ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

একজনকে ফেল করাতে দুই নেতার গোপন ফোনালাপ

প্রকাশিত: ০৪:৫৭, ১৭ নভেম্বর ২০১৮

  একজনকে ফেল করাতে দুই নেতার গোপন ফোনালাপ

নিজস্ব সংবাদদাতা, জামালপুর, ১৬ নবেম্বর ॥ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে জামালপুর-৩ মেলান্দহ-মাদারগঞ্জ আসনের আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী টানা পাঁচবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমকে নির্বাচনে ফেল করানো প্রসঙ্গে জামালপুর সদর আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য রেজাউল করিম রেজনুর সঙ্গে জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি মাহবুবুর রহমান জিলানীর অডিও ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে। বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ফাঁস হওয়া আওয়ামী লীগনেতা ও ছাত্রদলনেতার সেই অডিও ফোনালাপটি ভাইরালও হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ছাড়াও সারা জেলায় সাধারণ মানুষের মোবাইল ফোনে এই অডিও ফোনালাপটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। বিষয়টি এখন টক অব দ্য জামালপুরে পরিণত হয়েছে। এ নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগ থেকে শুরু করে জেলার পাঁচটি আসনেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দার ঝড় বইছে। তারা এই ফোনালাপকে প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা রেজাউল করিম রেজনুর বিরুদ্ধে দলীয় সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। ৪ মিনিট ২৪ সেকেন্ডের এই অডিও ফোনালাপে আওয়ামী লীগ নেতা রেজাউল করিম রেজনু জামালপুর-৫ আসনে আওয়ামী লীগের মনোয়ন প্রত্যাশী বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমকে নির্বাচনে ফেল করানোর জন্য বিএনপি দলীয় কাকে মনোনয়ন পাইয়ে দিলে তার কাজটি হাসিল হবে-সেই তথ্য নিশ্চিত হওয়ার জন্যই সাবেক ছাত্রদলনেতা মাহবুবুর রহমান জিলানীর সঙ্গে ফোনে কথা বলার বিষয়টি স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। ফোনালাপে উঠে এসেছে বিএনপির সাবেক নেতা নঈম জাহাঙ্গীর প্রসঙ্গে। নঈম জাহাঙ্গীর বিএনপি থেকে সরে গিয়ে এলডিপিতে থাকেন কিছু দিন। সম্প্রতি তিনি মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্যে যুক্ত হয়ে কাজ করছেন। তবে তিনি এবার বিএনপি থেকেই মনোনয়নপত্র কিনেছেন। রেজনুর ফোনালাপে ওই আসনে বিএনপি দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী বিএনপির কেন্দ্রীয় জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বাবুলের পরিবর্তে সেখানে জাতীয় ঐক্য ফ্রন্টের মনোনয়ন প্রত্যাশী সাবেক বিএনপি নেতা নঈম জাহাঙ্গীরের মনোনয়ন নিশ্চিত করতে পারলে মির্জা আজমকে হারাতে সহজ হবে কিনা রেজনু সেই প্রশ্নই করেছেন ছাত্রদলনেতা জিলানীকে। জবাবে জিলানী চট করে রেজনুকে বলেন, ‘মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল কিন্তু মির্জা আজমের সাথে কুলাবো না।’ জবাবে রেজনু জানতে চান, ‘কোন ক্যানডিডেট বেটার ক্যানডিডেট। মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল না নঈম জাহাঙ্গীর?’ জিলানী বলেন, ‘নঈম জাহাঙ্গীর বেটার হবো।’ কখন রেজনু জানতে চান, ‘তুই কি গ্রুপিংয়ের কারণে কইতাছস নাকি?’ জবাবে জিলানী বলেন, ‘না না না গ্রুপিংয়ের জন্য না। তর অনু সবগুলা ঐক্যবদ্ধ হবো মোস্তাফিজুর রহমান বাবুলেরে ফেল করানোর লাইগ্যা। মির্জা আজমের সঙ্গে হাত মিলাবো অরে (মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল) নমিনেশন দিলে। আর সেই জায়গায় অরে যদি না দেয় তাইলে এরা সব আবার একত্রিত হয়া ঝাঁপায়া পড়বো।’ রেজনু আবারো প্রশ্ন করেন, ‘এক হয়ে কি নঈম জাহাঙ্গীরকে বাইর কইরা নিয়া আসার কি এবিলিটি আছে?’ জিলানী বলেন, ‘অনুতো আসলে সো টাফ। বাস্তবতাটা যা হলো..?’ রেজনু বলেন, ‘আমি তরে একটা কথা বলি। আই ওয়ান্ট টু স্পিক ইউ। বিএনপি জয়েন্টলি মার্চ কইরা সব শক্তি দিয়াও যদি নঈম জাহাঙ্গীরের পক্ষে কাজ করে। মির্জা আজমের এগেনইস্টে পাবে?’ জবাবে জিলানী বলেন, ‘হ্যা পাবো।’ এরপর আরো কিছু কথা হয় তাদের দু’জনের মধ্যে। ফোনালাপের শেষের দিকে জিলানীকে দুটি আসন ঘুরে এসে সর্বশেষ পরিস্থিতির একটা সামারি জানানোর কথা বলে রেজনু বলেন, ‘তর আর আমার ওপর ডিপেন্ড করবে ইলেকশন। এইটা তরে কয়া রাখলাম।’ এরপর তিনি ওই আসনের দুই উপজেলার বিগত দিনের নির্বাচনী ফলাফলের তথ্য সংগ্রহ করে আনার কথা বলেন এবং কাউকে এসব কথা বলতে নিষেধ করেন। জবাবে জিলানি বলেন, ‘না না। আমি নিজেই যাইয়া বাইর অইয়া পুরাটা সার্ভে কইরা আমু’। ‘খোদা হাফেজ’ বলে কথা শেষ করেন রেজনু। জবাবে জিলানী বলেন, ‘আল্লাহ হাফেজ।’ এ দিকে এই ফোনালাপ নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে আওয়ামী লীগনেতা রেজাউল করিম রেজনুর বিরুদ্ধে দলীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়েছে। মাদারগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ওবায়দুর রহমান বেলাল এই ফোনালাপ প্রসঙ্গে বলেন, একজন ছাত্রদল নেতার সঙ্গে ফোনালাপে আমাদের নেতা বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমকে ফেল করানোর ষড়যন্ত্রকারী আওয়ামী লীগনেতা রেজাউল করিম রেজনুকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কারের দাবি জানাচ্ছি। একই সঙ্গে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। মেলান্দহ পৌরসভার সাবেক মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হাজী দিদার পাশা বলেন, মেলান্দহ-মাদারগঞ্জ আসনই নয়, এ জেলায় ব্যাপক উন্নয়নের কারণেই পাঁচটি আসনেই বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। তার বিরুদ্ধে এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্রই মেনে নেয়া যায় না। আমরা ঐকবদ্ধভাবে সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে প্রস্তুত রয়েছি। ষড়যন্ত্রকারী রেজাউল করিম রেজনুর বিরুদ্ধে দলীয় সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি। এ প্রসঙ্গে জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক আহাম্মেদ চৌধুরী বলেন, রেজাউল করিম রেজনু জেলা আওয়ামী লীগের একজন সদস্য হলেও তিনি সব সময়ই বিএনপির এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন। জামালপুর সদর আসনের বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী সাবেক স্বাস্থ্য উপমন্ত্রী মোঃ সিরাজুল হক তার শ^শুর এবং আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শাহ মোঃ ওয়ারেছ আলী মামুন তার মামা শ^শুর। রেজনু বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রীর উন্নয়ন কার্যক্রম ও তার গণজোয়ারে ঈর্ষান্বিত হয়ে জামালপুরের পাঁচটি আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে পরাজয়ের জন্যই দীর্ঘদিন ধরে ষড়যন্ত্র করে আসছেন। একজন ছাত্রদলনেতার সঙ্গে তার ফোনালাপে সেই অপচেষ্টার বহির্প্রকাশ ঘটেছে। এই ষড়যন্ত্র অত্যন্ত নিন্দনীয়। মেলান্দহ-মাদারগঞ্জ ছাড়াও জেলার পাঁচটি আসনই আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। এখানে ষড়যন্ত্র করে কোন লাভ হবে না। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে তা প্রতিহত করবে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্রকারী রেজাউল করিম রেজনুর বিরুদ্ধে খুব শীঘ্রই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×