ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দলীয় নেতা-কর্মীদের জন্য নির্বাচন উৎসব নয়, পরীক্ষা -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ১৫ নভেম্বর ২০১৮

দলীয় নেতা-কর্মীদের জন্য নির্বাচন উৎসব নয়, পরীক্ষা -স্বদেশ রায়

নির্বাচনের মনোনয়নপত্র কেনা উপলক্ষে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা নির্বাচন বিষয়টিকে উৎসবে পরিণত করেছেন। বাঙালী উৎসবপ্রবণ জাতি। সবকিছুকে উৎসবে পরিণত করতে ভালবাসে। এ দেশের সাধারণ মানুষ নির্বাচনকে তাই উৎসবে পরিণত করে। গ্রামের অনেক সাধারণ ঘরের নতুন বউ তার জীবনের প্রথম ভোট দিতে যাওয়া উপলক্ষে একটা নতুন শাড়িও কেনেন। তবে এই সাধারণ মানুষের থেকে দলীয় নেতা-কর্মীদের অনেক সচেতন হতে হয়। তাদের মনে রাখতে হয় কেন এই নির্বাচনটি? আওয়ামী লীগের মতো দলের নেতা-কর্মীদের বোঝা উচিত আগামী ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনটি কেবলমাত্র পাঁচ বছর পর পর জনগণের কাছ থেকে ক্ষমতায় যাবার বৈধতা নেয়ার নির্বাচন নয়। এ নির্বাচনটি ১৬ কোটি মানুষের জন্য একটি অগ্নিপরীক্ষা। বাংলাদেশে প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের জীবনযাত্রায় যে পরিবর্তন এসেছে, দেশের মানুষ যে ভাল আছে, শান্তিতে আছে- দেশ এখানে থাকবে না দেশ আবার পিছিয়ে যাবে- সেটাই এখন সব থেকে বড় বিষয়। দেশের মানুষের কাছে একটি বিষয় প্রমাণিত, শেখ হাসিনা যদি আবার ক্ষমতায় আসেন তাহলে দেশের মানুষের এই শান্তি আরও বাড়বে, দেশ আরও এগিয়ে যাবে। আর শেখ হাসিনা যদি না আসতে পারেন তাহলে দেশ পিছিয়ে যাবে। দেশের সকল উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়বে। অতীতে তার শত শত প্রমাণ আছে। ২০০১-এ শেখ হাসিনা দেশে বিদ্যুত উৎপাদনের পরিমাণ সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াটে রেখে যান। তিনি ২০০৮-এ এসে পান একুশ শ’ মেগাওয়াট। এমনিভাবে সব সেক্টর দেখলে দেখা যাবে একই অবস্থা হয়েছিল। শেখ হাসিনার সাফল্যের অনেক কারণের একটি কারণ বের করেছিলেন মতিউর রহমান চৌধুরী তাঁর মানবজমিন পত্রিকার একটি রিপোর্টের মাধ্যমে। ওই রিপোর্টে তিনি দেখিয়েছিলেন, শেখ হাসিনা প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টার ওপর পরিশ্রম করেন। অন্যদিকে বেগম জিয়া ৬ ঘণ্টাও পরিশ্রম করেন না। তাঁর পত্রিকার ওই রিপোর্টের মূল বক্তব্য ছিল, শেখ হাসিনা ফুলটাইম দেশের জন্য রাজনীতি করেন, খালেদা পার্ট টাইম। এ ছাড়া যোগ্যতা, দেশপ্রেম অনেক বিষয় আছে। সর্বোপরি শেষ কথা বলা যায় মুনতাসীর মামুনের ভাষায়, ‘সব বিকল্পের বিকল্প আছে, শেখ হাসিনার বিকল্প নেই।’ তাই দেশের মানুষ শেখ হাসিনাকে আবার রাষ্ট্র ক্ষমতা দেয়ার ক্ষেত্রে ভুল করবে না। তারপরেও নেতাকর্মীদের নির্বাচনকে উৎসব মনে করার কোন যুক্তি নেই। কারণ, পৃথিবীতে সকল ভালকে পেতে হয় কষ্টের মধ্য দিয়ে। ভাল কিছু সহজে অর্জন করা যায় না। নেতা-কর্মীরা নির্বাচনকে এই উৎসব মনে করে নির্বাচনের মনোনয়নপত্র কেনার ক্ষেত্রে যা করেছেন, তা মোটেই দায়িত্বশীল আচরণ নয়। যেখানে এবারের ছাত্রলীগের ছেলেমেয়েরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় আসা ছেলেমেয়েদের পানি সরবরাহ করল, তাদের হল চিনতে সাহায্য করল, তাদের জন্য সব ধরনের শৃঙ্খলারও ব্যবস্থা করল। তার বিপরীতে যারা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নেবেন, যারা আগামীতে দেশ চালাবেন তাদের মাথার ভেতর একবারও এলো না এভাবে যানচলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, সাধারণ মানুষকে কষ্ট দিয়ে মনোনয়নপত্র কিনতে যাবার জন্য মিছিল করা উচিত নয়। কখনও এমন উচ্ছৃঙ্খলভাবে সে মিছিল নেয়া হলো যে, তার জন্য দু’জনের প্রাণ গেল। তারপরেও প্রতিটি এলাকা থেকে দশ পনেরো জনকে মনোনয়নপত্র কিনতে হবে? এক এলাকা থেকে ৫২ জনকে মনোনয়নপত্র কিনতে হবে? এটা কেমন কথা! মনে হচ্ছে কারও কোন ধৈর্য নেই, কারও অপেক্ষা করার মানসিকতা নেই। হয়তো কোন দলে এ ধরনের মনোনয়ন কেনার হিড়িকের ভেতর দিয়ে ওই দলের জনপ্রিয়তা বোঝা যায়। বোঝা যায় দলটি জনপ্রিয়। তবে এতে দলের সাংগঠনিক শৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কেন এবার ২০০৮-এর মতো তৃণমূল থেকে মনোনয়ন দেয়া হলো না কেন্দ্রে? এবারের নির্বাচনটি ২০০৮- এর থেকে সহজ মনে করা হচ্ছে? কোন নির্বাচনই সহজ মনে করার কোন যুক্তি নেই। ২০১৪-তে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অর্ধেক আসনে নির্বাচিত হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন ওই নির্বাচন সহজ ছিল। নির্বাচনের সকল দায়ভার সেদিন শেখ হাসিনাকে কাঁধে নিতে হয়েছিল বলে দূর থেকে বিষয়টি সহজ মনে হয়। ওই নির্বাচন পার করতে শেখ হাসিনাকে কোন্ মহাসাগর পাড়ি দিতে হয়েছিল তা শেখ হাসিনা যদি কোনদিন আত্মজীবনী লেখেন তখনই কেবল তার নেতা-কর্মীরা সম্পূর্ণ উপলব্ধি করতে পারবেন। তাও পারবেন বলে মনে হয় না। তাই ২০১৮-এর এই নির্বাচনকে সহজ কোন নির্বাচন মনে করার কোন কারণ নেই। কারণ, এই নির্বাচনে মানুষের ভোটের বাইরে ২০০১ এর ও ১/১১-এর কুচক্রীরা মাঠে নেমে গেছে। ১/১১-এর সেই সব ব্যক্তি ও পত্রপত্রিকা এখন জোর তৎপর। এ কারণে দেশের মানুষ এখন বিপদে। গণতন্ত্রের বদলে ভয়ঙ্কর কিছুকে নির্বাচনের মাধ্যমে আনার একটি ষড়যন্ত্র চলছে। এমতাবস্থায় আওয়ামী লীগের দায়-দায়িত্ব অনেক বেশি। আর আওয়ামী লীগের দায়-দায়িত্ব বলতে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের দায়-দায়িত্ব। তাদের এ মুহূর্তে এ নির্বাচনকে কোনক্রমেই উৎসব মনে করার কোন সুযোগ নেই। বরং এটা তাদের জন্য অনেক বড় পরীক্ষা। কঠিনতম একটি পরীক্ষা। যে পরীক্ষায় ফেল করার কোন সুযোগ নেই। তাদের জন্য এমন একটি ফাইনাল খেলা, যেখানে ট্রফি জেতা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। এজন্যই এ ধরনের একটি নির্বাচনে তাদের হতে হবে অনেক সুশৃঙ্খল। দেশের সচেতন মানুষ, গণতন্ত্রকামী মানুষ, শান্তিপ্রিয় মানুষ তাদের কাছ থেকে সেটা আশা করে। অন্যদিকে ভোট এলে মানুষকে নানানভাবে বিভ্রান্ত করা হয়। এই বিভ্রান্তি কাটানোর