ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গৃহপরিচারিকা থেকে জাতীয় ফুটবলার

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ১৪ নভেম্বর ২০১৮

গৃহপরিচারিকা থেকে জাতীয় ফুটবলার

মারিয়া মান্দা নামটি এখন শুধু বাংলাদেশের মানুষের কাছে নয়, বিশ্বের অনেকের কাছেই পরিচিত। ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলায় জন্ম নেয়া এই মেয়েটি এখন বাংলাদেশের কৃতী ফুটবলার। কিশোরী এই ফুটবলার বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৫ নারী দলের অধিনায়ক। ফুটবল মাঠে তিনি সেন্টার মিডফিল্ডার হিসাবে খেলেন। নিজে গোল করেন এবং অন্যদের দিয়ে গোল করান। মাঠে কোন পরিস্থিতিতে কী করতে হবে সে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। অধিনায়ক হিসাবে শিরোপা জয়ের খ্যাতি রয়েছে তার। এক কথায় বাংলাদেশের বয়সভিত্তিক দলের প্লেমেকার হিসেবে মাঠে দারুণ পারফর্ম করে নজর কেড়ে চলেছেন দর্শকদের। তার অসাধারণ ড্রিবলিং, নিখুঁত পাস ও দূরপাল্লার শটে গোল করা চোখে পড়ার মতো। দুর্দান্ত নৈপুণ্যের পুরস্কার হিসেবে কোচ তাকে জায়গা করে দিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় দলে। যদিও বয়স কম হওয়ায় আর বড়দের সঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতা না থাকায় জাতীয় দলের জার্সিতে খুব একটা নজর কাড়তে পারেন না। যা বাংলাদেশ জাতীয় দলের অন্য নারী ফুটবলারদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতায় মেয়েরা যেভাবে একের পর এক সাফল্য জাতীয় দলের বেলায় ঠিক উল্টো চিত্র। অর্থাৎ প্রত্যাশিত রেজাল্ট পাচ্ছে না জাতীয় দল। মারিয়া মান্দার জন্ম ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুরে। মারিয়া যখন একেবারে ছোট তখন তার বাবা বীরেন্দ্র মারাক মারা যান। মারিয়া তার বাবার কথা ঠিকঠাক মনে করতে পারেন না। কারণ, তার বাবা যখন মারা গেছেন তখন তার ভালোভাবে বোঝার বয়স হয়নি। বাবার আদর-¯েœহ ছাড়াই বড় হয়েছেন তিনি। মারিয়া মান্ডা এই পর্যন্ত উঠে এসেছেন তার মায়ের প্রচেষ্টায়। মারিয়ারা তিন বোন ও এক ভাই। টানাটানির এই সংসার থেকে মারিয়ার ফুটবলার হয়ে ওঠা মোটেও সহজ ছিল না। কিন্তু তার অদম্য চেষ্টা ও তার মায়ের সহযোগিতায় সফলতার মুখ দেখেছেন তিনি। ফুটবলার হওয়ার আগে মা এনাতো মান্দার সঙ্গে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে গৃহ-পরিচারিকার কাজ করতেন মারিয়া। মারিয়ার মা বিভিন্ন সময় রাস্তায় মাটি কাটার কাজও করেছেন। রাস্তায় মাটি কেটে মারিয়ার জন্য খেলার বুট কিনে দিয়েছেন। সেই বুট পায়ে দিয়ে খেলেই মারিয়া ফুটবলার হয়ে উঠেছেন। মারিয়া ফুটবল খেলা শুরু করেন ২০১১ সালে। ময়মনসিংহের নামকরা কলসিন্দুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হয়ে তিনি বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশ নেন। প্রথমে স্কুলের শিক্ষকরা তাকে খেলার জন্য আগ্রহী করে তোলেন। তার মধ্যে প্রতিভা দেখতে পেরে শিক্ষকরা তাকে দলে ডেকে নেন। এরপর নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে জাতীয় পর্যায়ে উঠে আসেন তিনি। অবশ্য মারিয়া যখন প্রথমে ফুটবল খেলা শুরু করেন তখন খালি পায়ে খেলতেন। পরে আস্তে আস্তে বুটের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। ২০১৩ সালে বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টে কলসিন্দুর চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। মারিয়া ওই দলের সদস্য ছিলেন। ওই টুর্নামেন্টে ভালো করায় পরবর্তীতে তিনি জাতীয় পর্যায়ে সুযোগ পেয়ে যান। এরপর তার আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ক্রমেই তার উন্নতির গ্রাফ উপরের দিকে উঠছে। এখন তিনি দরিদ্র পরিবারের হাল ধরেছেন। তাদের পরিবারে সচ্ছলতা ফিরেছে। যে মা আগে বাড়ি বাড়ি গৃহ-পরিচারিকার কাজ করে, রাস্তায় মাটি কেটে পরিবারের সকল সদস্যের খরচ যোগাতেন, মারিয়ার খেলার সামগ্রী কিনে দিতেন এখন সেই মায়ের হাতে টাকা তুলে দেন মারিয়া মা-া। এই ফুটবল খেলার সুবাদেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একাধিকবার সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছেন মারিয়া। তিনি বেশ কয়েকটি দেশে ঘুরেছেন। এতটুকু বয়সে ফুটবল তাকে অনেক কিছু এনে দিয়েছে। এই ফুটবল না খেললে হয়তো তিনি অজোপাড়াগাঁয়ের অন্য আরেকটি সাধারণ মেয়ের মতোই আড়ালে পড়ে থাকতে তিনি। গণমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মারিয়া মা-া বলেছেন, ‘আমার বয়স যখন তিন-চার বছর তখন আমরা বাবা মারা গেছেন। তারপর থেকে মা একাই আমাদের পরিবার সামলে আসছেন। রাস্তায় মাটি কাটার কাজ করে মা আমাদের সংসার চালিয়েছেন। অভাব-অনটনের মধ্যেও আমার খেলার অনেক সামগ্রী মা কিনে দিয়েছেন। মায়ের উৎসাহ বা আগ্রহ না থাকলে হয়তো আমি ফুটবলার হতে পারতাম না। মায়ের আশির্বাদে এভাবেই আমি উঠে এসেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘২০১১ সাল থেকে বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টের মাধ্যমে আমার ফুটবল খেলা শুরু। স্কুল ছুটি হলেই স্যারেরা অনুশীলন করাতেন। স্যাররা বলতেন, আমরা যেভাবে শেখাব তোমরা যদি সেখাবে খেল তাহলে ভালো খেলা শিখতে পারবা, ভবিষ্যতে বড় খেলোয়াড় হতে পারবা। ২০১১ সালে ও ২০১২ সালে বঙ্গমাতা টুর্নামেন্টে আমরা হেরে গেছি। ২০১৩ সালে আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) অনেকেই আমাদের খেলা দেখেছেন। সেখান থেকে আমার খেলা তাদের ভালো লেগেছিল। এজন্যই তারা আমাকে দলে ডাকেন।’ আন্তর্জাতিক ফুটবলে মারিয়া মান্ডার পছন্দ দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল জায়ান্ট ও দুইবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা। কারণ এই এই দলের খেলা ভাল লাগে তার। আর খেলোয়াড় হিসেবে তার পছন্দ বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা দুই ফুটবল সুপারস্টার লিওনেল মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো। সুযোগ পেলে প্রায়ই তাদের খেলা দেখেন মারিয়া। বিশ্ব তারকাদের খেলা দেখে নিজের মধ্যে আরও শক্তি ও সাহস সঞ্চার করেন তিনি। বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবল খেলা হলে এখন মাঠে প্রচুর দর্শক হয়। এমনকি বাংলাদেশের মেয়েরা বিদেশের মাটিতে খেলতে গেলেও সেখানে আমরা বাংলাদেশের অনেক দর্শক দেখতে পায়। মাঠে খেলোয়াড়রা যখন ভাল করেন তখন গ্যালারি থেকে দর্শকরা খেলোয়াড়দের উৎসাহ দেন। অনেকে গ্যালারি থেকে খেলোয়াড়দের নাম ধরে ডাকেন, অভিনন্দন জানান। এসব উপভোগ করেন মারিয়া মান্ডা। