ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কবীর চৌধুরী তন্ময়

অভিমত ॥ সংলাপ ॥ ব্যক্তিস্বার্থের রাজনীতি

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ১১ নভেম্বর ২০১৮

অভিমত ॥ সংলাপ ॥ ব্যক্তিস্বার্থের রাজনীতি

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তফ্রন্ট থেকে মতানৈক্যের মাঝে জন্ম নেয়া ঐক্যফ্রন্ট বা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের রাজনীতি কার জন্য- এটি একটি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, ওইসব হেভিওয়েট রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কথায় কথায় বলে, দেশের মালিক জনগণ। তাহলে সহজ-সরল ভাষায় বলতে হয়, ‘জনাব, দয়া করে এই জনগণকেই ভাবতে দিন। এসব নেতাদের রাজনীতি কখনও দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য ছিল বা আদৌ আছে বলে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। আর তাদের বর্তমান কর্মকা-ও আমার বিশ্বাসকে আরও মজবুত করতে সহায়তা করেছে। এখানে দেশের মানুষের নয়, রাজনৈতিক প্লাটফর্ম ব্যবহার করে ব্যক্তিস্বার্থই ওইসব তথাকথিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের মূল উদ্দেশ্য দেখতে পাচ্ছি। আওয়ামী লীগের পরে বড় দল হিসেবে বিবেচনা করে বিএনপিকে। দেশজুড়ে বিএনপির নেতাকর্মী আছে। নির্দিষ্ট ভোট আছে। তাই একদলের এক-নেতাগুলো বিএনপির উপর ভর করেছে। শুধু তাই নয়, একটা সময় যারা বিএনপি ও খালেদা জিয়াকে নিয়ে ব্যঙ্গ করত; আজ তারাও খালেদা জিয়ার জন্য জীবন দেবে- এই ধরনের গলা ফাটানো বক্তব্য দিয়ে থাকে। এমনকি বিচার বিভাগকে অসম্মান করে, জনগণের রক্ত বন্যা বইয়ে দিয়ে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করবেন বলেও ‘ইনশাআল্লাহ’ বলেছে। আবার বিএনপিও এসব জনবিচ্ছিন্ন এক দলের এক- নেতাখ্যাত ব্যক্তিদের নিজেদের দলে টেনে এনেছেন। কারণ, বিএনপির রাজনৈতিক নেতৃত্বশূন্য চলছে। বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এতিমের টাকা চুরি করার অভিযোগে আদালত কর্তৃক সাজায় কারাগারে আছেন। অন্যদিকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও টাকা পাচারের অভিযোগে আদালতের সাজা মাথায় নিয়ে বিদেশ পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ডক্টর কামাল হোসেন নিজ স্বার্থের কারণে উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ থেকে কীভাবে বের হয়েছে, কীভাবে মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান মনসুর, আসম রবরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে বেইমানি করেছে- এটিও বিএনপির পর্যবেক্ষণে আছে। তাই বিএনপি খালেদা-তারেক জিয়ার নেতৃত্বশূন্যে এসব নেতাদের ব্যবহারের ছক এঁকেছে। কারণ বিএনপি নিজেও জানে, ওইসব নেতাদের ভোট না থাকলেও জোট আছে। আবার তাদের বড় বড় কথা বড় বড় মিডিয়ায় প্রথম পাতায় ছাপানো হয়। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, জামায়াত ইসলামকে তারা প্রকাশ্যে প্রত্যাখ্যান করেনি। জামায়াত-শিবিরমুক্ত জোট করার কথায় যুক্তফ্রন্ট থেকে বের হয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছে। জামায়াতকে পর্দার আড়ালে রেখেই ঐক্যফ্রন্টের কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে। আর জামায়াতের প্রতিনিধি (অপ্রকাশিত বা অস্বীকৃত) ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন নারীর উপর কলঙ্ক লাগিয়ে নিজেই এখন কলঙ্কিত হয়ে কারাগারে। ভেতরে ভেতরে জামায়াতের কোন কোন নেতাকে কোন কোন আসন থেকে বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচিত করবে- এটির হিসেব নিকেশ চলছে। দশম সংসদ নির্বাচনও হয়েছে সংবিধান অনুযায়ী। একাদশ সংসদ নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হবে একই ধারাবাহিকতায়। এটা নবম সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই আলোচিত হয়ে আসছে। তাহলে নতুন করে এই পদ্ধতি বা কলঙ্কিত তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির মতো অনির্বাচিত মানুষদের উপদেষ্টা করে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনে এসব নেতারা মূলত কী এজেন্ডা বাস্তবায়নের ষড়যন্ত্রে নেমেছে? যুক্ত-ঐক্যফ্রন্টের নেতারা শুরু থেকেই বলে আসছে সরকারের সঙ্গে সংলাপ করতে চায়। কখনও পাঁচ দফা আবার কখনও সাত দফা দাবি দাওয়া নিয়ে বিস্তর আলোচনার চিঠিও দিয়েছে। এই নেতাগুলো বিগত পাঁচ বছর ধরে শেখ হাসিনা অবৈধ সরকার, শেখ হাসিনা ভোটারবিহীন সরকার ইত্যাদি বলে সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। শুধু তাই নয়, যে ডক্টর কামাল হোসেন সংবিধান প্রণেতার অন্যতম সদস্য তিনিও সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকে, নির্বাচিত সরকারকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছে। প্রকৃতির কী নির্মম জবাব, এই শেখ হাসিনার সঙ্গেই সংলাপ করেছে, আবারও সংলাপ করতে রীতিমতো মরিয়া হয়ে উঠেছে এসব মিথ্যাচার করা রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ! শেখ হাসিনা শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা নন, তিনি মানবতার ফেরিওয়ালা। মানুষ, মানবতাবোধ আর মানবকল্যাণকর নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা আর কর্মকা- দিয়ে তিনি বিশ্বের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাই বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার বাড়ির গেট থেকে দেশের শুধু একজন প্রধানমন্ত্রীই নয়, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে অপমান-অপদস্থ করে ফিরিয়ে দিলেও শেখ হাসিনা ঠিকই ফিরিয়ে দেননি। তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সবার কথা শোনেছেন এবং সংবিধানের মধ্যে থেকে যা যা করণীয় সবই করার আশ্বাস দিয়েছেন। শেখ হাসিনার মতো ব্যক্তিরাই ইতিহাস রচনা করেন। তাই শুধু আমন্ত্রণ জানিয়েই বসে থাকেনি, বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই আলোচনা শুরু করেন। মন খুলে কথা বলা, প্রাণ খুলে হাসি আর প্রাণবন্তর রাজনৈতিক সংলাপ নতুন ইতিহাসের পাতা সৃষ্টি করেছে। আসলে কতিপয় নেতারা যে ব্যক্তিস্বার্থের কারণে ঐক্যফ্রন্ট নামক জোট করেছে- এটি তাদের কর্মকা-ের মাধ্যমেই প্রকাশিত। এসব নেতারা ভেবেছে, সংলাপ শুধু তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবে। কিন্তু তারা ভুলে গেছে, শেখ হাসিনা ছাত্রলীগ থেকেই কখনও ব্যক্তিস্বার্থে রাজনীতি করেনি। এমনকি বঙ্গবন্ধ্ওু নয়। এই দীক্ষায় শেখ হাসিনা সব মতের, সব দলের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে, সবার কথা শোনেছে। আর এই কারণেই কোন কোন ঐক্যফ্রন্টের নেতা বক্তব্য দিয়ে বলেছে, সংলাপকে গুরুত্বহীন করে তুলেছে। প্রথমবার, দ্বিতীয়বার সংলাপে ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের মূল এজেন্ডা কী ছিল? জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার কী প্রতিফলন ঘটাতে পেরেছে- এই হিসেব নিকেশ একেবারেই শূন্য। সবাই ছিল ব্যক্তিগত সমস্যা আর অবৈধভাবে ক্ষমতা যাওয়ার ফর্মূলায়। ঐক্যফ্রন্ট নেতারা সংলাপে প্রস্তাব করেন, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে এবং ওই সময়ে একজনকে প্রধান উপদেষ্টা করে তার নেতৃত্বে আরও ১০ উপদেষ্টার সমন্বয়ে নির্বাচনকালীন একটি সরকার গঠন করতে হবে। শেখ হাসিনা ডক্টর কামাল হোসেনের কাছে জানতে চান, সংবিধানের কোথাও কি এ ধরনের বিধান আছে? যদি সংবিধান পরিপন্থী এ ধরনের সরকার গঠন করা হয় এবং তাদের অধীনে নির্বাচন হয়, এরপর কেউ যদি উচ্চ আদালতে রিট করে এবং আদালত যদি ওই সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করে তখন কী হবে? শেখ হাসিনার এই প্রশ্নে উত্তর শুধু ঐক্যফ্রন্টের নেতারাই নয়, সংবিধান প্রণেতার অন্যতম সদস্য ডক্টর কামাল হোসেনও কিছু বলতে পারেনি। দ্বিতীয় দাবি ছিল, নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার। সংবিধানের ১২৩ (খ) প্রয়োগ করে, সংসদ ভাঙ্গার ৯০ দিন পর নির্বাচনের দাবি উত্থাপন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রসঙ্গে আবারও ডক্টর কামাল হোসেনের কাছে জানতে চান, সংসদের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। সংসদ এখন নিষ্ক্রিয়। এখন সাংবিধানিক কোন বিধানে সংসদ ভাঙ্গা যায়?’ শেখ হাসিনার এই প্রশ্নের উত্তরও ডক্টর কামালসহ ঐক্যফ্রন্টের কোন নেতা দিতে পারেনি। তৃতীয় দাবি ছিল শেখ হাসিনাই প্রধানমন্ত্রী থাকবে। কিন্তু ১০ সদস্যের একটি উপদেষ্টাম-লী দেশ চালাবে। প্রধানমন্ত্রী জিজ্ঞেস করেন, এই উপদেষ্টাম-লী কারা ঠিক করবে? উত্তরে ড. কামাল বলেন, আমরা সবাই মিলে ঠিক করব। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ডক্টর কামাল হোসেনের কাছে জানতে চান, আমাদের সংবিধানে কোথায় আছে এ রকম উপদেষ্টাদের দিয়ে দেশ চালানো যায়? সংবিধান প্রণেতা আইনপেশায় বিখ্যাত ডক্টর কামাল হোসেন এবারও শেখ হাসিনার প্রশ্নের কোন জবাবা দিতে পারেননি বরং তিনি রীতিমতো চুপচাপ বসে ছিলেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়, বেগম জিয়াকে যেন নির্বাচনের আগে জামিন দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঐক্যফ্রন্ট প্রধান ডক্টর কামাল হোসেনের কাছে জানতে চান, ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ কি একজনকে আটক ব্যক্তিকে জামিন দিতে পারেন?’ তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘এটা কি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পক্ষে?’ যিনি কথায় কথায় আইনের শাসন চায়, সংবিধান সম্মত গণতন্ত্র ও রাষ্ট্র কাঠামো চায় সেই ডক্টর কামাল হোসেন এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বরং নিশ্চুপ থাকেন। ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে এই সংলাপে জনগণের পক্ষে কোন কথাটি ছিল- এটি আমি ব্যক্তিগতভাবে খুঁজে পাইনি। আর অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে- এটিও এই সংলাপের মধ্য থেকে উঠে এসেছে। সেই সঙ্গে বিএনপির নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের বাড়ি সঙ্কট, ডাক্তার জাফরুল্লাহ হাসাপাতালের জমির সঙ্কট, মাহমুদুর রহমান মান্নার বক্তব্য মিডিয়াতে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে-এই ধরনের আচার-বিচার নিয়েই মূলত সংলাপের ব্যক্তিস্বার্থ এজেন্ড ছিল। ঐক্যফ্রন্টের নেতারা শুধু নিজ ব্যক্তিস্বার্থ আর অবৈধপথে কীভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারে সেই দিকেই তাদের সংলাপ অব্যাহত রেখেছে। আর এইসব ব্যক্তিস্বার্থ রাজনৈতিক ব্যক্তি ও মহলকে দেশের জনগণ অতীতের মতো একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রত্যাখ্যান করবে বলে আমার বিশ্বাস। লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)
×