ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জন্মশত বার্ষিকীর ভাবনা

বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছড়াতে নিরন্তর চেষ্টা কৃষ্ণেন্দুর

প্রকাশিত: ০৪:৫১, ১৭ নভেম্বর ২০১৮

বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছড়াতে নিরন্তর চেষ্টা কৃষ্ণেন্দুর

বাবুল সরদার ॥ এদেশের মাটিতে তার শিকড়ের কোন সংযোগ নেই। নেই কোন আত্মীয়স্বজন, খেলার মাঠ, শৈশবের স্কুল, জমিজিরাতের কোন স্মৃতি নেই। দেশ ভাগের সময় এদেশ ত্যাগের কোন ক্ষত তার ব্যক্তিগত জীবনে নেই, কিন্তু দেশ ভাগের যন্ত্রণা প্রতিনিয়ত অনুভব করেন তিনি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তাকে টানে, ভাষা আন্দোলন তাকে স্পর্শ করে যায়। বাংলাদেশের প্রতি তার অগাধ প্রেম। নদী-নালা-আকাশ-পাখি-শাপলা দেখতে দেখতে নিজেকে হারিয়ে ফেলেন বাংলার সৌন্দর্যের মাঝে আর বলেন, ‘এই বাংলার মাটিতে জন্ম দিও মাগো!’ প্রতিনিয়ত ভাবেন বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ণ হবে কীভাবে। তাই তিনি খুব কাছ থেকে দেখতে চেয়েছিলেন সুজলা-সুফলা, শস্যশ্যামলা বাংলাদেশকে। চেয়েছিলেন বাংলাদেশের রূপ-রস-গন্ধ উপলব্ধি করতে। তিনি ওপার বাংলার ভারতীয় নাগরিক কৃষ্ণেন্দু বেরা। বাংলাসাহিত্যের এই মানুষটি প্রকৃতিপ্রেমী ও ইতিহাসের তথা পুরাতত্ত্বের সংগ্রাহকও বটে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধা। তিনি প্রতিনিয়ত পড়েন অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি গ্রন্থ এবং শোনেন ’৭১-এর ৭ই মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ, যা অবাক করে আমাদের। আর সেই শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশেই ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীকে পাথেয় করে গত ১৫ আগস্ট, ২০১৮ তার দেশের স্বাধীনতা দিবসের বর্ণময় আনন্দোজ্জ্বল অনুষ্ঠান ফেলে এসেছিলেন টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের উদ্দেশে বাইসাইকেলে চড়ে। ওপার বাংলার পূর্ব মেদিনীপুর জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের ভূমিপুত্র বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী দীঘার সমুদ্র সৈকত থেকে সাইকেলে কলকাতা-বেনাপোল-যশোর-গোপালগঞ্জ-টুঙ্গিপাড়া হয়ে ঢাকার ৩২নং ধানমন্ডির বাড়িতে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর স্নেহের স্পর্শ নিতে। ধানমন্ডির বাড়ির দেয়ালে গুলির চিহ্ন তাকে ব্যথিত করে। ছোট্ট শেখ রাসেলের সাইকেল ও ছবি দেখে এই বর্বরোচিত নৃশংস হত্যাকা-ের জন্য পাকিস্তানের দোসরদের প্রতি তীব্র ধিক্কার জানান তিনি। সঙ্গী চার বন্ধু ঢাকা থেকে ফিরে গেলেও বাংলাপ্রেমী এই মানুষটি ফিরে যাননি। শৈশবে আবৃত্তি শিক্ষার হাতে খড়ি হয়েছিল তার মা দীপ্তি বেরার কাছে। সেদিন তিনি রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের প্রেমে পড়েন। ঢাকা থেকে বরিশালে আসেন জীবনানন্দের খোঁজে। জীবনানন্দের বাড়ি, ধানসিঁড়ি নদী, মসজিদের শহর বাগেরহাট, খুলনার দক্ষিণডিহিতে রবিঠাকুরের শ্বশুরবাড়ি, নড়াইলে এসএম সুলতানের সমাধি পরিদর্শন করেন। ইতিহাসের গন্ধমাখা মানুষটি ঢাকার শিখা অনির্বাণ, স্বোপার্জিত স্বাধীনতা, জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের সমাধি, শহীদ মিনার, অপরাজেয় বাংলা দেখতে ভোলেননি। অবশেষে দীর্ঘ দুই হাজার কিমি পথ পাড়ি দিয়ে নিজভূমে দীঘার সূচনাস্থলে ফিরে যান। অসাম্প্রদায়িক চেতনার এই মানুষটির মন্দির থেকে মসজিদ, গির্জায় সমান বিচরণ ও শ্রদ্ধা দেখে অনেকেই মুগ্ধ। দীর্ঘ পথশ্রমও তাকে ক্লান্ত করতে পারেনি। হাসিমুখে তিনি এপার বাংলার আতিথেয়তা ও আত্মীয়তায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। কথার ফাঁকে তিনি জানান, তার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু জন্মের শতবার্ষিকীতে পা দেবেন। এই ক্ষণজন্মা মানুষটির জন্মের এই শুভক্ষণকে বর্ণময় ও স্মরণীয় করে রাখতে ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার এক শ’ নদীর জল ও মাটিতে বৃক্ষরোপণ করতে চান। বৃক্ষটির নামকরণ হবে ‘মৈত্রীবৃক্ষ’ বা ‘সংহতিবৃক্ষ’। স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মতিক্রমে ধানম-ি, টুঙ্গিপাড়া, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা জাতীয় স্মৃতিসৌধকে অগ্রাধিকার দিতে চান। জল ও মাটির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষ নদীমাতৃক দেশ। মজে যাওয়া ও দূষিত নদী সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা প্রয়োজন। তাছাড়া দীর্ঘ পরিসরে একটি বড় জনপদে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাচেতনা ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যম হলো জল ও মাটি সংগ্রহের অনেক ছোট ছোট অনুষ্ঠান। এই তিনটি দেশের নদী নির্বাচন সম্পর্কে বলেন, এই তিন দেশের জাতীয় সঙ্গীতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ প্রভাব আছে। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বমানবতাবোধের ভাবনায় বঙ্গবন্ধুর মুক্ত চেতনার আলোকে আন্তর্জাতিক সংহতির বাতাবরণ সৃষ্টি হবে। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে ভারত ও বাংলাদেশের শত শিল্পীর শত কণ্ঠে দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হবে। যে এক শ’ নদীকে চিহ্নিত করা হবে সাহিত্যে বা ইতিহাসে তার উল্লেখ থাকবে। তার তথ্য ও জল-মাটি সংগ্রহের অনুষ্ঠানের ছবি সংবলিত একটি গ্রন্থ প্রকাশ হবে। এক শ’ নদীর মধ্যে বাংলাদেশের চৌষট্টি জেলার চৌষট্টি নদী, ভারতের চৌত্রিশটি নদী ও শ্রীলঙ্কার দুটি নদী থাকবে। এই জল ও মাটি সংগ্রহের ঐতিহাসিক কলস, পিতলের পাত্র, অবশিষ্ট জল ও মাটি ইত্যাদি সামগ্রী বাংলাদেশের কোন জাদুঘরে সংরক্ষণের জন্য আবেদন জানাবেন। কৃষ্ণেন্দু বেরা সম্প্রতি এসেছিলেন বাংলাদেশের বিভিন্ন গুণীজন ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতে। সবাই এই প্রতিবেশী নাগরিকের বাংলার প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা তথা জাতির পিতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা দেখে সাধুবাদ জানানোর পাশাপাশি গভীর উৎসাহ প্রকাশ করেন।
×