ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আফরোজা পারভীন

বন্ধু পেল রুম্পা

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ১৭ নভেম্বর ২০১৮

 বন্ধু পেল রুম্পা

এ কলোনিতে আসার পর রুম্পা একা হয়ে গেছে। মফস্বলের খোলামেলা পরিবেশ, প্রচুর বন্ধুবান্ধব আর খেলার সাথীদের ছেড়ে ঢাকায় এসে ও হাঁপিয়ে উঠেছে। এখানে সবাই ব্যস্ত। কেউ কারও বাড়িতে যায় না। নিচের মাঠটাতে খেলা হয়, ও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। কিন্তু ওকে কেউ ডাকে না। ডাকবেই বা কেন, ওকে তো কেউ চেনেই না। রুম্পা পর পর তিন দিন নিচে নেমে মাঠের কিনারে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল, ওর বয়সী মেয়েদের দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়েছিল যাতে কেউ ওকে ডাকে। কিন্তু কেউ ওকে ডাকেনি। ওরা খেলাতেই ব্যস্ত ছিল। যেন ওকে দেখেইনি। এরপর থেকে আরও মনমরা হয়ে গেছে রুম্পা। ও সকালে বুয়ার হাত ধরে স্কুলে যায়। বুয়া ওকে স্কুলে দিয়ে বসে থাকে। বারোটায় ওর ছুটি হলে একবারে নিয়ে আসে। তারপর থেকে সারাদিন ও একা। বুয়া নিজের মতো রান্না বান্না করে টেবিলে খাবার সাজিয়ে ওকে খাওয়ার তাড়া দিয়ে গোসল সেরে লম্বা একটা ঘুম দেয়। উঠে টিভি দেখতে বসে। তখনও রুম্পার মা মনিকা বা বাবা শাহেদ ফেরে না। ওদের পাঁচটায় ছুটি। তারপর মাইক্রোবাসে ঘুরে ঘুরে আসতে আসতে সাতটা বাজে। রুম্পা খানিকক্ষণ রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে মাঠের খেলা দেখে, খানিকটা সময় খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ঘরে এসে কমিক বই নিয়ে বসে। কমিক ওর মন টানে না। ওর মনে পড়ে সেই মফস্বলের খেলার মাঠ, গোল্লাছুট, বৌচি, কানামাছি। লিলি সুখেন বকুল আর আর বন্ধুদের। ওর কান্না পায়, কিন্তু কাঁদে না। মা বলেছেন, এটাই নাকি বর্তমান সমাজের বাস্তবতা। যার নাম বিচ্ছিন্নতা। বিচ্ছিন্নতা মানে একা হয়ে যাওয়া। এ বাস্তবতা ওকে কষ্ট দেয়, কিন্তু সে কষ্টের কথা বলবে কাকে! মা রুম্পাকে এ কথা বলেননি। বলছিলেন বাবার সঙ্গে। : দেখ এত কষ্ট করে ঢাকা এলাম। মেয়েকে ভাল স্কুলে পড়াব। ভাল করে মানুষ করব। কিন্তু এখানে সব যেন কেমন বিচ্ছিন্নতা। অফিসে কলিগরা সেভাবে মন খুলেও কথা বলে না। খেলার সাথী না পেয়ে মেয়েটা দিন দিন মনমরা হয়ে যাচ্ছে। কী করি বলত? : কি বলব, এত একটা বড় সমস্যা। দেখ না আশপাশে ওর বয়সী কোন বাচ্চা আছে কীনা আসা যাওয়া করুক তাদের বাসায়। আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব হবে। মাঝে মাঝে ওকে নিচে নিয়ে যাও। : কখন যাব, ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে পেরিয়ে যায়!। ও তিনদিন গিয়েছিল। ওকে খেলায় নেয়নি। তারপর থেকে ওর মন আরও খারাপ। আমাকে কিছু বলে না। গম্ভীর আর মনমরা হয়ে থাকে। তাতেই বুঝি। আশপাশের বাসায় যাবার কথা ওরা ভাবে বটে, হয় না। সপ্তাহে ছুটির দুটো দিন হাজারটা কাজ জমে থাকে। কারও বাসায় যাওয়া হয় না। কোন বাসায় রুম্পার বয়সী মেয়ে আছে সে খোঁজও নেয়া