ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাচ্য-প্রতীচ্যের সুরমূর্ছনায় মোহময় রাত

প্রকাশিত: ০৮:৩১, ১৭ নভেম্বর ২০১৮

প্রাচ্য-প্রতীচ্যের সুরমূর্ছনায় মোহময় রাত

মনোয়ার হোসেন ॥ প্রথম দিনের আলসেমি কাটিয়ে দ্বিতীয় দিনে আরও চাঙ্গা হলো উৎসব। ছুটির দিনে বনানীর আর্মি স্টেডিয়াম জনারণ্যে পরিণত। শেকড় সন্ধানী সুরের টানে ছুটে এসেছেন শহরের নানা প্রান্তের মানুষ। সুররসিকে টইটুম্বর ছিল মাঠ থেকে গ্যালারি কিংবা মঞ্চের সানের প্রতিটি আসন। শুক্রবার এভাবেই আলোড়িত হলো ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসব। সীমানা পেরোনো সঙ্গীতাসরে প্রাচ্যের সঙ্গে সংযোগ ঘটেছে পাশ্চাত্য লোকসঙ্গীতের। বহতা নদীর মতো সেই সুরধ্বনি ছুঁয়ে গেছে পারস্য অবধি। বাংলাদেশের দল স্বরব্যাঞ্জোর সঙ্গে এদিন শ্রোতার মন মজিয়েছে লোকগানে বাংলার অহঙ্কার মমতাজ। কন্নড়ের প্রাচীন কবিতার সুর আশ্রয়ী গানে ভিন্নতা ছড়িয়েছে ভারতের দল রঘু দীক্ষিত প্রজেক্ট। মেক্সিকো কিউবার সংযুক্ত লাতিন সুরে প্রাণ জুড়িয়েছে গ্র্যামি এ্যাওয়ার্ড জয়ী যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের ফোকব্যান্ড লস টেক্সমেনিয়াক্স। আরবী ঘরানার পারস্য সুরের মোহয়মতায় শ্রোতাকে আবিষ্ট করেছে ‘আরব বসন্ত’ পরবর্তী সময়ে গড়ে ওঠা বাহরাইনের লোকদল মাজায। আরবী ঢংয়ের সঙ্গে সফলভাবে জুড়ে দিল প্রগ্রেসিভ রক। গিটার, ড্রামসে ভাঙা তাল, বেস গিটারে, ট্যাপিং, ভায়োলিনের বেদুঈন সুর-সব মিলিয়ে অসাধারণ। এভাবেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সুরে বন্ধনে ঝলমলিয়ে ওঠে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্টের দ্বিতীয় রাত। উৎসবের শেষ পরিবেশনায় শ্রোতার সবটুকু মনোযোগ যেন নিজের পানে টেনে নেন মমতাজ। শ্রোতার ভালবাসামাখা করতালির মধ্যে মঞ্চে আসেন তিনি। শুরুতেই কথার আশ্রয়ে নিজের সঙ্গে সংযোগ ঘটান সুররসিকদের। বলেন, সারাবছর এ উৎসবের অপেক্ষায় থাকি। নিজেদের ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে চাই বাউল গানের মাধ্যমে। পরিবেশনার শুরুতে শিল্পী গেয়ে শোনান- আমি তাই তো মাটির গান গাই/আমি তাই মমতাজ গাই/এই জারি-সারি ভাটিয়ালি গাই...। দ্বিতীয় পরিবেশনার শিরোনাম ছিল- আরে ও সোনার মুর্শিদরে/আরে ও প্রাণের বান্ধবরে/আমি কি দিয়া ভজিবো রে তোমারে ...। দরদি কণ্ঠে বিচ্ছেদী সুরে পরিবেশিত তৃতীয় গানের শিরোনাম ছিল- আমারে পোড়াইতে তোমার এত আয়োজন/আমারে ডুবাইতে তোমার এত আয়োজন ...। বেদনার্ত বাণীবহ কোমল সুরের গানের উচ্ছ্বাসের বদলে তন্ময় হয়ে উপভোগ করে গানপ্রেমীরা। এরপর আসন্ন শীতে প্রিয়তমকে কাছে পাওয়ার আকুলতা কণ্ঠে মেলে ধরেন শিল্পী। গেয়ে শোনান- আমার সোনা বন্ধু রইলো বৈদেশেতে দারুণ শীতে...। পরের পরিবেশনায় ছিল শ্রোতাকে মাতোয়ারা করার পালা। কণ্ঠটাকে চড়িয়ে অনুরাগীদের আনন্দে ভাসিয়ে গেয়ে শোনান- আদর কইরা ঘরে তুলোস/ঘাড় ধইরা নামাস/বন্ধু তুই লোকাল বাস...। এখানেই থেমে যেত মমতাজের গানের পর্ব। কিন্তু সঙ্গীতানুরাগীদের অনুরোধে কণ্ঠে তুলে নেন আরেকটি গান। উন্মাতাল শ্রোতার হৃদয়ে অপার ভাললাগার অনুভব বুনে গাইলেন- পাংখা পাংখা পাংখা হইলো মন ...। হেমন্ত সন্ধ্যায় দ্বিতীয় দিনের আয়োজনের শুরুতেই মঞ্চে আসে রাজশাহীর লোকগানের দল স্বরব্যাঞ্জো। ফোক ফিউনশধর্মী দলটি প্রথমেই গেয়ে শোনায় সুকুমার রায়ের গান ‘মহারাজা তোমায় সালাম’। শ্রোতাকে মুগ্ধ করা তাদের পরিবেশিত অন্য গানগুলো ছিল ‘জানি তে চাই দয়াল তোমার আষল নামটা কি’, ‘দেখ ভাল