ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

৫ উইকেট নিয়ে ধসিয়ে দিলেন জিম্বাবুইয়ের দ্বিতীয় ইনিংস

শেষদিনে নায়ক সেই মিরাজ

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ১৬ নভেম্বর ২০১৮

শেষদিনে নায়ক সেই মিরাজ

মোঃ মামুন রশীদ ॥ সফরকারী জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টেই হেরে ব্যাকফুটে চলে গিয়েছিল স্বাগতিক বাংলাদেশ দল। মিরপুরে দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টে তাই জান-প্রাণ উজাড় করে দিয়েই খেলেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। এমন দাবি চতুর্থদিন শেষে ২১ বছর বয়সী তরুণ মেহেদী হাসান মিরাজই করেছিলেন। তখন পর্যন্ত চলমান টেস্টে তার ভূমিকার বিষয়টি বেশ আলোচিত হয়েছে। প্রথম ইনিংসে মুশফিকুর রহীমের ডাবল সেঞ্চুরি ও মুমিনুল হকের সেঞ্চুরি এবং দ্বিতীয় ইনিংসে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের শতক বাকিদের ম্লান করে দিয়েছিল। বল হাতে ধারাবাহিকতা রেখে বাঁহাতি স্পিনার তাইজুল ইসলাম প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেট শিকার করে অন্য বোলারদের ওপরে ছায়া ফেলেছিলেন। তবে ব্যাটে-বলে চতুর্থদিন পর্যন্ত মিরাজের অবদানটাকে পার্শ্বনায়ক হিসেবে দারুণ কার্যকর হিসেবেই বিবেচনা করা হয়েছিল। সেই মিরাজই শেষদিনে নিজের ওপরে সব আলো টেনে নিলেন, ৫ উইকেট শিকার করে ধসিয়ে দিলেন প্রতিপক্ষ জিম্বাবুইয়ের সব প্রতিরোধ। টেস্ট ক্যারিয়ারে পঞ্চমবারের মতো ইনিংসে ৫ উইকেট শিকার করে তিনিই মিরপুর টেস্টের পঞ্চম ও শেষদিনে হয়ে গেছেন নায়ক। মিরাজের টেস্ট ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল রূপকথার মতো অবিশ্বাস্য। আবির্ভাবেই ইংল্যান্ডের মতো পরাশক্তিকে ডানহাতি অফস্পিনে কাঁপিয়ে দিয়ে ২ টেস্টের সিরিজে ১৯ উইকেট তুলে নিয়েছিলেন যা ছিল অভিষেকে কোন বোলারের বিরল কীর্তি। প্রথমবারের মতো দুর্বিনীত ইংলিশদের দর্পচূর্ণ হয়েছিল তাতে। ওই টেস্টের ৪ ইনিংসের মধ্যে তিনবারই ৬ উইকেট শিকার করেছিলেন। তবে এরপর ইনিংসে আবার ৫ উইকেট শিকার করতে অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে প্রায় দুই বছর। গত জুলাইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে কিংসটনে ক্যারিয়ারের ১৪তম টেস্টে আবার ৫ উইকেটের দেখা পান। এরপর আর অপেক্ষা দীর্ঘ হয়নি, এক টেস্ট বিরতি দিয়েই আবার ৫ উইকেটের দেখা পেয়েছেন। তবে সিলেটে হওয়া প্রথম টেস্টে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে তিনি একেবারেই ম্লান ছিলেন। মূলত ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় তিনিও ব্যাট হাতে কিছু করতে পারেননি আর একা তাইজুল বিধ্বংসী হয়ে প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করেছেন। তবে দ্বিতীয় ইনিংসেই সেখানে জ্বলে উঠে নিয়েছিলেন ৪৮ রানে ৩ উইকেট। মিরপুর টেস্টের প্রথম ইনিংসে আবারও তাইজুলের পাশাপাশি জ্বলে ওঠেন তিনি। এবারও তাইজুল ৫ উইকেট শিকার করেন, আর মিরাজ তুলে নেন ৩ উইকেট। এর আগে ব্যাট হাতেও দারুণ কার্যকর অবদান রেখেছিলেন। প্রথম ইনিংসে মিরাজ যখন ৯ নম্বরে ব্যাট করতে নামেন তখন মুশফিকের সেঞ্চুরি হয়ে গেছে। ১৪৩ রানে দাঁড়িয়ে থাকা মুশফিকের জন্য তখন অপেক্ষা ডাবল সেঞ্চুরির। তাকে ৩৩ ওভার সঙ্গ দিয়েছেন মিরাজ এবং সেই সুযোগে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে দেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ২১৯ রানের অপরাজিত ইনিংস পেয়েছেন তিনি। আর উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট ইতিহাসে দুটি ডাবল সেঞ্চুরির একমাত্র ঘটনার জন্ম দিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন। ১০২ বলে ৫ চার, ১ ছক্কায় ৬৮ রানে অপরাজিত ইনিংস খেলেন মিরাজ। প্রথম ইনিংসে ব্যাট হাতে ৩৩ ওভার উইকেটে থাকা এবং বল হাতে ২০ ওভার করার পরও দ্বিতীয় ইনিংসে দলের বিপর্যয়ে দাঁড়িয়ে যান আরেকবার। এবার যখন তিনি নেমেছেন সেই ৮ নম্বরে তখন মাহমুদুল্লাহর রান ছিল ৫৬! প্রায় ৯ বছর অপেক্ষার পর তিনি সেঞ্চুরিটি পেয়েছেন মিরাজের দৃঢ়তাপূর্ণ অপরাজিত ২৭ রানের কল্যাণে। এবার ১২ ওভার উইকেটে থেকেছেন তিনি। চতুর্থদিনেই জিম্বাবুইয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নামার পর প্রথম ব্রেক থ্রু এনে দেন মিরাজ। দারুণ খেলতে থাকা মাসাকাদজাকে (২৫) সাজঘরে ফিরিয়ে দেন। দিনশেষে মিরাজ বলেছিলেন, ‘তাইজুল ভাই ভাল বোলিং করছে বলেই উইকেটগুলো প্রাপ্য। আমি তার পাশাপাশি সাপোর্ট করছি। এখন দুইজনই যদি ভাল বোলিং করি তাহলে তো ওরা অল্প রানে আউট হয়ে যাবে। তবে কাল (পঞ্চমদিন) একটা ভাল সুযোগ আছে, আমার ও তাইজুল ভাইয়ের। আশা করছি বোলাররা কঠোর পরিশ্রম করে শতভাগ চেষ্টা করবে উইকেটের জন্য।’ সেটা প্রয়োজন ছিল অতীব দরকারী জয় তুলে নেয়ার জন্য। আর সুযোগটা নিজেই নিয়েছেন। এবার আর পার্শ্ব নায়কের ভূমিকায় থাকেননি। পঞ্চমদিনে শন উইলিয়ামসের উইকেট নিয়ে শুরু করেন মুস্তাফিজুর রহমান, এরপর সিকান্দার রাজাকে ফেরান তাইজুল। তখনও পার্শ্ব নায়ক মিরাজ এরপরই জ্বলে ওঠেন। জিম্বাবুইয়ে ইনিংসের লেজটা একাই মুড়িয়ে দিয়েছেন ভয়ানক অফস্পিনের মায়াজালে আবদ্ধ করে। তার ঘূর্ণিতে বিভ্রান্ত হয়ে সাজঘরে ফিরেছেন পিটার মুর, ডোনাল্ড তিরিপানো, ব্রেন্ডন মাভুতা ও কাইল জারভিস। দুই স্পেলে ১২ ওভার বোলিং করে ৩ মেডেনসহ ২৮ রানে নিয়েছিলেন ১ উইকেট। ফিরতি স্পেলে বল হাতে এসে তার বিধ্বংসী ঐন্দ্রজালে ৪ উইকেট তুলে নেন ৬.১ ওভারে। শেষ এই স্পেলে তার বোলিং বিশ্লেষণ ছিল ৬.১-২-১০-৪। সবমিলিয়ে ১৮.১-৫-৩৮-৫ তার দ্বিতীয় ইনিংসের বোলিং ফিগার। এ নিয়ে ১৬ টেস্টের ক্যারিয়ারে পঞ্চমবারের মতো ইনিংসে ৫ উইকেট শিকার করলেন তিনি। সবমিলিয়ে ৩১ ইনিংস বোলিং করে উইকেট নিয়েছেন ৬৯টি। ক্যারিয়ারের প্রথম ১৬ টেস্টে বাংলাদেশের পক্ষে ৬ বার ৫ উইকেট শিকার করে সেরা সাকিব আল হাসান। তিনি মূলত ১৫ টেস্টের ২২ ইনিংস বোলিং করেই সেই কীর্তি দেখিয়েছিলেন। তবে অভিষেক হওয়ার পর ক্যারিয়ারের প্রথম ১৬ টেস্টে সর্বাধিক উইকেট মিরাজের দখলে। মোহাম্মদ রফিক প্রথম ১৬ টেস্টের ২৪ ইনিংসে ৪ বার ৫ উইকেট নেয়াসহ ৬১, সাকিব প্রথম ১৬ টেস্টে ২৫ ইনিংস বোলিং করে ৫৭ ও তাইজুল ১৬ টেস্টের ২৯ ইনিংসে (৩ বার ৫ উইকেট) ৫৪ উইকেট শিকার করেছিলেন। সেদিক থেকে যেমন এগিয়ে থাকলেন তেমনি মিরপুর টেস্টের শেষদিনে পার্শ্বনায়ক থেকে জয়ের নায়ক হলেন মিরাজ।
×