ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করনে সবাইকে সচেতন হতে হবে’

প্রকাশিত: ০২:০৪, ১৭ নভেম্বর ২০১৮

‘সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করনে সবাইকে সচেতন হতে হবে’

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের স্বাস্থ্য সেবার বিষয়কে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে অগ্রাধিকার দেয়ার বিষয়ে সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকা উচিত। সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার পাশাপাশি, নাগরিক সমাজ, উন্নয়ন সংগঠন এবং সর্বোপরি জনগণকে সচেতন হতে হবে। শনিবার সাভারের খাগান এলাকায় ব্রাক-সিডিএম আয়োজিত ‘ ৪র্থ আন্তর্জাতিক জনগণের স্বাস্থ্য সম্মেলন-২০১৮ ’ এর দ্বিতীয় দিনের বিভিন্ন অধিবেশনে আলোচকবৃন্দ এসব কথা বলেন। সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ৭০০ বিদেশি এবং বাংলাদেশ থেকে স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিবৃন্দ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ, চিকিৎসকবৃন্দসহ প্রায় ১,৫০০ প্রতিনিধি এই অংশগ্রহণ করছেন। শনিবার সম্মেলনের আয়োজক কমিটির পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এদিন সম্মেলনের মূল অধিবেশন, ৫টি উপ-অধিবেশন এবং ৭টি বিষয়ভিত্তিক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। মূল অধিবেশনের বিষয় ছিল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ধ্বংস বা বিকশিত করার সামাজিক ও ভৌত শর্তসমূহ। অধিবেশনে সভাপতিত্ত্ব করেন পিএইচএম এর সাবেক গ্লোবাল কোর্ডিনেটর ড. রবি নারায়ন। বক্তব্য রাখেন ফিলিস্তিন এর স্বাস্থ্য আন্দোলন কর্মী সাথাহ ওদেহ, অধ্যাপক ফ্রান বাউম, ফ্লাইন্ডারস বিশ্ববিদ্যালয়, অষ্ট্রেলিয়া এবং মানবাধিকার কর্মী শিরিন হক। অধিবেশনে বিশ^ব্যাপি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন ও অবনয়নের পেছনে সামজিক ও ভৌত অবস্থার প্রভাব সম্পর্কে বক্তারা আলোকপাত করেন। ফিলিস্তিনের জনগণের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় দুর্বল অভিগম্যতার উদহারণ দিয়ে সাথাহ ওদেহ বলেন, জনগনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে আর্থ-সামাজিক অবস্থার ভূমিকা শতকরা ৪০ ভাগ, বায়োলজিকাল ভূমিকা ১০ ভাগ, ক্লিনিকাল প্রভাব ১০ ভাগ এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে সহযোগিতার ভূমিকা ৩০ ভাগ। তিনি বলেন ১৯৪৮ সাল থেকে ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েল-এর দখলদারিত্ব এবং অধিকৃত অঞ্চলে দেয়াল তুলে ফিলিস্তিনিদের অবরুদ্ধ করে রাখায় তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মারাত্মক ঝুঁকির মুখে। তিনি বলেন, ৪০ ভাগেরও বেশি ফিলিস্তিনি রোগী ইজরায়েলী নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক নিরাপত্তা পারমিট না পাওয়ায় উন্নত চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে। আয়োজক কমিটি আরও জানায়, শ্রেনী, বর্ণ এবং জাতপাতভিত্তিক সংখ্যালঘুদের স্বার্থে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পুনর্গঠন বিষয়ক উপ-অধিবেশনে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভারতের স্বাস্থ্য আন্দোলন সংগঠন জনস্বাস্থ্য অভিযান এর কো-কোর্ডিনেটর এনবি সরোজিনি, বেনিন এর স্বাস্থ্য আন্দোলন কর্মী প্যাকোম টোমেটিসি এবং বাংলাদেশের দলিত মানবাধিকার কর্মী তামান্না সিং বাড়াইক। সভাপতিত্ত্ব করেন বিশিষ্ট আইনজীবি ব্যরিস্টার সারা হোসেন। অধিবেশনে বক্তারা বলেন, বিশ^ব্যাপি দ্রুত উন্নয়নের মডেলে সংখ্যালঘু, আদিবাসীদের স্বার্থ একদিকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় নীতি ও পরিকল্পনায় এসব জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য উন্নয়নের বিষয়টি বাদ পড়ে যাচ্ছে। চা বাগানের উদহারণ দিয়ে তামান্না সিং বাড়াইক বলেন, বাংলাদেশে চা জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা হতদরিদ্রদের তুলনায়ও খারাপ। প্রতিটি বাগানে কোম্পানি কর্তৃক হাসপতাল থাকলেও তাতে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবার কোন ব্যবস্থা নেই। সকল ধরনের অসুখের