জনে রইল ভাঙা ঘরে, মন্দ লোকে সিংহাসনে চড়ে’, ‘শাল বৃক্ষের মতন সিনা টান মেরেছে’, ‘কাইন্দনা কাইন্দনা কন্যা না কান্দিয়ো আর সেই বাইগুন তুইল্যা দিমু তোমার গলার হার’ ও ‘ইন্দুবালা গো’ প্রভৃতি গান। স্বরব্যাঞ্জো এই প্রথম গান শোনাল ফোক ফেস্টের মঞ্চে। বাংলাদেশে এ দলটিই প্রথম কপিলেফট মুভমেন্টের যাত্রা শুরু করে। শুধু বাণিজ্যের বদলে ভালবাসার টানে গান করে না দলটি। সেই ভাবনা থেকে ব্যান্ডটি গান-বাজনা (২০১৫) এবং হাওয়ার চিঠি (২০১৬) নামের দুটি এ্যালবাম বাজারজাত না করে বন্ধুদের মাঝে বিনামূল্যে কিছু কপি বের করেছে। দুটো এ্যালবামের গানগুলোসহ তাদের অন্যান্য গান ইন্টারনেটে শেয়ার করেছে, এমনকি ডাউনলোডও বিনামূল্যে দেয়া হয়েছে। এ দলের সদস্যরা চার ভোকাল হলেন বগা তালেব, রপক আহমেদ, আসিফ হাসান নিলয় ও রাতুল সরকার, বাঁশি ও হারমোনিকায় আছেন শহিদুল আলম জীবন ও বগা তালেব, গিটারে বানা রতœ ও নিলয়, বেস গিটারে রুপক আহমেদ ও তানভির-আল-আযাদ, ভায়োলিনে অধরা শ্রেয়সী অথৈ এবং পারকাশান ও কাহনে আছেন সঞ্জয় মল্লিক। স্বরব্যাঞ্জোর পরিবেশনা যন্ত্রসঙ্গীতের সুর নিয়ে মঞ্চে আসে বাহরাইনের লোকগানের দল মাজায। বিচিত্র বাদ্যযন্ত্রের সহযোগে দলটির ঘণ্টাব্যাপ্তির পরিবেশনা শ্রোতার হৃদয়ে ছড়িয়েছে স্নিগ্ধতা। বাদ্যযন্ত্র নির্ভর দলটি গিটার, বেজ গিটার, ড্রামস, ভায়োলিনযোগে এ্যারাবিয়ান সঙ্গীতের সঙ্গে প্রগ্রেসিভ রকের পরিবেশন করেন। ওপেথের ডার্ক বা বø্যাকমোর নাইটসে’র মেলানকোলি ভাব সবই যেন ছড়িয়ে আছে তাদের সঙ্গীতে। মাজাযের যন্ত্রসঙ্গীতের সুর থামলে মঞ্চে আসে ভারতের রঘু দীক্ষিত প্রজেক্ট। বর্তমানে ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় লোকশিল্পী রঘুপতি দ্বারকানাথ পরিবেশন করেন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকসঙ্গীত। রঙিন লুঙ্গি ও ফতুয়া পরে রঘুপতির গানে খুঁজে পাওয়া যায় কন্নড় কবিতার ছন্দ। রঘুপতির সঙ্গে পরিবেশনায় ছিলেন নেরেশ নাথান, জো জ্যাকব ও নাভিন থমাস। এর পর মঞ্চে আসে গ্র্যামি পুরস্কার জয়ী যুক্তরাষ্ট্রের দল লস টেক্সমেনিয়াক্স। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস ও উত্তর মেক্সিকোর স্প্যানিস অভিবাসীদের লোকজ গান তেহানো থেতে অনুপ্রাণিত হয়ে ম্যাক্স বাকা ১৯৯৭ সালে গঠন করেন এই ব্যান্ডটি। ২০১০ সালে সেরা তেহানো এ্যালবাম হিসেবে দলটি গ্র্যামি পুরস্কার জয় করে। দলটির গানে বøুজ, লোকজ, কান্ট্রি, জ্যাজ ও রক মিউজিকের প্রভাব মেলে। বিশ্বের অন্যতম সেরা বাহো সেক্সতো বাদক ম্যাক্স বাহার নেতৃত্বে দলটিতে ছিলেন এ্যাকোর্ডিয়ানে জশ বাকা, ড্রামে লরেনযো মার্টিনেয, নোয়েল হার্নান্দেজ, উইল জে. লস ও ফ্লাকো ইয়েমিনেয। মেরিল নিবেদিত সান ফাউন্ডেশন আয়োজিত চতুর্থতম এ আন্তর্জাতিক সঙ্গীতায়োজনে অংশ নিচ্ছেন বাংলাদেশসহ সাত দেশের ১৭৪ জন কণ্ঠসঙ্গীত, যন্ত্রসঙ্গী ও নৃত্যশিল্পী। চতুর্থ আসরে সহযোগিতা করছে ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড, গ্রামীণফোন ও রাঁধুনী। বরাবরের মতো ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসব সরাসরি সম্প্রচার করছে মাছরাঙা টেলিভিশন। এছাড়াও গ্রামীণফোনের অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং সার্ভিস ‘বায়োস্কোপ লাইভ’-এ অনুষ্ঠানটি লাইভ দেখার সুযোগ থাকছে। আজকের উৎসবসূচী॥ আজ শনিবার উৎসবের শেষ দিন। এদিনের পরিবেশনায় অংশ নেবেন বাংলাদেশের বাউল কবির শাহ, অর্ণব ও নক্সীকাঁথা এবং পাকিস্তানের শাফকাত আমানত আলী ও স্পেনের ফোকব্যান্ড লাস মিগাজ ।
×