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়েছিল সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম আসর। এই আসরে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এই চ্যাম্পিয়ন দলের অধিনায়ক ছিলেন মারিয়া মান্ডা। টুর্নামেন্টের ফাইনাল ম্যাচে ভারতকে ১-০ গোলে হারিয়েছিল বাংলাদেশের মেয়েরা। বর্তমান সময়ে বয়সভিত্তিক ফুটবলে একের পর এক সাফল্য বয়ে আনছে বাংলাদেশের মেয়েরা। দলের জয়ে বড় ভূমিকা রাখছেন মারিয়া মান্দা, তহুরা, আঁখি খাতুন, আনাই মোগিনি, আনুচিং মোগিনিরা। ময়মনসিংহের কলসিন্দুর থেকে প্রায় ১০-১১ জন মেয়ে ফুটবলার বয়সভিত্তিক দলে প্রতিনিধিত্ব করছে। মারিয়া মান্ডা চান, ভবিষ্যতেও তাদের গ্রাম ও এলাকা থেকে আরও মেয়ে ফুটবলার বের আসুক। অন্য মেয়েরাও ফুটবলের প্রতি আগ্রহী হোক। এজন্য তিনি মেয়েদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। পাশাপাশি তাদের দরিদ্র এলাকার উন্নয়নে সরকার যেন আরও উদ্যোগ নেয় সেটিও তিনি প্রত্যাশা করেন। মারিয়া মান্ডারা যখন প্রথমে ফুটবল খেলা শুরু করেন তখন আশপাশের অনেক মানুষ তাদের নিয়ে কটূক্তি করেছে। অনেকেই বলেছেন, ফুটবল তো শুধু ছেলেরা খেলে, এটা তো মেয়েদের খেলা না। কিন্তু মারিয়া মান্ডারা থেমে যাননি। স্কুলের শিক্ষকের নেতৃত্বে তাারা অনুশীলন ও খেলা চালিয়ে গেছেন। কিন্তু প্রথমে যারা মারিয়াদের খেলা নিয়ে কটূক্তি করত এক পর্যায়ে তারাই মারিয়াদের প্রশংসা করা শুরু করেন। এর পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে দেশে-বিদেশে মারিয়াদের ধারাবাহিক সাফল্য। সম্প্রতি ভুটানে অনুষ্ঠিত সাফ অনুর্ধ-১৮ উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জয় করে বাংলাদেশ। এই টুর্নামেন্টে মোট চারটি ম্যাচ খেলে বাংলাদেশের মেয়েরা ২৪টি গোল করে ও মাত্র একটি গোল হজম করে। টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্বে পাকিস্তানকে ১৭-০ গোলে হারানোর পর নেপালকে ২-১ গোলে হারায় বাংলাদেশ। এরপর সেমিফাইনাল ম্যাচে ভুটানকে ৪-০ গোলে ও ফাইনালে নেপালকে ১-০ গোলে হারায় বাংলাদেশের মেয়েরা। এই টুর্নামেন্টে তহুরা খাতুন একটি গোল করলেও তিনি খেলেন দুর্দান্ত। গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালের এএফসি অনুর্ধ-১৬ উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বের ‘এফ’ গ্রুপের খেলা। গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশ অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়। এই টুর্নামেন্টে বাহরাইনকে ১০-০ গোলে, লেবাননকে ৮-০ গোলে, সংযুক্ত আরব আমিরাতকে ৭-০ গোলে ও ভিয়েতনামকে ২-০ গোলে হারায় বাংলাদেশের মেয়েরা। গত আগস্টে ভুটানে অনুষ্ঠিত হয় সাফ অনুর্ধ-১৫ উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপের আসর। এই আসরে বাংলাদেশ রানার আপ হয়। এই দলের অধিনায়কের দায়িত্বে ছিলেন মারিয়া মান্ডা। এই টুর্নামেন্টে ফাইনাল ম্যাচ ছাড়া অন্য কোন ম্যাচে হারেনি বাংলাদেশ। টুর্নামেন্টে গ্রুপ পর্বে পাকিস্তানকে ১৪-০ গোলে ও নেপালকে ৩-০ গোলে হারায় বাংলাদেশের মেয়েরা। তারপর সেমিফাইনালে ভুটনাকে বাংলাদেশ হারায় ৫-০ গোলে। কিন্তু ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে ০-১ গোলে রানার আপ হয় বাংলাদেশ। গত এপ্রিলে হংকংয়ে অনুষ্ঠিত জকি সিজিআই ইয়ুথ ফুটবল টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়। চার দেশ নিয়ে আয়োজিত এই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের তহুরা খাতুন আটটি গোল করেছিলেন। এর মধ্যে দুই ম্যাচে তিনি হ্যাটট্রিক করেছিলেন। আর এক ম্যাচে দুটি গোল করেছিলেন। এই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ মোট ২৪টি গোল করেছিল।
×