জন্য একই ওষুধ প্রদান করা হয়ে থাকে। আবার দৈনিক ৮৫ টাকা বেতনের একজন চা-কর্মীর পক্ষে বাগানের বাইরে বেসরকারী হাসপাতালেও চিকিৎসা করানোর সুযোগ নেই। জেন্ডার এন্ড হেলথ শীর্ষক উপ অধিবেশনে লাডা ভেইগান্ড ক্রোশিয়ার নারী প্রজনন স্বাস্থ্যের চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ক্রোশিয়ায় গাইনোক্লোজিকাল চিকিৎসার ব্যাপক বেসরকারীকরণের ফলে সন্তান প্রসব ব্যবস্থা খুবই ব্যায়বহুল। এছাড়াও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সাথে জড়িত চিকিৎসক কর্মকর্তাদের রোগীদের অবস্থাকে প্রাধান্য না দেয়া এবং উদাসীনতার কারণে প্রসবকালীন সময়ে নারীরা যথাযথ চিকিৎসা পাননা। ক্রোশিয়ায় প্রতি ৩ জনের ১ জন নারী স্বাস্থ্যখাতে দুর্বল ব্যবস্থার কারণে সন্তান নিতে আগ্রহী হন না। অন্যান্য বক্তারা নারী প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে সারা পৃথিবীর চিত্র একই বলে মত দেন। তারা কোন ব্যক্তিগত ঘটনা মোকাবেলার চেয়ে পুরো পদ্ধতির পরিবর্তনের জন্য সরকারকে উদ্যোগী হওয়ার আহবান জানান। এদিকে, সম্মেলনের প্রথম দিন শুক্রবার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ব্র্যাক-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সম্মেলন জাতীয় কমিটির চেয়ারপারসন স্যার ফজলে হাসান আবেদ এবং প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন হার্ট ফাউন্ডেশন-এর চেয়ারম্যান ও জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগ. (অব.) আব্দুল মালিক। বক্তব্য উপস্থাপন করেন অধ্যাপক ফ্রান বাউম, ফ্লাইন্ডারস বিশ্ববিদ্যালয়, অষ্ট্রেলিয়া ও সাবেক তত্ত্ববধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন জাকির হোসেন, চেয়ারপারসন, পিএইচএম- বাংলাদেশ। প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগ. (অব.) আব্দুল মালিক বলেন, একটি দেশের সমৃদ্ধি নির্ভর করে জনগণের গুনগত শিক্ষা, উন্নত শারিরীক ও মানসিক স্বাস্থ্য অবস্থার ওপর। তিনি বলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের শতকরা ৬৭ ভাগ লোক অসংক্রামক রোগে মারা যায়। এছাড়া ১২ ভাগ লোক ক্যান্সার, ৩০ ভাগ লোক হৃদরোগ, ৩ ভাগ লোক ডায়াবেটিস এবং ১২ ভাগ লোক অন্যান্য রোগে মারা যায়। তিনি বলেন এসব রোগের নির্ণয় এবং চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যায়বহুল। আমাদের মতো উন্নয়শীল দেশের জনগণ কিভাবে এসব রোগ সৃষ্টি হয় তা সম্পর্কে সচেতন নয় এবং এর চিকিৎসা তাদের আয়ত্ত্বের বাইরে। সরকারের একার পক্ষে এসব রোগ মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। তাই জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, গনমাধ্যম, পেশাজীবী, শিক্ষাবিদ, ধর্মীয় নেতা, বুদ্ধিজীবী সকলকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে যাতে করে তৃণমূলের জনগণ এসব রোগ সম্পর্কে সচেতন হতে পারে। তিনি সরকারে হতদরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিতদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদানের আহবান জানান। এছাড়া স্বাস্থ্য বিমা, চিকিৎসার জন্য সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদানের বিষয়েও জোর প্রদান করেন। সভাপতির বক্তব্যে স্যার ফজলে হোসেন আবেদ ইতিহাস থেকে উদ্বৃত্ত করে বলেন, জনগণের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে রাজনৈতিক উদ্যোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ২য় বিশ^যুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপে বিশেষ করে যুক্তরাজ্য এবং জার্মানীতে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার পরিধি বৃদ্ধিতে রাজনৈতিক উদ্যোগ ভূমিকা রেখেছিল। বাংলাদেশে সরকারের উদ্যোগে ১৯৮২ সালে জাতীয় ওষুধ নীতি প্রণয়নকে যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে খুব শীঘ্রই একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তিনি সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের স্বাস্থ্য সেবার বিষয়কে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে অগ্রাধিকার দেয়ার বিষয়ে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান।
×