বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণসহ জলবায়ু পরিবর্তনের সমূহ হুমকির প্রেক্ষাপটে বর্তমানে টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে বিদ্যুত উৎপাদনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। বর্তমানে অধিকাংশ বিদ্যুত উৎপাদন হয়ে থাকে প্রধানত কয়লা ও জীবাষ্ম জ্বালানির মাধ্যমে। খনিজ সম্পদ বিধায় এ দুটোর প্রাপ্তিই সীমিত। আন্তর্জাতিক বাজারে দামও স্থিতিশীল নয়। তদুপরি পরিবেশের জন্য সমূহ ক্ষতিকর ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী। অন্যদিকে জলবিদ্যুত, সৌরবিদ্যুত, বায়ুবিদ্যুত ও পারমাণবিক বিদ্যুত অপেক্ষাকৃত পরিবেশবান্ধব এবং এসবের প্রাপ্তিও সহজলভ্য ও অসীম। অবশ্য পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনে ঝুঁকিসহ ব্যয় অনেক বেশি পড়ে। সে সব বিবেচনায় সর্বাধিক সহজলভ্য হলো সৌরালোক, বায়ু ও জলবিদ্যুত। গ্রীষ্মপ্রধান নিরক্ষীয় অঞ্চলের দেশ বিধায় বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতের অফুরান সম্ভাবনা বিদ্যমান। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা সেই অপার ও অফুরান সম্ভাবনা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছি। সরকারের বিদ্যুত নীতিতে এখন পর্যন্ত সবিশেষ জোর দেয়া হচ্ছে কয়লা ও জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুত উৎপাদনে। রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ শুরু হলেও উৎপাদনে যেতে সময় লাগবে। অথচ দেশের পরিবেশ ও জলবায়ু রয়েছে সমূহ ঝুঁকিতে। সরকার এ বিষয়ে সবিশেষ সচেতন ও সোচ্চার হলেও বাস্তবে নবায়নযোগ্য বিদ্যুত উৎপাদনে কোন অজ্ঞাত কারণে জোর দেয়া হচ্ছে না। হতে পারে, আমদানিনির্ভর কয়লা ও জ্বালানি তেলে কমিশন বাণিজ্যের সুযোগ রয়েছে। যে কারণে অবহেলিত থেকে যাচ্ছে সৌরবিদ্যুত ও বায়ুবিদ্যুত প্রকল্পে বিনিয়োগ। আরও একটি অবাক ব্যাপার হলো, বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুত উৎপাদনের খরচ পড়ে ভারতের চেয়ে বেশি। ভারতের রাজস্থানে প্রতি ইউনিট সৌরবিদ্যুত ক্রয়ে ব্যয় হয় মাত্র তিন সেন্ট। অথচ বাংলাদেশে প্রতি ইউনিট সৌরবিদ্যুত কিনতে ব্যয় হয় সর্বনিম্ন ১২ সেন্ট। সৌরকোষে বিদ্যুত উৎপাদনের পরিমাণও কম। ফলে এ খাতে প্রায় কেউই বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হন না। বর্তমানে দেশে মাত্র ২৩ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুত সংযুক্ত হচ্ছে জাতীয় গ্রিডে। এর মধ্যে কক্সবাজারে ২০ মেগাওয়াট এবং জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে তিন মেগাওয়াট। এর বাইরে দেশের অন্যত্র সৌরবিদ্যুত প্রকল্পে বিনয়োগে উৎসাহী হচ্ছে না কেউ। সংশ্লিষ্ট বিদ্যুত বিভাগে যোগাযোগ করা হলে অজুহাত হিসেবে দেখানো হয় জমি সঙ্কট, জমি অধিগ্রহণ সমস্যা ইত্যাদি। অথচ পার্বত্য অঞ্চল, চরাঞ্চলসহ উত্তরবঙ্গে যথেষ্ট সরকারী খাসজমি রয়েছে। এই সমস্যার আশু সমাধানে ভারতের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্প্রসারণে আলাদা মন্ত্রণালয় গঠন করা অত্যাবশ্যক।
সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে অন্তত ১০ ভাগ বিদ্যুত উৎপাদন হওয়ার কথা। সেই হিসেবে বর্তমানে দৈনিক বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা ৯ হাজার মেগাওয়াট থেকে ৯০০ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুত প্রয়োজন। বাস্তবে সোলার হাব সিস্টেম এবং মিনি গ্রিড মিলিয়ে পাওয়া যায় মাত্র ২৩ মেগাওয়াট বিদ্যুত। দক্ষিণাঞ্চলসহ কোন কোন অঞ্চলে ব্যক্তি উদ্যোগে ঘরে ঘরে সৌরবিদ্যুত জনপ্রিয় হলেও সরকারী-বেসরকারী ছোট-বড় উদ্যোগ নেই বললেই চলে। সুপরিসর পর্যায়ে সৌরবিদ্যুত প্রকল্প বাস্তবায়নে অন্যতম একটি বড় বাধা হলো জমি প্রাপ্তি ও অধিগ্রহণ। সে কারণে দেশীয় উদ্যোক্তারা সৌরবিদ্যুত উৎপাদনে আগ্রহ প্রায় হারিয়ে ফেলছে। বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে একটি সোলার পাওয়ার হাব নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে। সৌরবিদ্যুতের এই হাবটি হবে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন। বিদ্যুত বিভাগ এখন পর্যন্ত জাতীয় বিদ্যুত গ্রিডে সংযুক্ত হতে পারে এমন কোন সৌরবিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করতে পারেনি। সেই প্রেক্ষাপটে মীরসরাইয়ের সোলার পাওয়ার হাবটি হতে পারে পথপ্রদর্শক। পিডিবি খুব শীঘ্রই এটির জন্য দরপত্র আহ্বানের ঘোষণা দিতে পারে। তবে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি তথা গোষ্ঠীগত উদ্যোগও অবশ্যই প্রত্যাশিত।
শীর্ষ সংবাদ: