ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আসছে স্বপ্ন পূরণের দিন

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ১৭ নভেম্বর ২০১৮

আসছে স্বপ্ন পূরণের দিন

১৯শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে মাদারীপুরের শিবচর ও শরীয়তপুরের জাজিরায় নির্মিত হচ্ছে তাঁতপল্লী। মিরপুরের বেনারসি পল্লীর তাঁতীরাও এখানে পাবেন কারখানা আবাসনসহ আধুনিক সুবিধা। এখনই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এ অঞ্চলের তাঁতশিল্পের তাঁতী সম্প্রদায়। এ প্রকল্পের জন্য শিবচর উপজেলার কুতুবপুরে ৬০ একর ও জাজিরায় ৪৮ একর জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। তাঁতপল্লীতে থাকবে কারখানা, আবাসন, শিক্ষা, প্রশিক্ষণসহ আধুনিক সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা। মিরপুরের বেনারসি পল্লীর তাঁতীরাও দেশের বৃহৎ এ তাঁতপল্লী অন্তর্ভুক্ত হবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১ নবেম্বর এ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এখন এই পদ্মাপাড়ে এসেছে স্বপ্ন পূরণের দিন। আধুনিকতার ছোঁয়ায় পাল্টে যেতে শুরু করেছে দৃশ্যপট। তাঁতপল্লীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, এ অঞ্চলের মানুষ কতটা খুশি হয়েছেন। তাদের চোখে-মুখে এক ধরনের শান্তি বিরাজ করছে। যারা এ পেশা ছেড়ে জীবন-জীবিকার তাগিদে অন্য পেশায় চলে গিয়েছিল; তারাও স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছেন। আর ধন্যবাদ জানাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। কোন কোন বৃদ্ধ শেখ হাসিনার দীর্ঘায়ু কামনা করছেন। এ অঞ্চলের নারীরাও যারা এক সময় তাঁত বুনতেন; তাদের মধ্যেও দেখা গেছে আনন্দের ঝিলিক। তারাও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। শিবচর উপজেলার ভদ্রাসন গ্রামের ৭০ বছর বয়সী তাঁতী নূর মোহাম্মদ ব্যাপারী ও ৬০ বছর বয়সী সালাম ব্যাপারী এক সময় তাঁতে উন্নতমানের লুঙ্গি ও শাড়ি বুনতেন। কিন্তু পদ্মা নদীর ভাঙ্গনে রাজধানী থেকে বিচ্ছিন্ন এ অঞ্চলে ক্রেতাদের যোগাযোগ কমে যাওয়ায় তাদের ব্যবসায় ভাটা পড়তে শুরু করে। তাই তাদের নিজ পেশা ছেড়ে কৃষি কাজে নামেন। আর জীবিকা নির্বাহের সম্বল তাঁতের স্থান হয় ঘরের এক কোণে। দীর্ঘদিনের লালন করা তাঁতের প্রতি মমত্ববোধের কারণে না ফেলে সেটি রেখেছেন যতœ করেই। নিজের বাপ দাদার পেশায় কখনও ফেরা হবে কিনা তা নিয়ে ছিল চরম সংশয়। শুধু নুর মোহাম্মদ বা সালামই নয় ভদ্রাসন ও উমেদপুরের কয়েক হাজার পরিবার পেশা ছেড়ে বিকল্প পেশায় গিয়ে জীবন ধারণ করছে। ফলে অন্য পেশার ওপর বেড়েছে বাড়তি চাপ। কিন্তু পদ্মা সেতুর দ্রুত বাস্তবায়নের সঙ্গে এ এলাকায় তাঁতপল্লী স্থাপনের কাজ শুরু হওয়ায় নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন এ অঞ্চলের তাঁতীরা। শুধু কারখানা বা আবাসন সুবিধা নয়; এ সকল তাঁতীদের দাবি তাঁত নিয়ে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের। কাঁচামালসহ আধুনিক সব তাঁতের সরবরাহের দাবিও তাদের। তাঁত বোর্ড সূত্র বলছে, ১ নবেম্বর প্রধানমন্ত্রী তাঁতপল্লীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কিন্তু জায়গা নির্ধারণ হয়েছে আরও আগে। ২ মাসের মধ্যে শুরু হবে মাটি ভরাটের কাজ। প্রথম পর্যায়ে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২৫৩ কোটি টাকা। মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৯শ’ ১১ কোটি টাকা। প্রকল্পটির জন্য শিবচর উপজেলার কুতুবপুরে ৬০ একর ও জাজিরায় ৪৮ একর জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। অসংখ্য ৬ তলাবিশিষ্ট ভবনে প্রত্যেক তাঁতীর জন্য ৬শ’ ফুটের কারখানা ও ৮শ’ ফুটের মধ্যে আবাসন সুবিধা থাকছে। সরকারের পক্ষ থেকে সুতা ও রংসহ কাঁচামালের সুবিধা দেয়া হবে। নির্মাণ করা হবে আন্তর্জাতিক মানের শোরুম, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। তাঁতীদের ছেলেমেয়েদের জন্য থাকবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ভদ্রাসন এলাকার তাঁতী সেলিম বলেন, ‘আমরা এ এলাকার অনেক লোক আগে তাঁত শিল্পের কাজ করতাম। লুঙ্গি, গামছা, শাড়ি তৈরি করতাম রাতদিন। যখন সরকার সুতা সরবরাহ বন্ধ করে দেয় তখন লোকসানের মুখে পড়ে আমরা এই পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় চলে এসেছি। সরকার যদি আবার আমাদের সহায়তা করে তাহলে আবার আমরা এই পেশায় ফিরে যাব।’ আরেক তাঁতী বেলাল হোসেন বলেন, ‘মুন্সীগঞ্জ ও বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় এক সময় লক্ষাধিক তাঁতী পরিবার তাঁত শিল্পে কাজ করত। একটা সময় তাঁত শিল্পের বিভিন্ন উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি ও সঠিকভাবে বাজারজাত করতে না পেরে লোকসানের মুখে পড়ে তারা অন্য পেশায় চলে যায়। এতে অন্য পেশার ওপরও বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়েছে। সরকার যদি রং ও সুতার ওপর ১০ থেকে ২০ ভাগ ভর্তুকি প্রদান করে তাহলে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব।’ নূর মোহাম্মদ বেপারী বলেন, ‘আমরা তাঁতী পরিবার। আমার দাদা, বাবা, আমি ও আমার পরিবারের সকল সদস্যই তাঁত শিল্পের কাজ করেছি। রাত জেগে শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, চাদর তৈরি করে বাজারে বিক্রি করতাম। তখন ভালই ছিলাম। তবে সুতা, রংসহ বিভিন্ন সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বার বার লোকসানের মুখে পড়ে বাপ-দাদার এই পেশা ছাড়তে বাধ্য হই। এখন অন্য পেশায় চলে গেলেও শুধু আমার না এ এলাকার প্রতিটি ঘরে ঘরে যতœ করে তাঁতগুলো রাখা আছে। এখন সরকার তাঁতপল্লী করতে যাচ্ছে। সরকার যদি তাঁতপল্লীতে আমাদের স্থান দেয় তাহলে আমরা আবারও এই পেশায় ফিরে যেতে প্রস্তুত।’ তাঁতী সালাম ব্যাপারী বলেন, প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতুর পাড়ে তাঁত পল্লীর ভিত্তিস্থাপন করেছেন। এতে আমরা অনেক খুশি। আমরা চাই দ্রুত এই তাঁতপল্লীর কাজ শুরু করা হোক; যাতে আমরা আবারও হারিয়ে যাওয়া আমাদের ঐতিহ্য তাঁত পেশায় ফিরে যেতে পারি।’ শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান আহমেদ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সংসদীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক নূর-ই আলম চৌধুরীর ঐকান্তিক চেষ্টায় তাঁতপল্লী নির্মিত হচ্ছে। তাঁতপল্লী এই অঞ্চলে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে।’ মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মোঃ ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, ‘শিবচর ও জাজিরার শতাধিক একর জায়গার ওপর এই তাঁতপল্লী গড়ে তোলা হবে। এটা একটি বৃহৎ প্রকল্প। প্রায় ১৯শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হবে এই তাঁতপল্লী। এতে এই অঞ্চলে তাঁতশিল্পের প্রসার ঘটবে, তাঁতশিল্পের বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন হবে। মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে ও মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাবে।’ তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যান মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী পদ্মাপাড়ে তাঁতপল্লী গড়ে তোলার যে উদ্যোগ নিয়েছেন তাতে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প আবার পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠবে। প্রথম পর্যায়ে আমরা জমি অধিগ্রহণ, মাটি ভরাট, সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করে কনসালট্যান্ট নিয়োগ করব। এখানে সয়েল টেস্ট শেষে বিভিন্ন ভবন নির্মাণ করা হবে। প্রথম পর্যায়ে ২শ’ ৫৩ কোটি টাকার কাজ শেষ করা হবে। মূল প্রকল্প ১৯শ’ ১১ কোটি টাকার। এটা একটি মেগা প্রকল্প। এখানে ঢাকার মিরপুরের বেনারসি পল্লীর তাঁতী এবং এই অঞ্চলের তাঁতীদের পুনর্বাসন করা হবে। এদের প্রত্যকের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকবে। তাঁতীদের সরকারের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে অথবা ন্যায্যমূল্যে সুতা, রংসহ বিভিন্ন কাঁচামাল সরবরাহ করা হবে। রং করা, ফ্যাশন ডিজাইনসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।’ -সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে
×