ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা জানিয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে আরেকটি প্রস্তাব পাস

নাগরিকত্ব দিয়ে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিন

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ১৮ নভেম্বর ২০১৮

নাগরিকত্ব দিয়ে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিন

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ নাগরিকত্বের অধিকার লাভসহ ছয়দফা দাবি তুলে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা গত ১৫ নবেম্বর বৃহস্পতিবার প্রত্যাবাসনের নির্ধারিত দিনে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করে নিজ দেশ অর্থাৎ মিয়ানমারে ফিরে যায়নি। শুধু নাগরিকত্ব নয় রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বরতার যে ঘটনা ঘটে গেছে তার বিচারের দাবিও উত্থাপন করেছে। প্রত্যাবাসনের পূর্বে তাদের এসব দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তারা অনড় অবস্থানে অর্থাৎ বাংলাদেশ ত্যাগ করবে না বলে সুস্পষ্টভাবে জানান দিয়েছে। ফলে ওইদিন বাংলাদেশ ও মিয়ানমার পক্ষের সকল প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বে¡ও ঘুমধুম জিরো পয়েন্ট দিয়ে প্রত্যাবাসন শুরুর প্রক্রিয়া থমকে গেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এর পরদিন অর্থাৎ শুক্রবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের মানবাধিকার বিষয়ক কমিটিতে (থার্ড কমিটি) রোহিঙ্গা নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা জানিয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আরেকটি প্রস্তাব পাস হলো। ভোটাভুটিতে এ সিদ্ধান্তের পক্ষে ছিল ১৪২টি দেশ। আর বিপক্ষে ছিল ২৬টি। এছাড়া অপর ২৬টি দেশ ভোটদানে ছিল বিরত। বিপক্ষে ভোট দিয়েছে শক্তিশালী চীন ও রাশিয়া। এ ছাড়া মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ কম্বোডিয়া ও লাওস প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদ অনুযায়ী, মুসলিম দেশগুলোর জোট ওআইসির পক্ষে বাংলাদেশ ও ইউরোপের জোট ইইউ’র (ইউরোপীয় কমিশন) পক্ষে অস্ট্রিয়া যৌথভাবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের মানবাধিকারবিষয়ক থার্ড কমিটিতে প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন। উত্থাপিত প্রস্তাবের পক্ষে জাতিসংঘে তুরস্কের স্থায়ী প্রতিনিধি ওআইসির প্রতিনিধি হিসেবে ফরিদুন সিনিরলিগ্নু বলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে নানা কৌশলে নির্যাতিত হয়ে আসছে। ২০১৭ সালে এ জনগোষ্ঠীর ওপর অভিযান ছিল ওই কৌশলেরই একটি অংশ। সকলে মিলে একটি কৌশল প্রণয়ন করতে না পারলে এ সঙ্কটের সমাধান অসম্ভব বলে তিনি মত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ওআইসি মনে করে রোহিঙ্গাদের তাদের অধিকার নিয়ে মিয়ানমারে বসবাস নিশ্চিত করতে হবে। আর তাদের নিপীড়নকারীদের শাস্তি না হলে এটা অসম্ভব। পক্ষান্তরে, মিয়ানমারের স্থায়ী প্রতিনিধি হাউ দো সুয়ান তার বক্তব্যে বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও একপেশে এ প্রস্তাব পাস হলে রাখাইন রাজ্যে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় মিয়ানমার সরকারের প্রচেষ্টা ব্যাহত হবে। বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন তার বক্তব্যে বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের প্রতি দায়িত্ব পালনের স্বার্থে এ প্রস্তাব পাস করতে সকলের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, মিয়ানমারে নিপীড়নের শিকার হয়ে কয়েক দশক ধরে চার লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। গত বছরের আগস্টে রাখাইন প্রদেশে মিয়ানমার সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করলে আরও সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়। এরপর জাতিসংঘের পক্ষে এ ঘটনাকে জাতিগত নিধন হিসাবে আখ্যা দেয়। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মুখে মিয়ানমার সৈন্যদের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের অভিযোগ উঠে আসে। মামুস বিন মোমেন আরও জানান, তালিকাভুক্ত রোগিঙ্গা সদস্যরা মিয়ানমারের আশ্বাসের প্রতি কোনভাবেই আস্থা আনতে পারেনি। এরই ফলশ্রুতিতে একটি পরিবারও স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে সম্মত হয়নি। ১৫ নবেম্বর নির্ধারিত প্রত্যাবাসনের দিনে রোহিঙ্গারা বিক্ষোভ করে সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছে, নাগরিকত্বের পূর্ণ নিশ্চয়তা, নিজ ভূমিতে অধিকার প্রতিষ্ঠা, ক্ষতিপূরণ প্রদান, সহিংসা থেকে সুরক্ষা ও সহিংসতার বিচার করা এবং ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পূর্ণ নিশ্চয়তা ব্যতীত তারা মিয়ানমারে ফিরে যাবে