ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বই ॥ জোনাকির আলো

প্রকাশিত: ০৭:৫৪, ১৬ নভেম্বর ২০১৮

বই ॥ জোনাকির আলো

হাজেরা নজরুলের ‘জোনাকির আলো’ গল্প সঙ্কলন প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৬৮ সালে। নতুন সংস্করণ করে তা আবারও পাঠক সমাজকে উপহার দেয়া হয় ২০১৬ সালের অমর একুশে গ্রন্থ মেলায়। ‘নন্দিতা প্রকাশ’ গ্রন্থটি বের করে। প্রচ্ছদ আঁকেন রাজিব রায়। মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশ নেয়া এই সৃজনশীল নারী ব্যক্তিত্ব সাহিত্যের বহুমাত্রিক শাখায় বিচরণ করেছেন। একটি নির্মল সাংস্কৃতিক আবহে তৈরি হওয়া হাজেরা নজরুল যে মাত্রায় তার মননশীলতার জগতে সদর্পে এগিয়ে গেছেন সে জায়গায় শুধু নিজেকেই পূর্ণ করেছেন তা কিন্তু নয় বরং বাংলা সাহিত্যের আঙিনাকে ভরিয়েও তুলেছেন। এই বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ কর্মজীবনে বর্ণাঢ্য সময় পার করার পাশাপাশি নিজের সৃজন শক্তিকেও নিয়মিত চর্চা করেছেন। আলোচ্য গ্রন্থটি তার সৃষ্টিশীল জগত তৈরি করার প্রথম সূচনা। ১৯৪২ সালে জন্ম নেয়া এই উদীয়মান তন্বী গল্পের বিষয়বস্তু নির্ধারণে যে স্বাপ্নিক আবিষ্টতাকে লালন করেন সেটাই তৎকালীন নতুন প্রজন্মের এক প্রাসঙ্গিকভাব কল্পনা। ১৯৬৮ সালে লেখা গল্পগুলোতে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস যেমন আছে প্রথম ভাল লাগার আবেগাচ্ছন্ন অনুভবও নানামাত্রিকে চেতনায় ভর করে। প্রেমের সরোবরে অবগাহনে সৃজনদ্যুতি যেমন আলো ছড়ায় পাশাপাশি ব্যক্তিক মুগ্ধতারও হরেক রকম প্রকাশ ঘটে। চিরায়িত ভালবাসার অনন্ত মহিমায় অন্তরনিঃসৃত ভাবাবেগ যেমন চালিত করে একইভাবে পারিপার্শ্বিক বিপরীত ¯্রােতও সেই উচ্ছ্বসিত নিবিষ্টতায় বেদনার আঁচড় বসিয়ে দেয়। প্রেমের এই এক অবধারিত গতি প্রবাহ মিলনের আবেগকে গ্রথিত না করে বিচ্ছেদের অনলই নিদারুণভাবে প্রজ্বলিত হয়। গল্পকারের প্রতিটি গল্পে আছে একদিকে প্রেমের নিঃশর্ত সমর্পণ অন্যদিকে ভর করে বিরহের তীব্র যন্ত্রণা। কাছের মানুষ যখন নিজের হয় না সেই দুঃসহ অন্তর্জ্বালা জীবনকে তাড়িয়ে বেড়ালেও এক অমোঘ পরিণতিতে তা অপসৃয়মান হতেও সময় লাগে না। শুরু করা ‘নায়িকা’ গল্পটিও বিরহ বিচ্ছেদের এক মর্মযাতনা। গল্পের নায়িকার পছন্দের মানুষটিকে না পাওয়ার যে অসহনীয় কষ্ট সেখানে জীবনের নিয়মে এক সময় স্থিতি হতে হয়। ব্যর্থতার বেদনায় কাতর হলে চলমান জীবনের ছন্দপতন হয়, স্বাভাবিক গতিতে সমাজ, সংস্কার, সংসার চলে না সেই চিরস্থায়ী বোধও প্রতিটি গল্পকে জীবনমুখী করে সময়ের মিছিলে এগিয়ে নেয়। গল্পের দক্ষ নির্মাতা মনে করেন নিয়মের আবর্তে গড়া যাপিত জীবনের আবেগঘন মনোবৃত্তি যতই অন্তর নিঃসৃত আচ্ছন্নতায় নিবিষ্ট হোক না কেন এক সময়ে সেই দুরন্ত প্রেম বাস্তবতার কষাঘাতে বিস্তৃতির পর্যায়ে চলেও যায়। তার পরও অব্যক্ত এক যন্ত্রণা জীবনভর বয়ে বেড়ানো সেও এক স্মৃতিকাতর আবর্তে গুমড়ে মরা। ‘আলোর আড়ালে’ গল্পটিতে প্রেম-ভালবাসার ঘাটতি না থাকলেও বিষয়বস্তুর গতি নির্ধারণে অর্থবিত্তের ফারাকও স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। সমচেতনাই শুধু নয় অর্থনৈতিক মানদ-ও কাছাকাছি হতে না পারলে প্রতিদিনের জীবন, সম্পর্ক দুর্বিষহ হতে সময় নেয় না। প্রতিটি সমাজের এই এক অসম আবহ যা মানুষের সহজ মিলনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সচেতন এবং মানবিক বোধে যাকে কোনভাবেই মানা যায় না। কাহিনীর প্রাসঙ্গিকতায় সেই সব দায়বদ্ধতাকেও লেখক পাঠকের দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে সচেষ্ট হয়েছেন। ‘তিমিরের হাতছানি’ গল্পটিও আবেগে-উচ্ছ্বাসে নিবেদিত নায়িকার নিঃশর্ত হৃদয়ের অর্ঘ সমর্পণ। নায়কও অবলীলাক্রমে সেই আবিষ্টতায় নিমগ্ন হলেও সেখানে যে পরিমাণ ছলচাতুরি লেখকের সৃজন দ্যোতনায় একজন বিবাহিত পুরুষ কুমারী মেয়ের অব্যক্ত প্রেমকে লালনই শুধু করেন না তাকে গভীরতার পর্যায়ে নিয়ে যেতেও দ্বিধাহীন। এমন মানুষের সংখ্যাও সমাজে কম নেই। ফলে রিক্ততা আর বঞ্চনার আখ্যানও আপন গতিপথে এগিয়ে চলে। সমাজ আর ব্যক্তি মানুষের জীবনের এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভবগুলো ভুক্তভোগীদের কোন্ মাত্রায় নিয়ে যায় তাও গল্পকারকে সচকিত করে তোলে। এভাবেই গল্পের কাহিনী তৈরি হয়, এগিয়ে যায়, অনাকাক্সিক্ষত টানাপোড়েনে বিধ্বস্ত হয় বেদনাবিধুর আবহে তার পরিণতিও নির্ধারিত হয়। গল্পগুলো সুখপাঠ্য। পাঠকদের ভাল লাগার কথা। তবে বিষয়বস্তুতে তেমন কোন চমক নেই। বৈচিত্র্যহীনও বলা যেতে পারে। বানানের ব্যাপারে আরও সাবধান হওয়া জরুরী। তবে সমাজকে আনা হয়েছে ঘটনার প্রাসঙ্গিকতায় ফলে গভীরে সেভাবে প্রবেশ করা হয়নি। সচেতনতার নিরিখে সেটারও প্রয়োজন ছিল। সমাজ বিচ্ছিন্ন প্রেম শুধু আবেগে চিরস্থায়ী হয় না চৈতন্যের নিষ্ঠতাও তাকে জোরালো করে তোলে।
×