ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইউরোপে চীনের বিনিয়োগ বাড়ছে প্রভাবও বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৬:৫৩, ১৪ নভেম্বর ২০১৮

ইউরোপে চীনের বিনিয়োগ বাড়ছে প্রভাবও বাড়ছে

ইউরোপে চীনের বিনিয়োগ ও প্রভাব বাড়ছে। ২০১৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে চীনের চীনের বিনিয়োগ আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে ৪ হাজার কোটি, ডলারে দাঁড়িয়েছে। এই অর্থের সিংহভাগই রাষ্ট্রীয় সমর্থনপুষ্ট এবং চীনের উত্থাপনের রাশ টেনে ধরতে আমেরিকাকে সাহায্য করা থেকে ইউরোপকে বিরত রাখার লক্ষ্যে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির স্ট্যাটেজির অংশ। ২০১৬ সালের আগ পর্যন্ত ইউরোপীয় এবং বিশেষ করে জার্মান নেতারা চীনের বিনিয়োগকে বহুলাংশেই স্বাগত জানিয়েছিল। এ নিয়ে খুব বেশি চিন্তাভাবনা করেনি। তবে বিনিয়োগের আকারে বিপুল অর্থের আগমনের ফলে বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ছোট ছোট দেশগুলোতে চীনের প্রভাব প্রতিপত্তি বেড়ে যাওয়ায় বার্লিন, ব্রাসেলস ও অন্যান্য দেশের নেতারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। তখন থেকে তারা চীনের বিনিয়োগ খতিয়ে দেখার কাজটা কড়াকড়ি করেছেন এবং এ বিষযটিকে মোকাবেলায় আরও ঐক্যবদ্ধ ইউরোপীয় পদক্ষেপ গ্রহণের চেষ্টা করছে। তারপরও চীনের নগদ অর্থ যে হারে আসছে, তার সঙ্গে ওই উদ্যোগ তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। ইউরোপে চীনের কুশীলবরা সাধারণত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সমর্থনপুষ্ট ফার্ম ও বিনিযোগ তহবিল। ২০১৮ সাল পর্যন্ত একদশকে চীনের ক্ষমতায় বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল এ সংক্রান্ত চুক্তিসমূহের ৬৩ শতাংশ। এই বিনিয়োগ প্রধানত করা হয়েছে জ্বালানি, রাসায়নিক ও অবকাঠামো খাতে। চীনের কোম্পানিগুলো সুইজারল্যান্ডের বৃহৎ কীটনাশক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিনাজনটা, গ্রীসের বৃহত্তম বন্দর পোর্ট আসন পিরাইডস এবং ব্রিটেনের পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র হিংকলে পয়েন্ট সি-এর সিংহভাগ বা সমুদয় অংশের মালিক। লন্ডনের হিথরো ফ্রাঙ্কফুটের হ্যান ও টুলোসের মতো বিমানবন্দরের ওপরও চীনের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মালিকানা রয়েছে। তেমনি পরিমাণ মালিকানা আছে ইতালির পাঁজিও ও স্ট্রিনগাড়ির নির্মাতা পিএসএ গ্রুপে এবং ইতালির টায়ার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান পিরেল্লিতে। চীনের বিনিয়োগের মান্য একটা আঞ্চলিক ধারা আছে। পূর্ব ইউরোপে মূল দৃষ্টিটা দেয়া হয়েছে সেইসব অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর যার মাধ্যমে পুরাতন মহাদেশ এবং পূর্বদিকে বেল্ট এ্যান্ড বোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) তথা সিল্কবোর্ড প্রকল্পগুলোর মধ্যে সংযোগ সুসংহত হতে পারে। ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চলে ইউরো জোন সঙ্কটের সময় প্রচুর শিল্প প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। চীনের ক্রেতারা তখন সেই প্রতিষ্ঠানগুলো কিনে দিয়েছিল। পর্তুগালে তারা বন্দর, এয়ারলাইন্স, হোটেল এবং এনার্জিয়াস দ্য পর্তুগাল নামে দেশের বৃহত্তম বিদ্যুত উৎপাদক ও পরিবেশক প্রতিষ্ঠানের মালিকানাস্বত্বের অনেকটাই কিনে নিয়েছিল। সঙ্কটের সময় গ্রীসকে চীন মূল্যবান মূলধন যুগিয়েছিল। তবে চীনা অর্থের সবচেয়ে বড় অংশটা গেছে পশ্চিম ইউরোপে যার মধ্যে ব্রিটেন ও জার্মানিও আছে। জার্মানিতে চীন প্রধানত বিনিয়োগ করেছে হাইটেক ফার্মগুলো যাতে এই বিশেষজ্ঞ জ্ঞান তারা আরও করতে পারে। গত ফেব্রুয়ারিতে চীনরা মার্সিডিজ রেঞ্জের মালিক কোম্পানি ডেইমলারের ১০ শতাংশ স্বত্ব কিনে নেয়ায় জার্মান কর্তৃপক্ষ শঙ্কিত বোধ করে। তাদের উদ্বেগের আরেক বড় কারণ চীনা কোম্পানিগুলো ছোট ছোট বিশেষায়িত ফার্মগুলোকে গিলে খাচ্ছে। এসব বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে চীন কি চায় এটা ঠিক যে চীন ইউরোপীয় ইউনিয়নের পতন ত্বরান্বিত করতে চায় না যেমনটা চায় রাশিয়া। বরং ইউরোপের মুক্তদ্বার নীতি ও সম্পদকে চীন তার নিজের জন্য সুবিধাজনক হিসেবে দেখে। কিছু কিছু ইউরোপীয় মনে করে যে চীন তাদের মহাদেশটিকে বিভক্ত ও জয় করার জন্য চতুমাত্রিক একদাবা খেলা খেলছে। তবে বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞের মতে প্রকৃত বাস্তবতা সে ধরনের কিছু নয়। চীন ইউরোপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করে প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধাকে কাজে লাগাতে চায়। চীন আসলে এমন এক উন্নত ও আধুনিক পরাশক্তি হতে চায় মাকে অন্যরা অস্বীকার করতে না পারে। ইউরোপকে চীন একটি সম্পদশালী ও উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন অঞ্চল হিসাবে দেখে যা কিনা তার সেই লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে। ইউরোপকে চীন নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধার সুপার মার্কেট হিসাবে দেখে যাকে কাজে লাগিয়ে একদিকে নিজের উত্থান ঘটানো যায় এবং অন্যদিকে তার প্রতি বিরোধিতাকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে পাশ্চাত্যকে তার বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে কাজ করতে না দেয়া যায়। ইতোমধ্যে চীন তার বিনিয়োগের সুযোগ নিয়ে পাশ্চাত্যের কিছু কিছু দেশকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে। সিইএসসি চায়না এনার্জির কথাই ধরা যাক। ব্যক্তি মালিকানাধীন হলেও রাষ্ট্রীয় সমর্থনপুষ্ট এই প্রতিষ্ঠানটির চীনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে ভাল যোগাযোগ আছে। সিইএফসি ২০১৫ সালে প্রাগে এসে পাইকারিভাবে কেনাকাটায় মেতে উঠি। দেশের বৃহৎ অর্থলগ্নি গোষ্ঠী জেএন্ডটি, দেশের সর্ববৃহৎ এয়ারলাইন ট্রাভেল সার্ভিস, মিডিয়া গোষ্ঠী এক্সপ্রেস, প্রাগের দ্বিতীয় প্রধান ফুটবল দল এসকে স্লাভিয়া প্রাগ ও এর স্টেডিয়ামের বড় অংশের শেয়ার কিনে নেয়। এর পাশাপাশি বিভিন্ন প্রভাবশালী চেককে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে ভাড়া করে। এর ফলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চেক প্রজাতন্ত্রে চীনের প্রভাব বিস্তার শুরু হয়। চীনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে চেক সরকার আগে বেশ সরব ছিল। এখন টু শব্দটি করছে না। ইউরোপের যতই পূর্বদিকে ও দক্ষিণে যাওয়া যাবে এই প্রভাব ততই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা স্থায়ী সালিশি আদালতের রায়কে সমর্থন করলেও গ্রীস ও হাঙ্গেরী ইইউকে তা করতে দেয়নি। এ রকম দৃষ্টান্তের অভাব নেই। চলমান ডেস্ক সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×