না। ফলে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের উপযোগী পরিবেশ তৈরির নিশ্চয়তা বিধানে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহকে অবশ্যই মিয়ানমারে বাধাহীনভাবে প্রবেশের সুযোগ দিতে হবে। আলোচনার পর রোহিঙ্গা সংক্রান্ত প্রস্তাবটি ভোটাভুটিতে গেলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক থেকে এটি পাস হয়। প্রসঙ্গত, গত বছর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের মানবাধিকার বিষয়ক থার্ড কমিটিতে ওআইসির আহ্বানে এ ধরনের একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। যা পরবর্তীতে সাধারণ পরিষদের প্ল্যানারিতে পাস হয়। ওই সময় থার্ড কমিটিতে ১৩৫টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে, ১০টি দেশ বিপক্ষে ভোট দেয়। এরপর গত শুক্রবার অনুরূপ কমিটিতে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব উঠলে তা ১৪২-২৬ ভোটে পাস হয়। এতে দেখা যায় প্রস্তাবের পক্ষে এবার বেড়েছে। প্রস্তাবে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিয়ে ফিরিয়ে নেয়ার আহ্বানও জানানো হয়েছে। থার্ড কমিটিতে গৃহীত এ প্রস্তাব আগামী ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্ল্যানারিতে উপস্থাপিত হবে বলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে। নতুনভাবে প্রস্তুতি ॥ এদিকে গত ১৫ নবেম্বর প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া রোহিঙ্গাদের দাবির মুখে স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর এখন নতুন করে অনুরূপ তৎপরতা শুরু করেছে প্রশাসন। কিন্তু এ প্রক্রিয়াও সুফল বয়ে আনবে কিনা তা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। কেননা, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা এখন একজোট হয়ে নাগরিকত্বসহ যে ছয়দফা দিয়ে তৎপর রয়েছে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের মানবাধিকার বিষয়ক কমিটিও প্রকারান্তরে রোহিঙ্গাদের এসব দাবির সমর্থনেই আলোচিত হয়েছে। এতে রোহিঙ্গারা উল্লসিত। এদিকে, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম শনিবার বিকেলে জনকণ্ঠকে জানান, রোহিঙ্গাদের রাজি করানো গেলে প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতি আবারও নেয়া হতে পারে। তিনি জানান, নতুনভাবে প্রত্যাবাসনের জন্য এখনও কোন দিনক্ষণ ঠিক করা হয়নি। প্রত্যাবাসনে রাজি করাতে তার দফতরে কর্মকর্তারা কাজ করছেন। এতে সহযোগিতায় রয়েছেন জাতিসংঘের প্রতিনিধিবৃন্দ। তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা যখন রাজি হবে তখন প্রত্যাবাসন করা হবে। স্থানীয়দের ক্ষোভ ॥ অপরদিকে প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ায় উখিয়া- টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর নেতিবাচক মনোভাবের কারণে প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়দের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কতিপয় এনজিও ও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতার কারণে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম থমকে গেছে। স্থানীয় সূত্রগুলো আরও জানিয়েছে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে এসেছে। বাংলাদেশ মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতেই হবে। বাংলাদেশ তাদের দেশ নয়। মিয়ানমারই তাদের দেশ। বাড়তি রোজগারে রোহিঙ্গারা ॥ আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইন অনুসারে স্বেচ্ছায় কেউ না বললে তাকে জোর করে পাঠানো যায় না। যেটি রোহিঙ্গাদের বেলায় বাংলাদেশ সরকার এ পর্যন্তও পালন করে আসছে। তবে শরণার্থী বা আশ্রিত হিসাবে তারা যেদেশে আশ্রয় নেবে, সেখানে আশ্রয় শিবিরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে তাদের জীবনযাপন। শিবির ছেড়ে বাইরে যেতে হলে ক্যাম্প ইনচার্জের অনুমতির প্রয়োজন রয়েছে। তারা সেদেশে কোন ধরনের ব্যবসা, চাকরি, বাড়তি রোজগার এমনকি ওই দেশের মুদ্রাও রাখতে পারবে না বলে শরণার্থী আইনে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা প্রতিনিয়ত আইন লঙ্ঘন করে চলেছে। আশ্রয় শিবিরে দোকানপাট স্থাপন করে ব্যবসা বাণিজ্যও শুরু করেছে। ওই আইন প্রকাশ্যে লঙ্ঘন করে চলেছে রোহিঙ্গারা। দোকান স্থাপন করে দিব্যি ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। দিনমজুরির কাজ ছাড়াও বিভিন্ন এনজিও সংস্থায় এদের একটি অংশ চাকরি করছে। কুতুপালং ও বালুখালী শিবিরে রোহিঙ্গাদের সারিবদ্ধ দোকানগুলো ‘রোহিঙ্গা মার্কেট’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। টেকনাফ ও উখিয়ায় ত্রিশ শিবিরে অন্তত দশ হাজার দোকান রয়েছে রোহিঙ্গাদের মালিকানায়। এছাড়া উখিয়া টেকনাফের সর্বত্র অবাধ যাতায়াত ও ব্যবসা বাণিজ্য চালিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা।
×