত দিয়ে। তাদেরই সংখ্যা এ বছর কমে এসেছে ১৯ শতাংশ। বিনিয়োগ হয়ে পড়েছে স্থবির। কাফালাত নামে একটি প্রতিষ্ঠান গত বছর ১১৭টি ছোট ও মাঝারি আকারের পর্যটন প্রকল্পে ঋণ দিয়েছিল। এর প্রকল্প সংখ্যা ২০১৬ সালের তুলনায় ৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। আর ২০১৮ সালের প্রথমার্ধে আরও ১৮ শতাংশধ হ্রাস পেয়েছে। অধিক উদ্বেগজনক অবস্থা হলো নির্মাণ শিল্পের। ১০টি চাকরির মধ্যে প্রায় ১টি চাকরি এই খাত সংস্থান করে। বৈরুতে এখানে সেখানে ক্রেন দেখা গেলেও প্রকৃত অর্থে নির্মাণ কাজে মন্থরতা নেমে এসেছে। ২০১৮ সালের প্রথমার্ধে ইস্যুকৃত পারমিটের সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ শতাংশ কমেছে। সম্পত্তি কেনাবেচাও আগের বছরের তুলনায় ১৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ডেভেলপার কোম্পানিগুলো আশঙ্কা করছে যে এক গভীরতর মন্দা আসতে যাচ্ছে। বহু বছর যাবত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভর্তুকি হারে বন্ধকী ঋণ দিয়ে আসছিল। সুদের হার ছিল ৩ শতাংশ। মার্চ মাসে হঠাৎ করে সেই স্কিমও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কেউ কেউ বাড়ি না কিনে বেশি অঙ্কের সুদ মেলে এমন সঞ্চয়ী হিসেবে টাকা রাখছে। অর্থনীতিকে সামাল দিতে লেবাননকে রীতিমতো বেগ পেতে হচ্ছে। প্রতিবেশী সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরুর আগেদ ২০১০ সালে দেশটির বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৮ শতাংশ। কিন্তু সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে লেবাননের ওই প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ২ শতাংশেরও কমে নেমে এসেছে। আবাসন খাতে মন্থরতা এই প্রবৃদ্ধির হারকে আরও নিচে নামিয়ে আনবে। মন্দার ভাব ইতোমধ্যে দেখা দিয়েছে ইলেক্ট্র্রনিক্সের বাজারে। বেশ ভাল ডিসকাউন্ট দেয়া সত্ত্বেও বৈরুতের ইলেক্ট্রনিক্সের দোকানগুলো খালিই থাকছে। দোকান চালাতে না পেরে অনেক দোকান কর্মচারীকে ছাঁটাই করা বা বেতন কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। এক ব্যবসায়ীর মন্তব্য : ‘চল্লিশ বছরের মধ্যে এত খারাপ অবস্থা আর হয়নি। সবকিছু স্থবির হয়ে পড়ছে। অন্তত পক্ষে কাগজপত্রে ব্যাংকিং খাতের চেহারা সাবলীল মনে হয়। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে আমানতের পরিমাণ ২০ হাজার কোটি ডলার যা জর্দানের তুলনায় ৪ গুণ বেশি। স্বর্ণ বাদে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদের পরিমাণ ৪৪০০ কোটি ডলার যা দিয়ে দেশটির দু’বছরেরও বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো যায়। ব্যাংকের গবর্নর বলেন সবকিছুই চমৎকারভাবে চলছে। কিন্তু এই পরিসংখ্যানগুলো বেশ গোলমেলে ও তা থেকে আসল চিত্রটি পাওয়ার উপায় নেই। ব্যাংকগুলোর অবস্থা যদি অত সাবলীলই হবে তা হলে মুদ্রার অবমূল্যায়নের আশঙ্কা থাকত না। সেই আশঙ্কা থেকে ব্যাংকগুলো বৈদেশিক মুদ্রা আকৃষ্ট করতে উত্তরোত্তর মরিয়া হয়ে উঠেছে। স্বল্প মেয়াদী আমানতের জন্যও সুদের হার এমন বাড়ানো হয়েছে যা প্রায় এক দশকের মধ্যে এত হয়নি। সুদের হার বেশি হওয়ায় ছোট ছোট ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ঋণ নিতে পারছে না। এক দশক আগে লেবাননের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণদান বছরে ১৫-২০ শতাংশ হারে বাড়ত। এ বছর তা সঙ্কুচিত হয়েছে। মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটলে বিপুল আমদানিকারক একটি দেশের জন্য খুবই বেদনাদায়ক হবে। সোজা কথায় লেবাননের অর্থনীতির সামনে এখন দুর্যোগের ঘনঘটা। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×