ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আড়াই গুণ বেশি বন্দী নিয়ে বিপাকে কারা কর্তৃপক্ষ

প্রকাশিত: ০৫:২১, ১৭ নভেম্বর ২০১৮

 আড়াই গুণ বেশি বন্দী নিয়ে বিপাকে কারা কর্তৃপক্ষ

মশিউর রহমান খান ॥ ধারণ ক্ষমতার প্রায় আড়াই গুণ বেশি বন্দী নিয়ে বিপাকে কারা কর্তৃপক্ষ। সারাদেশের এমন কোন কারাগার নেই যেখানে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে কমপক্ষে দ্বিগুণ বন্দী নেই। কোন কোন কারাগারে ধারণ ক্ষমতার বিপরীতে সর্বোচ্চ ৮ থেকে ৯ গুণ পর্যন্ত বন্দী রয়েছে। জেলা কারাগার থেকে শুরু করে সকল কেন্দ্রীয় কারাগারেই স্বাভবিকের চেয়ে বেশি বন্দী থাকায় প্রতিনিয়তই এসব বন্দীর স্বাভাবিক সকল প্রকার সুবিধা প্রদানে বা তাদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘ বছর ধরে এই সমস্যা চলে এলেও তেমন কোন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। তবে আটক মোট বন্দীর ৪৩ ভাগের বেশি বন্দীই মাদক সংশ্লিষ্ট বা মাদক মামলার আসামি বলে কারা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে। যাদের নিয়ন্ত্রণ করাও কারা কর্তৃপক্ষের পক্ষে কিছুটা কঠিন হয়ে পড়েছে। অতিরিক্ত বন্দীর ফলে সৃষ্ট সমস্যা সম্পর্কে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামের বিভিন্ন আদালত কর্তৃক জামিনে বের হওয়া আসামির কাছ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। বর্তমানে কমপক্ষে দেশের ১০টি কারাগারে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫/১০ গুণ বেশি বন্দী আটক রয়েছে। বর্তমান সরকার প্রতিবছর বন্দীদের আবাসনসহ সকল সমস্যা লাঘবে নতুন নতুন কারাগার নির্মাণ করলেও চাহিদার তুলনায় তা অত্যন্ত কমসংখ্যক আসামি এর সুবিধা পেয়ে থাকেন। একই সঙ্গে নিরাপত্তায় নিয়োজিত জনবল আগের চেয়ে কয়েক হাজার বাড়ালেও প্রায় আড়াই গুণ বন্দীর তুলনায় তা অপ্রতুল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে সারাদেশের ৫৫ জেলা কারাগার ও ১৩ কেন্দ্রীয় কারাগারসহ মোট ৬৮ কারাগারে বন্দী ধারণ ক্ষমতা রয়েছে ৩৬ হাজার ৬শ’ ১৪ জন। এর বিপরীতে সকল কারাগারে বর্তমানে আটক রয়েছে ৯৫ হাজারের বেশি বন্দী। এসব বন্দীকে নিয়ে অনেকটা বিপাকেই রয়েছে কারা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মচারী। ফলে নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে সংশ্লিষ্টরা দৈনিক বাধ্য হয়েই স্বাভাবিক কর্মঘণ্টার অতিরিক্ত সময় ব্যয় করছেন। তবে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম কারা কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়েই এসব বন্দীকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে কারা অধিদফতরকে। এজন্য কারা কর্তৃপক্ষকে বন্দীদের বিষয়ে সব সময়ই সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে। অধিক বন্দীর কারণে সৃষ্ট চলমান এসব সমস্যা অনুধাবন করে কারা অধিদফতর সাজপ্রাপ্ত কয়েদি আসামির চেয়ে বিচারাধীন হাজতি আসামির সংখ্যা বেশি হওয়ায় ও ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণের বেশি বন্দী আটক থাকায় কারাভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত নানা সমস্যা সৃষ্টির কথা উল্লেখ করে কয়েকমাস আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠায়। এতে বিচারাধীন আসামিদের মধ্যে শুধু মাদক মামলায় আটক আসামিই মোট আসামির ৩৭ শতাংশ বলে উল্লেখ করা হয়। বর্তমানে যা ৪৩ ভাগের বেশিতে পৌঁছেছে। চিঠিতে বলা হয়, আইনানুযায়ী এসব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ এক বছর হতে পারে। কিন্তু এদের অনেকেই সাজার চেয়ে বেশিদিন কারাগারে আটক রয়েছে। তাই সুষ্ঠু কারা ব্যবস্থাপনার স্বার্থে অতিদ্রুত এসব আসামির বিশেষ আদালতের মাধ্যমে বিচারকাজ শেষ করা যায় কিনা, সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে চিঠিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অনুরোধ করা হয়। কারা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, সরকার বন্দী ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে ও চলমান সঙ্কট দূর করতে দেশের বিভিন্ন জেলার পুরনো অব্যবহৃত কারাগার সংস্কারের মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর ফলে নতুন তৈরি হওয়ার পর বন্দী স্থানান্তর শেষে এটিকে কারাগার-১ হিসেবে ব্যবহার করা হবে। অপরদিকে জেলার পুরনো কারাগারগুলোকে কারাগার-২ হিসেবে ব্যবহার করা হবে। এতে বন্দী সমস্যা অনেকটা কমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত ৯ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের কারা-১ শাখার দেয়া প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন কারাগারে আটক বন্দীদের বর্তমান সংখ্যাধিক্য, ক্রমবর্ধমান বন্দী সংখ্যা, প্রধানমন্ত্রী প্রদত্ত অনুশাসন অনুযায়ী কারাবন্দীদের আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করে কারাগারগুলোকে সংশোধনাগারে রূপান্তরের লক্ষ্যে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ সংক্রান্ত আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়। সূত্র জানায়, কোন না কোন কারাগারের দীর্ঘ বছর ধরে অধিক বন্দী বাসের সমস্যা চলে এলেও বর্তমানে সমস্যাটি সকল কেন্দ্রীয় কারাগার ও গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কারাগারে তা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রতিনিয়তই বন্দীর সংখ্যা বাড়তে দেখা যাচ্ছে। সারাদেশের ৬৮ কারাগারে গত আগস্ট মাসে দেশের কারাগারগুলোতে ছিল ৮৩ হাজার বন্দী। কিন্তু তিন মাসের ব্যবধানে বন্দী বেড়েছে প্রায় ১২ হাজার। গত আগস্টে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৩ হাজার ৫ শ’ ৬ জন। সেপ্টেম্বর মাসে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৮ হাজার ৯শ’ ৭৫ জন। আর চলতি মাসের ১১ তারিখ এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৫ হাজার ৬শ’ ২৫জন। তথ্যানুযায়ী বর্তমানে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চসংখ্যক বন্দী কারাগারগুলোতে। পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, ঢাকা বিভাগের ১৭ কারাগারে বন্দী ধারণ ক্ষমতা রয়েছে ১১ হাজার ৩৪২ জনের। সেখানে গত আগস্টে বন্দী ছিল ২৮ হাজার ৩শ’ ৪৯ জন। তিনমাস পর নবেম্বর মাসে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৬শ’ জনে। এর মধ্যে ৪ হাজার ২শ’ ২৬ পুরুষ বন্দী বেড়েছে। অপরদিকে নারী বন্দী বেড়েছে ১শ’ ১৮ জন। রাজশাহী বিভাগের ৮ কারাগারের বন্দী ধারণ ক্ষমতা ৪ হাজার ৭৫ জন। বিপরীতে বর্তমানে ১২ হাজার ৫শ’ ১২ বন্দী আটক রয়েছে। এর মধ্যে পুরুষ বন্দী সবচেয়ে বেশি তবে তিন মাসের ব্যবধানে নারী বন্দী বেড়েছে ৪৭ জন। চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ কারাগারে বন্দী ধারণ ক্ষমতা রয়েছে ৬ হাজার ২৪ জন। বর্তমানে সেখানে আটক বন্দী রয়েছে ২২ হাজার ৪শ’ ১০ জন। এসব কারাগারে তিন মাসে প্রায় আড়াইহাজার পুরুষ বন্দী বেড়েছে। অপরদিকে সরকার পুরনো কারাগারগুলো ব্যবহার অনুপযোগী করার পাশাপাশি লঘু দন্ডে দন্ডিত বা অপরাধের বিচারে দেয়া সাজার তুলনায় অধিক সময় কারাগারে আটক রয়েছেন এমন বা যে সকল বন্দী ছোটখাটো অপরাধে আদালতের কাছে নিজের দোষ স্বীকার করবে তাদের আদালত কর্তৃক সাজা দিয়ে মুক্তি দেয়ার বিষয়েও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে লঘু অপরাধে আটক ৫ হাজারের অধিক আসামির একটি তালিকাও তৈরি করেছে কারা অধিদফতর। এ তালিকা ধরে আদালতের মাধ্যমে ও আইন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় বন্দীদের মুক্তি দেয়ার উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দেশের আটটি বিভাগের মধ্যে চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ লঘু অপরাধে আটক হয়ে আসামি হিসেবে কারাগারে রয়েছে বলে জানা গেছে। তালিকা অনুযায়ী চট্টগ্রাম বিভাগে ১ হাজার ৪ শ’ ৯, ঢাকা বিভাগে ১ হাজার ২শ’ ৪৩, ময়মনসিংহ বিভাগে ২শ’ ৩৭, রংপুর বিভাগে ৩শ’ ৭৫, রাজশাহী বিভাগে ১ হাজার ৩শ’ ২৩, খুলনা বিভাগে ৬শ’ ৪ ও বরিশাল বিভাগে ৪শ’ ৩৬ বন্দী রয়েছেন বলে জানা গেছে। সিলেট বিভাগের কারাগারে সবচেয়ে কম মাত্র ১শ’ ৪২ জন। যাদের আদালত কর্তৃক যাচাই-বাছাই ও বিচার শেষে গত সেপ্টেম্বর মাসে তাদের মুক্তি দিয়েছে। এর মধ্যে ৩৬ মামলা নিষ্পত্তি শেষে মুক্তি পেয়েছে আর ১০৬ জন মামলার পরবর্তী তারিখে আদালতে হাজির হবেন শর্তে তাদের মুক্তি দেয়া হয়েছে। কারা অধিদফতর সূত্র জানায়, লঘু অপরাধে আটক হাজতিদের পর বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী,পক্ষাঘাতগ্রস্থ ও ক্যান্সার রোগীকে মুক্তি দেয়া হবে। এছাড়া বিচার বিলম্বিত হয়ে আটক এমন বন্দীদেরও তালিকা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। যাদের আইনী পন্থা অবলম্বন শেষে মুক্তির প্রক্রিয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা গেছে। কারা অধিদফতর সূত্র জানায়, কারা বিভাগে বর্তমানে জনবল প্রায় ১২ হাজার। যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তাই সরকারের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত বন্দীর সমস্যা সমাধানের জন্য নতুন বৃহৎ আকারের কারাগার তৈরি, বন্দীর সংখ্যা কমাতে মামলা জট দূর করা, বিচার বিলম্বিত না করতে উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি সমাজ থেকে অপরাধ কমাতে জনসচেতনতা তৈরি ও ছোটখাটো অপরাধের দায়ে আটক আসামিদের দ্রুত বিচারের বা বিশেষ বিচারের ব্যবস্থা করা অতি জরুরী হয়ে পড়েছে। বর্তমানের তুলনায় বন্দী সংখ্যা বাড়তে থাকলে অধিক বন্দীর জন্য কারাগারের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে প্রয়োজনীয় জনবল বৃদ্ধি করাও অতি জরুরী হয়ে পড়েছে।
×