ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ০৭:৩২, ৯ নভেম্বর ২০১৮

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

পর্ব-২১ মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণের পথে পথ হাঁটতে শুরু করেছি এক বছর পেরিয়ে গেল। এখনও অপরাহ্ণে পৌঁছতে পারলাম না। অথচ গ্রন্থটির প্রতি সুবিচার করা হতো গোধূলি দিয়ে শেষ করতে পারলে। কিন্তু কোথাও তো যতি টানতে হবেই। তাই অচিরেই শেষ অধ্যায়ের সূচনা করতে চাই। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অধ্যায়টি কেটেছে নাটক নিয়ে, নাটকেরই মাঝে। সেই যে ’৭২-এ শুরু করেছিলাম আজ অবধি তা চলছে। কিন্তু এটি যে আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেই কথাটি বলা হয়ত সঠিক হবে না। আসলে নিয়মিতভাবে কোন কার্যক্রম শুরু করলে সেটা প্রায় অবধারিতভাবেই চালিয়ে যেতে হয় আমাদের এই দেশে। ইচ্ছা করলেই নতুন ভাবে নতুন কিছু শুরু করা হয়ে ওঠে না। এর অন্তরায় অনেকগুলো। প্রথমত, আমাদের এখানে নতুন কোন কাজ করা খুব সহজ নয়। দ্বিতীয়ত, সব মানুষ সমান ইচ্ছে এবং প্রাণশক্তির দ্বারা চালিত নয়, যাতে করে সহজেই নতুন নতুন কাজে ব্রতী হওয়া যায়। অতএব, চাই আর না চাই, সেই পুরনো পথেই পথ চলতে হয় ক্রমাগত। ছিচল্লিশ বছর ধরে চলেছি মঞ্চের ওপরে। কখনও অভিনেতা হিসেবে। কখনও নির্দেশক। কখনও কেবলই দর্শক অথবা সাধারণ কর্মী হিসেবে। আজ এই এত বছর পরে এসে মনে হয় চলেছি তো বটে কিন্তু কী এমন আহামরি কিছু করতে পেরেছি নাটকের অঙ্গনে? অথচ কত অল্পেই কত বড় বড় স্বীকৃতি এসেছে জীবনে। গত পর্বে বোধহয় এই ধরনের কিছু অপূর্ণতার কথা উল্লেখ করেছিলাম। ঠিক সরাসরি নয়, আভাসে ইঙ্গিতে। এই ধরনের চিন্তা-ভাবনা দীর্ঘ পথ চলার ক্লান্তিতে সকলেরই মনে আসে বলে মনে হয়। আমরা এমন একটি প্রজন্মের মানুষ, এই বাংলাদেশে, যে ইতিবাচক কোন কিছু নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলে খুব সহজেই স্বীকৃতি পাওয়া যায়। আমি মনে করি, এই সাড়ে চার দশক পেরুনো বাংলাদেশের এখনও কৈশোর ঘোচেনি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে আমাদের জাতিসত্তা বিষয়ে সকলেরই বেশ ঝাপসা ধারণা। আমরা এই বিষয়টি নিয়ে এখনও ক্রমাগত বচসা করে যাচ্ছি। অথচ সেই ’৭১-এ যখন যুদ্ধে গিয়েছিলাম তখন এ সম্বন্ধে কোন সন্দেহ ছিল না যে আমরা সংস্কৃতিগত দিক দিয়ে প্রথমেই বাঙালী। তারপর সন্নিবেশিত হয়েছে আমাদের যার যার ধর্ম। আমি বছর কয়েক আগে কুমিল্লার কাছে কসবা এলাকায় একটি গণকবর দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে শায়িত আছেন ৪০ কি তারও বেশি মুক্তিযোদ্ধা। এরা পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন ওই গ্রামেরই কাছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে। সেই গ্রামেরই এক দম্পতি এই শহীদদের মৃতদেহ এক এক করে নিয়ে এসে ওই ছোট্ট টিলাটির ওপরে সমাহিত করেন। প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু পরিচয় দেয়া ছিল সমাধি সংলগ্ন ফলকগুলোতে। আমি অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করেছিলাম যে সেখানে শুয়ে আছেন বাঙালী হিন্দু, বাঙালী বৌদ্ধ, বাঙালী খ্রীস্টান এবং বাঙালী মুসলমান। একটি মহৎ এবং পবিত্র কর্তব্য পালন করতে গিয়ে তারা এক দেহে লীন হয়েছিলেন। তা হলে আজ কেন, এই সাড়ে চার দশক বাদে আমরা আমাদের ধর্মসত্তা নিয়ে এত বিচলিত হই? আবারও নজরুলকে মনে পড়ে, ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কা-ারী বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র।’ আমরা পাকিস্তান ভেঙেছিলাম একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের ধর্মান্ধতা থেকে বেরিয়ে আসবার জন্য। আবার সময়ের আবর্তে, ঘুরে ফিরে সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে পুনর্প্রবেশ করছি কি আমরা? তাহলে ’৭১-এ এতগুলো মানুষের আত্মাহুতি দেয়ার কী প্রয়োজন ছিল? ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদেও শেখায় আরও বেশি বিনীত হতে এবং সকল ধর্মের প্রতি সমানভাবে শ্রদ্ধাশীল হতে। সেটাকে আবার আমরা যদি উগ্রতার দিকে নিয়ে যাই তাহলে আমাদের ভবিষ্যত আবারও অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। এখানে এসে কতগুলো মৌলিক প্রশ্ন জাগে মনে, সঙ্গত কারণেই। যে জাতি দুই যুগ ধরে সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানের অধীনে বাস করেছে এবং সব অপপ্রচার সত্ত্বেও ধার্মিক উগ্রতাকে প্রত্যাখ্যান করেছে সে জাতি আবার কি করে ওই অন্ধকারে প্রবেশ করে? আজকের অনেক তরুণ ধর্মীয় উগ্রবাদের দিকে ধাবিত। এখানেই এই বাঙালী শহর ঢাকায়, আমরা প্রত্যক্ষ করি রক্তাক্ত হলি আর্টিজেন। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস এই উগ্র সাম্প্রদায়িকতা কেবল একটি রেস্টুরেন্টে সীমাবদ্ধ নয়। এটি ছড়িয়ে আছে সমাজের বিভিন্ন জায়গায়। ভয়াবহ হলো যে এটির চক্রান্তের সবচেয়ে বড় স্বীকার হয়েছে আমাদের তরুণ সমাজ। কী করে সেটা সম্ভব হলো? এই তরুণেরা আমাদেরই সন্তান। আর এই আমরাই ভাষার জন্য যুদ্ধ করেছি, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছি। তাহলে আমাদের সন্তানেরা বিপথগামী হলো কেন? এই প্রশ্নের একটিই জবাব হতে পারে যে আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছিলাম। যে পথে আমরা একটি দেশ এবং সমাজের স্বকীয়তা, স্বভাষা, নিজস্ব সংস্কৃতি এবং স্বাধীনতা এনেছি সেই পথটি থেকে, ইচ্ছেয় হোক কিংবা অনিচ্ছায়, আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম। আমার তো মনে হয় আমরা যদি আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াই তবে আমাদের সেই ’৫০ কি ’৭০ দশকের বিপ্লবী, প্রগতিশীল চেহারাটা কোথাও খুঁজে পাব না। আমাদের এই চরিত্র ভ্রষ্টতা এক চরম বিপদের সামনে নিয়ে যাবে আমাদের যখন সকল মূল্যবোধ এবং আদর্শ ধুলায় লুন্ঠিত হবে। আর কখনও হয়ত আমরা স্বাধীন, সার্বভৌম, অসাম্প্রদায়িক জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব না। এ কথাটি আজকের সব অভিভাবককে অচিরেই অনুধাবন করতে হবে এবং সঠিক পথে পথ চলা শুরু করতে হবে। এখনও সময় আছে, এখনও আমরা নিজেদের শুদ্ধ বাঙালী হিসেবে দাঁড় করাতে পারি যাতে করে আমরা একটি আদর্শ উদাহরণ হিসেবে মূল্যায়িত হতে পারি। অর্থাৎ আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সামনের দিকের পথ দেখাব। সেই আদর্শের পথ, যার জন্য একেবারে কৈশোর থেকে অনবনতচিত্তে যুদ্ধ করে গেছি আমরা। যাকে বলে খবধফ নু ঊীধসঢ়ষব। আর যদি আমরা প্রচলিত ধারায় এখনও সেই গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে চলি তাহলে এটাই প্রমাণিত হবে যে একেবারে জাগতিক এবং বস্তুগত সুখের জন্যই আমরা লালায়িত। হয়ত আন্দোলন করেছিলাম, যুদ্ধ করেছি এক উত্তেজনার বশে কিন্তু পশ্চাদগামী, প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাধারা থেকে সত্যিকারের প্রগতির পথে পথ চলার কথা কখনই ভেবে দেখিনি। আচার-আচরণে এই ক্রমবর্ধমান সঙ্কীর্ণতা কেবল যে ধর্মের মধ্যেই নিহিত তা নয়, জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই এই বিষয়টি স্পষ্ট দৃশ্যমান। এই বিষয়ে কিছু বলতে গেলে আমাদের একটু পেছন ফিরে তাকাতে হয়। পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা সাধারণত কৃষি কাজেই নিয়োজিত ছিল ঐতিহাসিকভাবে অথবা বলা যেতে পারে যে আমাদের দরিদ্র কৃষকেরা সনাতনধর্মী জমিদারদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়েই ইসলাম ধর্মের দৃশ্যমান উদারতার কাছে নিজেদের সমর্পণ করে। সেই সময় যারা এই ধর্মান্তরের কাজটি করতেন তারা আমাদের সাধারণ মানুষকে বোঝাতে পেরেছিলেন যে ইসলামে সত্যিকার অর্থে কোন শ্রেণী বিভাজন নেই। তারপর থেকে আমাদের দেশের মুসলমানেরা সংখ্যা গরিষ্ঠ হিসেবে এক ধরনের স্বীকৃতি পায় আমাদের এই সমাজে। কিন্তু তখন মুসলমানদের মধ্যেই একটি শ্রেণী বিভাজিত সমাজ গড়ে ওঠে। হিন্দু জমিদাররা অবিভক্ত বাংলায় ক্রমশই কলকাতামুখী হয়ে পড়েন। পূর্ববঙ্গে শাসন-শোষণের ভার চলে যায় নব্য মুসলমান জমিদারদের হাতে। সেই সময় থেকেই নানা ভাবে প্রগতিশীলতা, তরুণদের হাত ধরে এই সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। এই সময় বোধকরি, সেই বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই কৌতুক করে বলা হতো হিন্দু কমিউনিস্ট অথবা মুসলমান কমিউনিস্ট। অর্থাৎ উভয় সম্প্রদায় থেকেই কিছু শিক্ষিত মানুষ প্রগতিশীলতার দিকে ঝুঁকে পড়ে। এই প্রগতিশীলরাই পরবর্তীতে সাধারণ মানুষের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হন এই সমাজে। একটু বিশ্লেষণ করলেই আমরা দেখতে পাই যে যাদের তখন প্রগতিশীল বলে চিহ্নিত করা হয়েছে তারা সবাই পরবর্তীতে প্রতিচ্যয় গণতান্ত্রিক ধারায় রাজনীতি করেছে আমাদের দেশে। সত্যিকার অর্থে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, রাশিয়ায় বলশেভিকদের পরে চীন এবং পূর্ব ভারতে কিছু জায়গা ছাড়া আর খুব কম জায়গাতেই দেখা যায়। যাকগে, ধান ভানতে শীবের গীত হয়ে যাচ্ছে। আমি যে কথাটি বলবার চেষ্টা করছিলাম এতক্ষণ তা হলো এই প্রগতিশীল মানুষগুলোই পরবর্তীতে আমাদের সংস্কৃতির নিয়ন্তা হিসেবে আবির্ভূত হন এবং নেতৃত্ব প্রদান করেন। বাল্যকালের একটি স্মৃতি আমার মনে সুখানভিূতি নিয়ে আসে এখনও। গে-ারিয়াতে আমাদের বাড়ির ঠিক উল্টো দিকে তৎকালীন প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী শ্রী ডিএন বারোরী মহাশয়ের বাড়ির সামনের অঙ্গনে বামপন্থী যুবকদের এক অনুষ্ঠান হয়েছিল রাতভর। সেইখানে একটি গান মাঝে মধ্যেই গাওয়া হচ্ছিল : ‘নও জোয়ান, নও জোয়ান, বিশ্বে জাগিছে নও জোয়ান। কোটি প্রাণ, শত প্রাণ, একই শপথে বলীয়ান।’ হয়ত আমার এই উদ্ধৃতিতে শব্দভ্রান্তি থাকতে পারে কিন্তু তা সত্ত্বেও এই গানটির সুর আমার মনে আশা-আনন্দের দোলা দিয়ে যায় এখন, তখন। আমরা দেখি যে সব প্রগতিশীল বাঙালী ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের হয়ে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে এক বিরাট শক্তিশালী মোর্চা গঠন করে। ১৯৪৭ সালের আগস্টে একেবারেই ধর্মীয় চিন্তাধারার ফসল হিসেবে যে দেশের সৃষ্টি, সেই দেশে ৬-৭ বছরের মধ্যে এমন অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনের উদ্ভব কল্পনা করাও ছিল শক্ত। (চলবে)
×