ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোঃ জাভেদ হাকিম

পবিত্র নগরী মদিনা

প্রকাশিত: ০৮:০৬, ১৬ নভেম্বর ২০১৮

পবিত্র নগরী মদিনা

পবিত্র হজ মূলত পাঁচ দিন। কিন্তু বাংলাদেশী হাজীরা এক থেকে দেড় মাসের ভিসা পেয়ে থাকেন, যা ভ্রমণপিপাসুদের জন্য মোক্ষম সুযোগ। আমিও সেই সুযোগটুকু বেশ কাজে লাগিয়েছিলাম। পবিত্র হজ শেষে চিরাচরিত ভ্রমণ নেশায় ঘুরে বেড়াই নানা দর্শনীয় জায়গায়। ভ্রমণ যেহেতু রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে সেহেতু সুযোগমতো ঘুরতেই হবে। তা ছাড়া ভ্রমণ করাও সুন্নত। এবাদত বন্দেগীর পাশাপাশি চলল ঘোরাঘুরি। আজ লিখব পবিত্র মদিনার গল্প। মক্কা থেকে মদিনায় যাওয়ার সময় পথের যে দৃশ্য তা লিখে বোঝানো সম্ভব নয় তবুও চেষ্টা করছি। আধুনিকতার মিশেলে তৈরি প্রশস্ত সড়কে গাড়ি যখন চলে, তখন এমনিতেই অন্য রকম ভাললাগা কাজ করেছে মনে। গাড়ি যতই এগিয়ে যায় ততই যেন সৌন্দর্যের ঘোরে নিমজ্জিত হতে থাকি। সারি সারি পাহাড়মালা, দৃষ্টিনন্দন সব ইমারত, আইল্যান্ডের মাঝে সারিবদ্ধ খেজুরগাছ দেখতে দেখতে এক সময় চোখে ধরা দেবে জনমানবহীন ধু ধু মরুভূমি আর বিরাট বিরাট আকৃতির নানা রঙের পাহাড়। তপ্ত মরু ভূমির বুকে মাথা উঁচু করে থাকা বাবলা গাছগুলো দেখে মনে হবে, এ যেন বিশাল শূন্যতার মাঝে একখ- সবুজ। কোথাও কোন মানুষের দেখা না পেলেও মরুভূমির জাহাজ নামেখ্যাত শত শত উট আর দুম্বার বিচরণ দেখেছি। সেসব দৃশ্যও ভ্রমণপিপাসুদের কাছে অন্য রকম ভাললাগার স্মরণীয় মুহূর্ত হয়ে থাকবে। মক্কা থেকে মদিনায় বাসে যাত্রা সময় প্রায় ৬ ঘণ্টা। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়টা যেন খুব দ্রুতই ফুরিয়ে যাবে। আমাদেরও ফুরাল। বাস এসে থামল মদিনা শহরের বাঙালী পট্টির বাংলাদেশ হজ মিশনের পাশে। এখানকারই এক আবাসিক হোটেলে আমাদের থাকার জায়গা ঠিক রাখা ছিল। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়েই সোজা আমি ও রুমমেট মন্টু কাকা এবং সৌদি অবস্থানকালীন আমাকে আপন চাচির মতো ¯েœহ করা বেগম সামসুন্নাহারসহ চলে যাই হোটেল থেকে অনতিদূরে মসজিদে নববী। নববীর প্রথম দর্শনেই চোখ জুড়িয়ে যায়। এখানে পুরুষ-মহিলাদের জন্য নামাজের স্থান পৃথক রাখা হয়েছে। চাচিকে মহিলাদের জায়গায় রেখে আমরা দু’জন চলে যাই বাবে জিব্রাইল গেটের দিকে। এই গেট দিয়েই রাসুল [সা] নিকট জিব্রাইল [আ] ওহী নিয়ে প্রবেশ করতেন। ভাবতেই অন্য রকম লাগে। আমি এখন সেখানেই দাঁড়িয়ে। আজান পড়ে। মাগরিবের নামাজ আদায় করি। দুনিয়ার বুকে যত মসজিদ রয়েছে তার মধ্যে গুরুত্বের দিক থেকে মসজিদে নববীর স্থান তৃতীয়। আর বরকতের দিক থেকে মসজিদুল হারামের পরেই মসজিদে নববীর স্থান। এই মসজিদে ৪০ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করলে মুসলিম বিশ্বাস মতে তার জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম হয়ে যায়। এ রকম একটা মসজিদে নামাজ আদায় করতে পারাটা ভ্রমণ জিন্দেগিতে এক অবিস্মরণীয় ব্যাপার। মহানবী হযরত মোহাম্মদ [সা] মসজিদে নববীকে ‘আমার মসজিদ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হুজুর [সা] বলেছেন নববীর পরিধি যদি সাফা পর্যন্তও হয় তবুও তা আমার মসজিদ হিসেবে গণ্য হবে। আল্লাহু আকবার, মসজিদটি যে কতটা বরকতময় তা রাসুল [সা] কথা হতে স্পষ্ট। এর নির্মাণের সময় তিনি নিজে সাহাবিদের সঙ্গে কাজ করেছেন। মদিনা হিজরতের পর হুজুর [সা] সর্বপ্রথম ইসলামের কর্মকেন্দ্র হিসেবে একটি মসজিদ নির্মাণের প্রয়োজন বোধ করেন। তখন তিনি হযরত আবু আনসারির বাড়ির সামনের