ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিচিত্র প্রচারে মুখর রাজধানী

সব প্রার্থীর পক্ষে জনগণ সবারই জয় সুনিশ্চিত, চলছে আগাম উৎসব

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১৫ নভেম্বর ২০১৮

সব প্রার্থীর পক্ষে জনগণ সবারই জয় সুনিশ্চিত, চলছে আগাম উৎসব

মোরসালিন মিজান ॥ প্রত্যেকের একটি করে ভোট। নির্ধারিত দিনে তা প্রদান করলেই হলো। কাজের কাজটি হয়ে যায়। কাকে পছন্দ, কাকে একদমই নয়, নীরবে ব্যালট পেপারের মাধ্যমে বলে দেয়া খুবই সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশের বেলায় এই মৌনতা কল্পনার অতীত। ‘পলিটিক্স’ তো? সবাই বুঝেন! তারও বেশি বোঝাতে ব্যস্ত। টেলিভিশনে তাই এত টকশো। অলি গলি ফুটপাথে চায়ের দোকান, প্রায় প্রতিটি দোকানে নির্বাচনী সংলাপ। হ্যাঁ, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এই পরিবর্তন। গত ৮ নবেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। জানিয়ে দেয়া হয় আগামী ২৩ ডিসেম্বর ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। পরে তারিখ পরিবর্তন করে ৩০ ডিসেম্বর করা হয়। তখন থেকেই উৎসবের আমেজ। ৩০০ সংসদীয় আসনের বিপরীতে অগণিত প্রার্থী। সবাই বিশাল শোডাউনের মাধ্যমে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করছেন। জমাও দিচ্ছেন একইভাবে। এবং মজার বিষয় এই যে, প্রত্যেক প্রার্থী মনে করছেন, তার পক্ষে জনগণ। প্রত্যেকেই বলছেন, জয় আমার সুনিশ্চিত! তাই সমান আবেগ উত্তেজনা নিয়ে মনোনয়নপত্র কিনছেন তারা। প্রতিটি মনোনয়নপত্রের মূল্য ৩০ হাজার টাকা। এরপরও শুধু আওয়ামী লীগের নেতারা ৪ হাজার ৩৬৭টি মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। বিক্রি বাবদ দলীয় ফান্ডে জমা হয়েছে ১৩ কোটি ১০ লাখ ১০ হাজার টাকা। বিএনপির মনোনয়নপত্র সংগ্রহ এখনও চলছে। দলটির পক্ষ থেকে প্রথম দু’দিনে মোট ৩ হাজার ২২২টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি করা হয়। এর মোট মূল্য ৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। মনোনয়ন বিক্রি করছে জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য দলও। কোন দলেই নেতার অভাব হচ্ছে না। বরং মনোনয়নপত্র সংগ্রহের পরপরই শুরু হয়ে যাচ্ছে উৎসব। আগাম উৎসবে মেতেছেন প্রার্থী ও সমর্থকরা। বিচিত্র প্রচারে মুখর এখন শহর ঢাকা। মূল উৎসবটি দৃশ্যমান হচ্ছে ধানমণ্ডি ও নয়াপল্টন এলাকায়। মনোনয়নপত্র বেচাকেনাকে উপলক্ষ করে জায়গা দুটি নতুন প্রাণ পেয়েছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মানুষের ঢল। সারাদেশ থেকে নেতাকর্মীরা আসছেন। কারও চাওয়া আছে। কেউ অন্যের চাওয়াকে জোরালো করতে সঙ্গে এসেছেন। এভাবে অজানা অচেনা মানুষে মোটামুটি গমগম করছে রাজধানী শহর। প্রথম স্রোতটি নেমেছিল ধানমণ্ডিতে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়। এখান থেকে মনোনয়নপত্র বিক্রির ঘোষণা আসার পর থেকেই হৈ হৈ রৈ রৈ কাণ্ড। তফসিল ঘোষণার পরদিন ৯ নবেম্বর থেকে মনোনয়নপত্র বিক্রি শুরু হয়। শেষ হয় ১২ নবেম্বর। চারদিনে আমূল বদলে যায় আশপাশের পরিবেশ। নির্বাচনী উৎসবটা বিপুলভাবে সামনে আসে। সারাদেশের নেতাকর্মীদের একটাই ঠিকানা। সেটি দলীয় সভানেত্রীর