হয় না। মা মেয়ের জন্য অনেক রকম ছবির বই আনেন। বাবা আনেন অনেক খেলনা আর খাবার। রুম্পা বইগুলো উল্টে দেখে। ওর মনে টানে না। খাবার কিছুটা খায়, অনেকটাই পড়ে থাকে। ও এখন বড় হয়েছে। পুতুল আর গাড়ি নিয়ে খেলার বয়স কি ওর আছে! ও চায় জীবন্ত মানুষের সঙ্গে খেলতে। আগে বাবা-মায়ের বন্ধুরা বেড়াতে আসত। ওকে আদর করত। আদর করে গাল নেড়ে দিত, মাথার চুল এলোমেলো করে দিত। খুব ভাল লাগত ওর। রুম্পা ওদের আসার পথ চেয়ে থাকত। ওরা আসলে পটাপট কয়েকটা ছড়া শুনিয়ে দিত। এখন এখানে ছড়া শুনানোরও কেউ নেই। সেদিন হঠাৎ মায়ের এক আত্মীয়া এলেন। মা রুম্পাকে বললেন, : রুম্পা ইনি তোমার বিথি খালা। আমার খালাত বোন। বিথি এই বুঝি তোর মেয়ে। কি নাম মা? আহ্ বলত কতদিন পর দেখা । যোগাযোগ না থাকলে আপনজনও পর হয়ে যায়। : ও সাথী। তোমার মেয়ে বুঝি আপু? আসত মামনি কাছে। কী নাম তোমার? রুম্পা দৌড়ে খালামণির কাছে যায়। ভাবে এখনই বুঝি ওর গাল টিপে দেবে, উড়িয়ে দেবে মাথার চুল। আর রুম্পা ওকে দুটো ছড়া শুনিয়ে দেবে। তেমন কিছুই ঘটেনা। কাছে যেতে বিথি খালা ওর হাতে মিষ্টি আর আইসক্রিম দেয়। হেসে বলে, এগুলো তোমার জন্য রুম্পা জ্বলজ্বলে চোখে সাথীর দিকে তাকায়। সে চোখের ভাষা বুঝে মা বলেন, : যাও তোমরা দুজনে খেলা করোগে। আমার মেয়েটা খেলার সাথী পায় না বুঝেছিস। রুম্পা সাথীর হাত ধরে। সাথী আসে না। মায়ের কাছে ঘেঁষে দাঁড়ায়। পারলে মাকে আাঁকড়ে ধরে থাকে। ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বিথি খালা বলেন, : ও বড় লাজুক। আস্তে আস্তে ঠিক হবে। সাথী ওর মায়ের গায়ে গা লাগিয়ে বসে থাকে। আর রুম্পা মনমরা হয়ে আস্তে আস্তে ভেতরে গিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শোয়। ওর চোখ দিয়ে গলগল করে পানি পড়তে থাকে। দুই. বুয়া বছরে একবার বাড়ি যায়। আট-দশ দিন থেকে আবার আসে। এবারও গেল। এখন রুম্পা আরও একা। মা রাত জেগে রান্না করেন। অফিসের পিওন ওকে স্কুলে দেয়, আনে। একা দিন কাটে রুম্পার। বুয়ার আসার দিন পেরিয়ে গেল, এল না। মার ফোনের পর ফোন পেয়ে জানালো, সে আর আসতে পারবে না। শরীর খারাপ। তার এক বোনকে পাঠাচ্ছে। মার হাতে আর কোন অপশন নেই। সেদিন শুক্রবার। দরজার বেল বেজে উঠল। দরজা খুলতে ঘরে ঢুকল ঘোমটা ঢাকা এক মহিলা। সঙ্গে রুম্পার বয়সী একটা মেয়ে। : কে তুমি? : সবুরা, বুয়া পাঠাইলো। ক্যান আপনারে কয় নাই? : বলেছে, কিন্তু তুমি মিয়ে নিয়ে আসবে তাতো বলেনি। আমি মেয়েসহ রাখতে পারব না। ওসব ঝামলা আমি নিতে পারব না : তয় আমার থাকা হইবে না। ওর বাপ নাই। কার কাছে রাখুম। মহিলা বেরিয়ে যেতে থাকে। তখনই মেয়েটি এসে রুম্পার হাত ধরে : চলো খেলি : দুজন এক দৌড়ে বেরিয়ে যায় বারান্দায়। শোনা যেতে থাকে ওদের কলকাকলি আর রুম্পার লাগামহীন হাসি। মনিকা বিরক্তি নিয়ে তাকায়। বুয়ার মেয়ের সঙ্গে খেলার জন্য ধমক দিতে যায় রুম্পাকে। পর মুহূর্তে সামলে নেয়। মানুষের মানুষ চাই, বন্ধু চাই। মিষ্টি স্বরে বলে, : এসো ভেতরে এসো। মেয়ে নিয়েই থাকবে। অলঙ্করণ : আইয়ুব আল আমিন
×