এই খালি জায়গাটি পছন্দ করেন। জায়গার মালিক ছিল অল্প বয়সের এতিম দুই ভাই। তাদের নিকট জমিটি হুজুর [সা] ক্রয় করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন কিন্তু তারা বিনামূল্যেই দিতে চাইলেন। হুজুর [সা] দুই ভাইয়ের ভবিষ্যত চিন্তা করে বিনামূল্যে না নিয়ে তৎকালীন বাজারমূল্য দশ দিনার দিয়ে ক্রয় করে নিলেন। মসজিদে নববীর প্রথম ভিত্তিও স্থাপন করেন আখেরি নবী হযরত মোহাম্মদ [সা]। নির্মাণকালীন সময়ে এর দরজা ছিল মোট তিনটি । যা এই সময়ে এসে দাঁড়িয়েছে প্রধান ফটক ৪১টিসহ মোট ৮৩টি। আজকের আধুনিক পৃথিবীর অন্যতম দৃষ্টিনন্দন মসজিদে নববীÑ মদিনার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। প্রথম হিজরি ৬২২ খ্রিস্টাব্দে এর নির্মাণকাল। বর্তমানে ৬ লাখ মুসল্লি ধারণক্ষমতা, তবে হজ মৌসুমে ১০ লাখ পর্যন্ত নামাজ আদায় করতে পারাÑ মসজিদে নববীর বর্তমান মিনার রয়েছে ১০টি। নজরকাড়া প্রতিটি মিনারের উচ্চতা ৩৪৪ ফুট। এর ভেতরের দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য ও আলোকসজ্জা চোখ ধাঁধিয়ে যায়। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে সমগ্র আরব উপদ্বীপের মধ্যে এখানেই সর্বপ্রথম বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানো হয়। নববীর পুরনো অভিজ্ঞ বাঙালী খাদেম জনাব খলিলুর রহমানের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল প্রতিদিন ফজরের পর বিশাল আকৃতির ২৭টি গম্বুজ বৈদ্যুতিক সাহায্যে সরে যাওয়ার পর সরাসরি বাইরের আলো মসজিদের মেঝে পর্যন্ত পড়ে। আমি নিজেও একদিন স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে অবাক হয়েছি। নববীর ভেতরেই রয়েছে মহানবী হযরত মোহাম্মদ [সা] রওজা শরীফ। তাঁর পাশেই হরত আবুবকর [রা] ও হযরত ওমর [রা.] কবর মোবারক। মসজিদে নববীর মিম্বার হতে রওজা পর্যন্ত স্থানটিকে বলা হয় রিয়াদুল জান্নাত বা জান্নাতের বাগান। এখানে এবাদতের বিশেষ ফজিলত রয়েছে। মসজিদের দক্ষিণ পূর্ব দিকে রয়েছে জান্নাতুল বাকি নামক কবরস্থান। হযরত ওসমান [রা.] ও ফাতিমা [রা.] সহ দশ হাজার সাহাবির কবর রয়েছে। জান্নাতুল বাকিতে সর্বপ্রথম হযরত আসাদ বিন জারারা [রা.]কে সমাধি করা হয়। মসজিদে নববীর ৫ নং ও ৮ নং গেটের সামনে রয়েছে কোরান এক্সিভিশন সেন্টার ও রাসুল [সা.] জীবনীর এক্সিভিশন সেন্টার । সেখানে রক্ষিত রয়েছে হাতে লেখা এ যাবত পাওয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোরান শরীফসহ হাজার বছর আগের বিভিন্ন সাইজের হস্ত লিখা কোরান শরীফ। আরও রয়েছে কাবা ঘরের পূর্ব অবস্থা, মসজিদে নববীর প্রথম আকৃতির প্রতিকৃতি। দেয়ালে লাগানো রাসুল [সা.] শিশুকাল হতে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনীসহ নানা নিদর্শন। ইংরেজী ও আরবীতে লেখা রাসুল [সা.] জীবনী ধৈর্য সহকারে পড়লে হাজী ও ভ্রমণপিপাসুদের জন্য বেশ শিক্ষণীয় হয়ে রবে। মসজিদে নববীর ২১ ও ২২ নম্বর গেটের কিছুটা সামনে রয়েছে সুদৃশ্য একটি ঘড়ি। যা আগুন্তকদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। তার পাশেই রয়েছে ঝাঁক বাধা শত শত জালালি কবুতরের অবাধ বিচরণ। যা আপনাকে তপ্ত গরমেও জালালির ওড়াউড়ি চোখে-মুখে প্রশান্তি এনে দেবে। এবার বিদায় ইসলামের দ্বিতীয় পবিত্রতম মসজিদে নববী হতে, যেখান থেকে সারা দুনিয়ার অর্ধেকেরও বেশি এলাকা শাসন করা হতো ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে। তাহলে বন্ধুরা আজ এই পর্যন্তই, ইনশাআল্লাহ পরবর্তী কোন সংখ্যায় মদিনার জিন পাহাড়ের গল্প নিয়ে হাজির হব।
×