ধানমণ্ডির কার্যালয়। গত কয়েকদিন সেখানে গিয়ে দেখা যায়, মনোনয়ন প্রত্যাশীদের উপচেপড়া ভিড়। যেন মহাসমাবেশ চলছে। আসলে একজন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে এসেছেন। আর সঙ্গে এসেছেন শত সহস্রকর্মী! এসেছেন বলতে, নিয়ে আসা হয়েছে। মিছিলের সারি দীর্ঘ করাই তাদের কাজ। নেতাকর্মীদের কারও হাতে সম্ভাব্য ‘এমপি সাহেবের’ প্রতিকৃতি। মুখে ‘তোমার ভাই’ ‘আমার ভাই’ স্লোগান। কারও হাতে নৌকা। নির্বাচনী এই প্রতীক কতভাবে যে গড়ে নেয়া হয়েছে! কেউ বাঁশ দিয়ে কাঠামো তৈরি করেছেন। তার ওপরে জড়িয়ে দিয়েছেন ফুলের মালা। কেউ শোলা বা কাগজ দিয়ে নৌকা তৈরি করেছেন। সব মিলিয়ে নৌকা আর জলযান হয়ে নেই। ঢাকার শুকনো রাজপথে উঠে এসেছে! যে যতটা সম্ভব নির্বাচনী প্রতিকটিকে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করেছেন। নিজের দাবি করে সেভাবেই দেখাতে চেয়েছেন। আর এ দেখানোর কাজটি ভালভাবে করতেই নিজ নিজ এলাকা থেকে লোকজন নিয়ে আসা। বাস ট্রাক ট্রেন ভর্তি করে রাজধানীতে নেতাকর্মী আনা হয়েছে। ধানমণ্ডি কার্যালয়ের সামনে কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা নেত্রকোনা এলাকার মনোনয়ন প্রত্যাশী আরিফ খান জয়ের সমর্থক। শতাধিক বাস ও ব্যক্তিগত পরিবহনে করে ঢাকায় এসেছেন। ১ হাজারের মতো নেতাকর্মী। এত মানুষ, হোটেলে জায়গা হয় না। তাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে মোহাম্মদপুরে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুদিন তারা সেখানে ছিলেন বসে জানা যায়। একই আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী শামসুর রহমান লিটন ট্রেনের কয়েকটি কামড়া ভর্তি করে সমর্থক নিয়ে এসেছেন বলে জানান তার এক কর্মী। সিলেট বিভাগ থেকে এসেছিলেন অপেক্ষাকৃত কম বয়সী প্রার্থী খন্দকার মনজুর আহমদ। সুনামগঞ্জ ১ আসনে প্রার্থী হতে চান তিনি। কিন্তু এত লোকবল নিয়ে আসা কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার আসনে জনগণ নৌকার মাঝির পরিবর্তন চায়। উন্নয়নের জন্য প্রার্থী পরিবর্তনের কোন বিকল্প নেই। এ কথা হাইকমান্ড পর্যন্ত পৌঁছে দিতেই এত লোক নিয়ে আসা। মনোনয়ন পেলে নিশ্চিত জয় পাবেন বলে জানান তিনি। নোয়াখালী-১ আসনে আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচন করতে চান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুছ। মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে অহর্নিশ সংগ্রাম করছি আমি। এ সংগ্রামের আরেক ধাপ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনে জয় লাভ করলে নিজের এলাকার মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ বাড়ে। এ কারণেই ভোটে আসা। পেশি শক্তি নেই। টাকার গরম নেই। এর পরও নিজের জয়ের ব্যাপারে জোর আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। অবশ্য বৃহস্পতিবার ভিড় ছিল গণভবনের সামনে। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা এদিন সভানেত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাত লাভের সুযোগ পান। এখানে কথা হয় বেশ কয়েকজন সম্ভাব্য সংসদ সদস্য প্রার্থীর সঙ্গে। প্রত্যেকেই বলেন, তার সঙ্গে জনগণ আছে। নমিনেশন পেলে তার জয় সুনিশ্চিত! এদিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র বিক্রি করছে আরেক বড় দল বিএনপিও। গত ১১ নবেম্বর হঠাৎ করেই নির্বাচনে ফেরার ঘোষণা দেয় ঐক্যফ্রন্টের আড়ালে থাকা বিএনপি। এরপর থেকেই সরগরম নয়াপল্ট এলাকা। এখানে প্রচুর নেতাকর্মী সমবেত হচ্ছেন প্রতিদিন। বিক্রি হচ্ছে মনোনয়নপত্র। উৎসবের আমজটাও দৃশ্যমান। প্রথম দিন তো হাতির পিঠে চড়ে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে এসেছেন কেউ কেউ! অনেকে নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষ বহন করছিলেন। ছিল নেতাদের ছবি। দেখে বোঝা যায়, দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকলেও আমা বাঁচিয়ে রেখেছেন নেতাকর্মীরা। গত মঙ্গলবার বগুড়ার এক মনোনয়ন প্রত্যাশী হাবিবুর রহমান বলছিলেন, বিএনপির পক্ষে জনগণ আছে। নিরপেক্ষ ভোট হলে কেউ তার জয় আটকাতে পারবেন না। কথা শেষ করতে না করতেই তাকে ঘিরে থাকা কর্মীরা স্লোগান শুরু করে দেয়। এভাবে ভোট উৎসব দৃশ্যমান হয় বিএনপি কার্যালয়ের সামনেও। তবে বুধবার একটি বড় অঘটনও এখানে ঘটানো হয়েছে। নেতাকর্মীরা চড়াও হয়েছে পুলিশের ওপর। গাড়ি ভাংচুর অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছে। এর ফলে উৎসবের আমেজটা কিছুটা হলেও নষ্ট হয়েছে। কেন এমন হলো? জানতে চাইলে মহানগর বিএনপির এক কর্মী আলমগীর হোসেন বলেন, আমাদের অন্যায়ভাবে বাধা দেয়া হচ্ছিল। তাই মাথা গরম করে এমন ঘটনা ঘটানো হয়েছে। তবে নির্বাচনী উৎসব তারা বজায় রাখবেন বলে জানান। জাতীয় পার্টিও পিছিয়ে নেই। দলটি প্রথম একদিনেই ৫শ’ ৫৩টি মনোনয়নপত্র বিক্রি করে। নির্বাচনী রঙ্গও কম হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে ভাল উদাহরণ হিরু আলম। অভিনব কর্মকাণ্ড করে আলোচনায় আসা তরুণ এবার জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। এসবের বাইরে প্রচারে নেমেছে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। বিশেষ দৃষ্টি কাড়ছেন তারকারা শিল্পীরা। এদের মধ্যে রয়েছেন চলচ্চিত্র নায়ক ফেরদৌস, রিয়াজ, শাকিল খান। নাট্য অভিনেতা জাহিদ হাসান, অরুণা বিশ্বাস, সাদিয়া ইসলাম মৌসহ আরও অনেকে আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রচার চালাবেন। এ প্রসঙ্গে চিত্রনায়ক ফেরদৌস বলেন, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনাকে আমি প্রচণ্ড ভালবাসি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা আমাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি যে উন্নয়নের ধারা দেখিয়ে দিয়েছেন, এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। এ কারণেই প্রচারে নেমেছেন বলে জানান তিনি। অন্যদিকে বিএনপির হয়ে প্রচারে অংশ নিচ্ছেন কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবর, বেবী নাজনীন, কনক চাঁপা, মনির খান প্রমুখ। এদের কেউ কেউ আবার মনোনয়নও চান বলে জানা গেছে। এখানেই শেষ নয়, পত্রিকায় টেলিভিশনে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেও নিজের গুণকীর্তন প্রচার করছেন প্রার্থীরা। আর পোস্টারে তো অনেক আগেই ঢাকা পড়েছে শহর ঢাকার দেয়াল। সব মিলিয়ে নির্বাচনী উৎসব জমে উঠেছে। শেষটাও ভাল হবে- সকলের তাই প্রত্যাশা।
×