দায় এখন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর। তাদের অবস্থা এখন হতে হবে পরীক্ষার পূর্বরাতের মতো। তাদের কোন মতেই অতি আত্মবিশ্বাসী হবার কোন সুযোগ নেই। মনে রাখা উচিত, তাদের নেত্রী বলে দিয়েছেন, প্রতিটি মানুষের কাছে যেতে হবে। প্রতিটি মানুষকে তাদের সরকারের উন্নয়নের কথা যেমন বোঝাতে হবে, তেমনি বোঝাতে হবে শেখ হাসিনার সরকারের ধারাবাহিকতা না থাকলে দেশের এ উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকবে না। মানুষকে এই সত্যে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সব থেকে বড় প্রয়োজন কঠিন নিয়ম নিষ্ঠার ভেতর দিয়ে নির্বাচনী প্রচার চালানো। কোনরূপ অতি আত্মবিশ্বাসী মানসিকতা, অহঙ্কার যেন তাদেরকে পেয়ে না বসে। আবার কোন বিশৃঙ্খলা যেন না ঘটে কোন নির্বাচনী কাজে। অন্যদিকে তারা যেন ছলনায় না পড়ে। যেমন, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে দেখেছি, বিএনপি শিবিরে অনেক টাকা। তারা তাদের ক্যাম্পগুলোতে বিভিন্ন ধরনের খাওয়া-দাওয়া ও ক্যারামসহ নানান খেলার আয়োজন করে- ওই সব আনন্দের মধ্যে আটকে রাখে আওয়ামী লীগ কর্মীদের। আওয়ামী লীগ কর্মীরা মনে করেছিলেন, তাদের দলতো এমনিতেই ক্ষমতায় যাবে। তাই একটু সময় নষ্ট করলে কি আর ক্ষতি! এবারও বিএনপি শিবিরে সব থেকে বেশি অর্থ। কারণ, গত দশ বছরে বিএনপি ব্যবসায়ীরাই আওয়ামী লীগ ব্যবসায়ীর ভেক ধরে বেশি অর্থ উপার্জন করেছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অনেক আওয়ামী লীগ ব্যবসায়ী যে দুই নৌকায় পা রাখবে না, এমন বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। সর্বোপরি, বিএনপির জন্য আছে পাকিস্তানের আইএসআই-এর টাকা। এই টাকাসহ নানান পথে বিদেশী কালো টাকা আসবে নির্বাচনকে সামনে রেখে। সরকারকে এ বিষয়ে সজাগ হতে হবে। ২০০১-এর নির্বাচনে সব থেকে বড় ভূমিকা রেখেছিল বাইরের থেকে আসা কালো টাকা। এছাড়া জামায়াতে ইসলামী তাদের ভা-ার খুলে দেবে। যত টাকা লাগে তারা ব্যয় করবে বিএনপি ও কামাল হোসেনদের ক্ষমতায় আনার জন্য। ২০০১-এর অভিজ্ঞতা থেকে একটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন, ড. কামালরা যখন মাঠে নামেন, তখন ধরে নিতে হবে নির্বাচনে প্রচুর কালো টাকা ব্যয় হবে। ২০০১-এ এই সব প্লেয়ারের খেলা দেশবাসী দেখেছে। হয়তো দেশের মানুষ পর্দার অন্তরালের অনেক খবর জানেন না, সেদিন কীভাবে কালো টাকা নির্বাচনের প্রতিটি স্তরে ব্যবহার করা হয়েছিল। এবারও ইতোমধ্যে কমবেশি শোনা যাচ্ছে, বিএনপি কোন্ কোন্ স্থানে কীভাবে কালো টাকা ব্যয় করবে। তাই এই নির্বাচনকে কোন মতেই আওয়ামী লীগ কর্মীদের উৎসব মনে করার কোন কারণ নেই। উৎসব মনে করলে, উৎসব পালনের মতো আচরণ করলে দেশ ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। বরং তাদেরকে মনে করতে হবে, এটা একটি পরীক্ষা। কঠিন পরীক্ষা। কোন জাতীয় নির্বাচন কখনই কোন সহজ পরীক্ষা নয়। এখানে প্রতি পদে পদে দায়িত্বশীল আচরণ ও কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। [email protected]
×